ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ জুলাই ২০২৪, ২৪ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

নিষ্ফল প্রত্যাশার জনসুনামি!

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১২
নিষ্ফল প্রত্যাশার জনসুনামি!

ঢাকায় পরপর দুইটি বড় রাজনৈতিক জোটের মহাসমাবেশ হয়ে গেল। দুটোতেই লাখো জনতার ঢল দেখে মনে হয়েছে, ‘অবাক বাংলাদেশ, অবাক করেছো তুমি’।

বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের একের পর এক চরম ব্যর্থতা, জনগণের নিরাপত্তা দিতে অপরাগতা, দলীয় সন্ত্রাসীদের অব্যাহত সন্ত্রাসকর্মে মানুষ অতিষ্ঠ। তারপরেও জনসভায় লাখো মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার।
অন্যদিকে, আজকের বিরোধীদলের আমলেও যে অবস্থা ছিল, সেটাও খুব সুখকর নয়। সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে সেখানেও প্রশাসনের শত বাধা ডিঙিয়ে লাখো মানুষের আবির্ভাব।

এই দুই সমাবেশের আগে আগে আরেকটা প্রতিবাদ হয়ে গেল মেঘের ডাকে। যারা নাগরিক জীবনে শত ভোগান্তির জন্য দায়ী তাদের সভাতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। কিন্তু একটা অসহায় কচি শিশু তার পিতামাতার হত্যার বিচার চাইতে স্কুল ফেলে রাজপথে নেমেছে। সেখানে মানুষের বড় অভাব। সীমাহীন অপরাধ করেও, নাগরিক ভোগান্তি তৈরি করেও, সরকার পরিচালনায় আগে-পরে ব্যর্থ হয়েও যেখানে এতো মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের শোধরানোর তাগিদ অনুভব করবে কেন?

আমরা কথায় কথায় রাজনৈতিক দলগুলোকে বলি, ওরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। কিন্তু আসলে ওরাই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে, জনগণ নেয়নি। নেতারা দেখেছে শত অপরাধ করেও, অনিয়ম করেও, সন্ত্রাস করেও কি অবলীলায় লাখো মানুষের সমর্থন মেলে। নেতানেত্রীদের প্রয়োজনে মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে দেয়। নেতাদের কি দরকার ভালো মানুষটি হতে যাবার! জনগণ যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিত তবে মেঘের মানববন্ধন হতে পারত তাহরির স্কোয়ারে জনসমাবেশের অনুরূপ।

আজকের বাংলানিউজে সুদীপ্ত সালামের ‘দুটি সমাবেশের মাঝখানে একশ বারটি লাশ’ পড়ে সত্যি লজ্জিত হলাম। মেঘনায় লঞ্চডুবিতে শত মানুষের মৃত্যুও নেতাদের বক্তৃতায় উল্লেখিত হতে পারেনি। কোনো সভ্য দেশের গণমুখী দল হলে সবকিছু ফেলে ছুটে যেত ঘটনাস্থলে। বলতেই হবে, হে সাধুবেশী জনগণ, তোমাদের যত নাগরিক ভোগান্তি, তার জন্য তোমরাই দায়ী, নেতারা নয়। বারবার বঞ্চনার শিকার হয়েও কিসের টানে ছুটে যাও ওখানে? পথেঘাটে এত লাশ! তারপরেও হুশ হয় না তোমাদের! মরার জন্য খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কে রুখবে তোমাদের এই মৃত্যুর কাফেলা!

রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সমাবেশে রাজপথ দখলের ঘোষণা দিয়েছে। কেউই জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেনি। কেউই বলেনি কিভাবে ঘটে যাওয়া লঞ্চডুবির মত ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে নাগরিক জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা যায়। নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য আনার প্রত্যয় কেউই ব্যক্ত করেনি। সবাই বলেছে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার কথা। পুরো দেশটা তাদের কাছে একটা বিশাল চরের মতো। এই চরের ইজারাদার হচ্ছে তারা। চরের দখল পেতে জনগণ হচ্ছে তাদের পক্ষে লাঠিয়াল বাহিনী। সামন্তবাদী এই ব্যবস্থায় লাঠিয়ালের যেমন কোনো অধিকার থাকে না, তেমনি বাংলাদেশ নামক চরে জনগণের কোনো অধিকার নেই। এখানে যা কিছু সৃষ্টি সব সেই ইজারাদারদের জন্য।

