ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

২ ঘণ্টা ৪২ মিনিটের ভাষণ!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১২
২ ঘণ্টা ৪২ মিনিটের ভাষণ!

মঙ্গলবার জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল ক্রিকেটে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশ দলের প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠা। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত।

আর একই দিনে কিনা রেকর্ড সময় ধরে বক্তৃতার ঘটনা ঘটলো জাতীয় সংসদে! বিরোধীদলের নেতা খালেদা জিয়া দেশের সংসদীয় ইতিহাসের দীর্ঘতম ১ ঘন্টা ৫৩ মিনিট বক্তব্য রাখেন! সংসদ নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য রাখেন ৪৯ মিনিট সময় ধরে। সব মিলিয়ে দুই নেত্রী একদিনে ২ ঘন্টা ৪২ মিনিট বক্তব্য দিয়ে ফেলেছেন!

সংসদ চালাতে প্রতি মিনিটে কত খরচ হয়, এর একটি হিসাব মাঝে মাঝে পত্রিকায় ছাপা হয়। তা এই ২ ঘন্টা ২২ মিনিটের ভাষণে উভয় নেত্রীর কাছ থেকে কী নির্দেশনা পেয়েছে দেশের মানুষ? প্রশ্নটি যার যার নেত্রীকে করার মতো সাহসও দল দুটির এমপি অথবা নেতাদের নেই। কিন্তু মানুষের মনের প্রতিক্রিয়া তো থেমে নেই, অথবা থেমে থাকেও না! এসবের জবাবদিহি কোথাও না কোথাও করতে হয়, অথবা হবেই।

দুই নেত্রীর ভাষণের সময়সীমা হিসাব করতে গিয়ে আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার কথাটি মাথায় আসে। অনলাইনে খুঁজতে গিয়ে দেখি ঐতিহাসিক ভাষণটির দৈর্ঘ্য ছিল ২ মিনিটের সামান্য বেশি। বঙ্গবন্ধু’র ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষনের দৈর্ঘ ছিল ৩০ মিনিটের কম। কিন্তু আমাদের এই নেতা-নেত্রীরা যে দিবস-রজনীতে একের পর এক ভাষণ দিয়েই চলেছেন, এর কোনো একটির আলাদা বৈশিষ্ট্য কী দেশের মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিতে পেরেছে? না তারা নিজেরাই এগুলোর পরম্পরা মনে রাখতে পারেন? এদের ভাষণ যারা লিখে দেন, অথবা ইনারা ভাষনসমূহ দেবার আগে-পরে এসব নিয়ে তাদের কী কোনো ভাবনাই তৈরি হয় না?

খালেদা জিয়ার মঙ্গলবারের ‘ঐতিহাসিক বক্তৃতা’র পর আমরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের তরফে উপকৃত হবার মতো কিছু তথ্য অবশ্য পেয়েছি! যেমন, মঙ্গলবারের বক্তৃতায় তিনি তার প্রতিপক্ষ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ডও ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন! বেগম জিয়া সংসদনেত্রী থাকতে তখনকার বিরোধীদলের নেত্রী তথা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার সর্বোচ্চ ১ ঘন্টা ৩৫ মিনিট সময় ধরে বক্তৃতা দিয়েছেন। অতএব সে রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে খালেদা জিয়াই এখন ফার্স্ট! মঙ্গলবাল খালেদা জিয়ার ভাষণের সময় শেখ হাসিনা সংসদকক্ষে থাকায় তিনি মনের জমানো অনেক কথা প্রতিপক্ষের সামনাসামনি বলার জোশ পেয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনার বক্তৃতার সময় তিনি উঠে চলে যাওয়াতে প্রতিপক্ষকে জোশ বঞ্চিত করেছেন!

জার্নালিজম সহ নানা পড়াশুনায় প্রেজেন্টেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট। এতে বক্তব্যকে শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে নানান কৌশল শেখানো হয়। শ্রোতাকে তার বক্তৃতায় ধরে রাখা অথবা মোহবিষ্ট রাখা একজন বক্তা বা প্রেজেন্টারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে। এটি গ্রামের হাটের ক্যানভাসার থেকে শুরু করে রাজনীতিক সবার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। কারণ উভয়েই কথার শিল্পী। কথা বেচে খান। একজন বক্তা-প্রেজেন্টারের বক্তব্যে শ্রোতা কখন হাই তোলে, কখন তার ঘুম পায়, এসবও প্রেজেন্টেশন টেকনিক শিক্ষার ক্লাসে ভিডিওতে দেখানো হয়। হাসিনা-খালেদা এসব ভিডিও কখনও দেখেছেন কীনা জানি না। যাদের জানার বা শেখার আগ্রহ আছে-থাকে, তাদের এসব দেখার কথা। আর যারা জন্ম থেকেই জানেন অথবা যথেষ্ট জানেন, অথবা সবজান্তা তাদের এসব জানতে-দেখতে হয় না। জানার দেখার কথা বলাও অবান্তর। মঙ্গলবারের এসব বক্তব্যের প্রতিযোগিতায় স্পিকার আব্দুল হামিদ অসহায়্ত্ব প্রকাশ করে  বলেছেন, এত লম্বা সময় ধরে এক নাগাড়ে বসে থাকতে তার অসুবিধা হয়। কারণ তার বয়স হয়েছে। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র চলছে আল্লাহর ওয়াস্তে! এখানে বিরোধীদল নানা বাহানায় সংসদে যায় না। গেলেও নানা ছুঁতোয় বেরিয়ে যায়! খালেদা জিয়াও ৭৭ দিন পর দয়া করে সংসদে গেছেন। মঙ্গলবারের বক্তৃতা দেয়া হয়ে যাওয়াতে তিনি কী আর সংসদে ফিরে যাবেন? এমন বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা কম। গেলে ভালো। টাকাগুলো একটু হালাল করে খাওয়া হবে।

দেশের সংসদীয় ব্যবস্থা যেমন দুর্বল, সে কারণে স্পিকারও যেন দুর্বল! তা না হলে স্পীকার কেন তার আসনে বসে এমন অসহায়্ত্ব প্রকাশ করবেন? সংসদ কার্যপ্রণালী বিধি তো তারই হাতে। অস্ট্রেলিয়ায় কি্ছুদিন আগে স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। কারণ তার মনে হয়েছে, কার্যপ্রণালী বিধি অনুসারে তিনি সংসদ পরিচালনা করতে পারেন নি। মজার ব্যাপার, স্পিকার পদত্যাগ করার পর সরকারি দলের তরফে বিরোধীদলের একজন সিনিয়র সদস্যকে স্পিকার পদে মনোনয়ন দেয়া হয়। বিরোধীদল বিষয়টি এড়াতে সরকারি দলের একাধিক সদস্যের নাম প্রস্তাব করে। কিন্তু দলের সিদ্ধান্তের কারণে তারা কেউ স্পিকার হতে রাজি হননি। অতঃপর ভোটাভুটিতে সরকারিদল মনোনীত বিরোধীদলের ব্যক্তিই স্পীকার হয়ে যান। অস্ট্রেলিয়ার এবিসি টুয়েন্টিফোর অথবা স্কাইনিউজে সংসদ কার্যক্রমের লাইভ সম্প্রচার দেখলে যে কেউ ধারণা পাবেন সংসদ কি আর স্পিকার কি। সংসদনেত্রী, বিরোধীদলের নেতা দাঁড়ালেই স্পিকার যেমন তাদের ফ্লোর দেন, কিন্তু বক্তব্য বা প্রশ্নের জবাব টু দ্য পয়েন্ট না হলে তাদের তা মনে করিয়ে দেন। তা না শুনলে মাইক বন্ধ করে বসিয়ে দেন। সংসদনেতা বা বিরোধীদলের নেতা মানেই যে অনির্দিষ্ট সময় ধরে ম্যারাথন বক্তৃতা দেবেন, সে সুযোগ এদেশেও নেই। তাদের বক্তব্য ও প্রশ্নের উত্তর দেবারও নির্দিষ্ট সময়-সীমা আছে। জনগণ বা মিডিয়ার ধৈর্যচ্যুতি ঘটানোর একতরফা অধিকার কাউকে লিজ দেয়া হয়নি।