দুটো সমাবেশ থেকে আমরা এরপরেও কিছু শিক্ষা নিতে পারি। বরাবরের মতো প্রশাসনের চরিত্র যে পাল্টায়নি সেটা বেশ পরিষ্কার। বিরোধীদলের সমাবেশ ঠেকাতে সারা দেশে দেদারসে চলেছে ধরপাকড়। বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। নজিরবিহীনভাবে ঢাকা শহরের আবাসিক এবং খাবার হোটেল মালিকদের প্রশাসনের সহায়তায় বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাউকে রুমভাড়া না দিতে, খাবার হোটেল বন্ধ রাখতে গোপন নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নদীপথ রেলপথ, সড়কপথ সবখানে ঢাকামুখী মানুষকে আসতে বাধা দেয়া হয়েছে। সরকারি দলের শ্রমিকেরা লাল কাপড় পরে লঞ্চে আসা, নৌকায় আসা সাধারণ মানুষদের পিটিয়েছে ইচ্ছেমতো। অন্যদিকে, খবরে দেখলাম, আরিচায় সরকারি দলের সমাবেশে আসা গাড়ি ছাড়া কোনো গাড়িকে ফেরিতে উঠতে দেয়া হয়নি। জরুরি প্রয়োজনে ঢাকামুখী হাজার হাজার মানুষকে পদ্মার ওপাড়ে আটকে রাখা হয়েছে। নারী-শিশুদের অবস্থা ছিল করুণ।

যাত্রীরা বলেছে, গাড়ির সামনে সরকারি দলের গুণ্ডারা লাঠি উঁচিয়ে বলেছে, ‘গাড়ি আগালে মুশকিল আছে’। মহাজোটের সমাবেশেও কর্মীরা এসেছিল লগি-বৈঠা নিয়ে। অথচ তার একদিন আগে বিরোধীদলের সমাবেশে পুলিশ ছিল অন্যরূপে।

বিরোধীদলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার দলীয় বাহিনীর মারমুখী অবস্থান দেখে বোঝা গেল না কে কাকে সাহায্য করল! আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ছাত্রলীগ পুলিশকে সাহায্য করেছে, নাকি বিরোধীদলকে দমনে প্রশাসন সরকারি দলকে সাহায্য করেছে।

পথে পথে বিরোধীদল ঠ্যাঙানোর পাশাপাশি বাকযুদ্ধেও কম যাননি সরকারি দলের নেতারা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম তার কোণঠাসা অবস্থান থেকে সরে এসে আবারো অশালীন বাকযুদ্ধ শুরু করেছেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, আন্দোলন সংগ্রাম কত প্রকার কি কি তা আওয়ামী লীগ জানে। মাঠে নামলে বিএনপি নাকি প্যান্ট খুলে পালাবে।

প্যান্ট খোলার মতো কাজে যাদের আসক্তি তাদের নেতৃত্বে দেশ কিভাবে এগিয়ে যাবে? অবশ্য এর আগে নাগরিক সমাজের প্যান্ট খোলায় পারদর্শিতা আমরা দেখেছি। টিএসসিতে ছাত্রলীগের শাহ আলমের কথা মনে আছে? হরতালের সময় অফিসগামী বাপের বয়েসী এক ভদ্রলোককে সবার সামনে উলঙ্গ করে ছেড়ে দিয়েছিল।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অশালীন কথাবার্তা নতুন না হলেও দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচির সঙ্গে নেতাদের চাল চলনও পাল্টাতে হয়। কিন্তু সে রকম কোনো ইঙ্গিত আমরা দেখছি না। বরং ‘খবর আছে’, ’লুলা বানানো’, ‘প্যান্ট খোলা’ টাইপের পাড়ার পাতি মাস্তানদের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা শোনা যাচ্ছে বড় বড় নেতা-নেত্রীদের মুখে।                                                     
অন্যদিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া লেখাপড়া জানেন না। এই কারণে তিনি চান না দেশের মানুষ শিক্ষিত হোক। তিনি মেট্রিকও পাস করতে পারেননি। শুধু অংকে আর উর্দুতে পাস করেছিলেন। সরকারি টাকায় দুই ছেলেকে পড়িয়েছেন। কিন্তু তারা কী পাস করেছে?’