সর্বশেষ আমাদের রেহানা-পাপিয়ারা সংসদে যা করেছেন, অস্ট্রেলিয়ার এই স্পিকারের পাল্লায় পড়লে তাদের কিছু সময়ের জন্যে শুধু সংসদ কক্ষ থেকে বহিষ্কার না, আরও অনেক ঘটনা ঘটতে পারতো। স্পিকারের নির্দেশ মানতে দেরির কারণে এমনটা এদেশের সংসদে প্রায়শই ঘটে। সে কারণে বলা চলে, আমাদের দেশের এমপিদের মতো অস্ট্রেলিয়ার এমপিরা অত স্বাধীন না। কোনো এমপি-জনপ্রতিনিধি বা পাবলিক ফিগারকে একটু অন্যরকম পেলে এদের মিডিয়া তাদের কী রকম ফালা ফালা করে, কী রকম কার্টুন বানায় তা বাংলাদেশে বসে কল্পনাও করা কঠিন। এদেশে যেহেতু রাস্তাঘাটে মিছিল-মিটিং এসব হয় না, সেহেতু জনমত গঠন-ধংসের সবকিছু মিডিয়ার মাধ্যমেই হয়।

খালেদা জিয়ার ১ ঘন্টা ৫৩ মিনিটের ভাষনের ইতিবাচক দিক হলো, এটি তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষকে স্বস্তি দিন আর যা বলার সংসদেই বলুন। রাস্তার আন্দোলনেও থাকুন, কিন্তু সংসদ থেকে বেরিয়ে যাবেন না। জনগণ ভোটে যাকে এমপি বানায় সে সংসদে যাবে থাকবে। কাজেই বিরোধীদলের এমপি কখনো সরকারি দলের দয়ার বিষয় না যে, সরকারি দল কী বললো না বললো তার কারণে বা উসিলা করে সংসদ থেকে বেরিয়ে যাবেন—এটা কেমন কথা!
সরকারি দল অসংসদীয় আচরণ করলে তা মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণ দেখবে, জনগণ এর জবাব দেবে। সরকারিদল কী বললো না বললো আমরা সংসদ থেকে বেরিয়ে গেলাম, বেতনভাতা, বিদেশ ট্যুর সব নিলাম, আবার ৯০ দিনের মধ্যে একবার এসে বেতন-ভাতা ঠিক রেখে আবার বেরিয়ে গেলাম, এসবতো হালাল না।

বিএনপি সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেছে, বিএনপির নেতারা নিজেদের আওয়ামী লীগ নেতাদের চেয়ে একটু বেশি ধার্মিক মনে করেন। কিন্তু তারা যার যার সংসদীয় দায়িত্ব পালন না করে হারাম খাবেন কেন? সেই ১৯৯১ সাল থেকে দেশের মানুষ দেখছে এখানে বিরোধীদল সংসদে থাকে না, যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা অজুহাতে সংসদ থেকে বেরিয়ে যায়, অথচ বেতন-ভাতা সবই নেয়-খায়! এসব অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে থাকলে কিন্তু এ সংসদীয় ব্যবস্থা টিকবে না। এ ব্যবস্থা বিপদগ্রস্ত হলে কিন্তু কেউ যে নিরাপদ-ভালো থাকেন না, সে প্রমাণ নিকট অতীতে আছে। সবার মনে রাখা উচিত সংসদ, সংসদীয় ব্যবস্থা অথবা কোন ব্যবস্থা মানে যা খুশি স্বেচ্ছাচার না। স্বেচ্ছাচারের আরেক নাম কিন্তু নৈরাজ্য। সরকারি-বিরোধীদল সব পক্ষের এমপিদের ক্ষেত্রেই এমনটা প্রযোজ্য। অস্ট্রেলিয়ার সংসদের স্পিকারের মতো মঙ্গলবার স্পিকার আব্দুল হামিদ যদি খালেদা জিয়াকে এত সময় না দিতেন, তাহলে কী ঘটতো? খালেদা জিয়া এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে বেরিয়ে যেতেন? বা ৪৯ মিনিট ধরে সংসদনেত্রীও কী একটি মহাবক্তৃতা দিয়ে ফেলেছেন? স্পিকারকে জিম্মি করাও এসবও নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে। এরপরও বলি, ভালো করুন আর নৈরাজ্য করুন--যা কিছু করার জনগণের সামনে সংসদে দাঁড়িয়ে করুন। সব দেখেশুনে নিজের মতো করেই জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৬ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।