যদি সংবিধানে এইট পাস করা কারোর রাজনীতি করার অধিকার না থাকে, তবে সেই অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন তিনি। আর যদি সবার রাজনীতি করার অধিকার থাকে, তবে জনগণ কোনো ডক্টরেট ডিগ্রিধারী কাউকে ভোট দেবে নাকি এইট পাস কাউকে ভোট দেবে সেটার বিবেচনার দায়িত্ব নিজে না নিয়ে, জনগণের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো। বারবার শ্রুতিদূষণ ঘটানোর কোনো মানে হয় না।

বিরোধীদলের সমাবেশে শত বাধা পেরিয়ে লাখো জনতার ঢল দেখে মনে করার কারণ নেই যে তারা বেশ জনদরদী। মূলত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতাই সমাবেশে মানুষকে টেনে আনতে সহায়তা করেছে। বিরোধীদলের দায়িত্ব এখন সেটাকে মূল্যায়ন করা। তবে জনগণ বিরোধী জোটের সমাবেশে গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ্য করেছে স্বাধীনতাবিরোধীদের শক্ত অবস্থান। এবারও জামায়াত-শিবির মঞ্চের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের নেতাদের মুক্তির দাবি সম্বলিত ফেস্টুন বহন করেছে। একটা স্বাধীন দেশে পরাজিত শক্তির আস্ফালন কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

ওদিকে সমাবেশ শান্তিপূর্ণ সম্পন্ন হওয়ায় সরকারিদলের কিছু কিছু নেতা বলছেন যে, ৪ দলীয় জোটের লোকেরা নাকি শত শত বোমা নিয়ে তৈরি ছিল। সরকারি প্রশাসন এবং বেসরকারি প্রশাসনের (দলীয় কর্মী) শ্যেন দৃষ্টির কারণে তারা একটা বোমাও ফাটাতে পারেনি। থুতু উপরের দিকে মারলে নিজের গায়ে এসেই লাগে। সরকারের এই কথা দ্বারা তাদের দুটো ব্যর্থতা তারা নিজেরাই স্বীকার করে নিলেন। প্রথমতঃ শত শত বোমা নিয়ে আসার তথ্য তাদের কাছে ছিল। কিন্তু সরকারি গোয়েন্দারা বোমা তৈরির সময়ে একবারও সেটা জানতে পারল না! দ্বিতীয়তঃ আচ্ছা! না হয় মানলাম, অতি সংগোপনে তারা বানিয়েছে। কিন্তু তথ্য থাকা সত্ত্বেও যখন বিরোধীদলের সন্ত্রাসীরা শত শত বোমা নিয়ে রাজধানীতে ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছিল, তখন কেন একজনকেও পাকড়াও করতে পারল না প্রশাসন? কেন? নাকি তারা অদক্ষ?

বিরোধীদলের সমাবেশ নিয়ে হারজিতের বাহাস শুনে একটা চুটকির কথা মনে পড়ল।

দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে এক সময়ে তাদের মাঝে একটা ব্যাপার নিয়ে তর্ক বেধে যায়। এক পর্যায়ে ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি। শেষমেষ কুস্তোকুস্তি। একজন অন্যজনের উপরে উঠে মাটিতে জোরসে ঠেসে ধরে বলে, কেমন মজা! আর আসবি?
নিচে যে বন্ধু সেও দমবার পাত্র নয়। নিচে পড়েছে তাতে কি! হারা তো যাবে না! সেও তখন চিৎকার করে বলে, উপরে উঠে ভাবছো অনেক কিছু করে ফেলেছো। কেমন লাগে সূর্যের তাপ? গা পুড়ছে বুঝি!

একটা কথা সত্য যে, বিরোধীদলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারি দলের মধ্যে একটা চাপা ভীতি কাজ করেছিল। তারা কি আশঙ্কা করেছিল যে, পরিস্থিতি মিসরের তাহরির স্কোয়ারের রূপ নেবে? মহাসমাবেশের বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই সমাবেশ বানচালের জন্য বোমাতত্ব, সন্ত্রাসতত্ব দিয়ে সরকারি দল নিজেরাই সারাদেশে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলেছিল। শুরু থেকেই বিরোধীদল বলছিল, এটা হবে বিশাল জমায়েত। শত বাধা পেরিয়ে সেদিন বিরোধীদলের জনসুনামিতে ভেসেছিল ঢাকা শহর।

কিন্তু তারপর? যে প্রত্যাশা নিয়ে বারবার জনগণ সুনামিতে রাজপথ ভাসিয়ে দেয়, নেতাদের কাছ থেকে তার প্রাপ্তিযোগ কতখানি? বাধ্য হয়েই বলতে হয়, নিষ্ফল প্রত্যাশার জনসুনামি। এখানে জনগণের প্রাপ্তিযোগ কেবলই শূন্য এবং কেবলই শূন্য!

চূড়ান্ত সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।