ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১, ০১ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কড়া নেড়ে স্বপ্ন বিদায়!

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩১ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১২
কড়া নেড়ে স্বপ্ন বিদায়!

ফাইনাল খেলার একদিন আগে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম, ‘স্বপ্নের সিঁড়ির মাত্র এক ধাপ বাকি’। অনেক স্বপ্নচারী মানুষের ‘লাইক’ ক্লিকে ভরে গিয়েছিল আমার স্ট্যাটাস।

তারপর ফাইনালে কি ঘটেছে, কেমন করে ঘটেছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ সেটা প্রত্যক্ষ করেছে ক্রিকেটবিশ্ব অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল, লড়াকু বাঙালির লড়াইগাথা মহাকাব্য। এই হার, হীরকখচিত অমূল্য হারের চেয়েও মহা দামি! কিন্তু আজ আমি খেলা নিয়ে কিছু লিখব না। মহাকাব্যের অমর রচয়িতাদের রচনা নিয়ে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও আমার নেই। খেলার ভিতরেও ঘটে যাওয়া কিছু খেলা, কিছু ঘটনা নিয়ে আমি কথা বলব। তার আগে শ্রদ্ধার সংগে আমাদের জাতীয় বীর, ক্রিকেটারদের উদ্দেশ্যে আরেকবার উচ্চারণ করতে চাই:

‘তোমাদের অভিনন্দন, হে জাতীয় বীর। ’

পাকিস্তানের সাথে প্রথম ম্যাচটা হারার পরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম ভারতের সংগে বাংলাদেশ কেমন করে সেটা দেখার জন্য। যাদের স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি কিংবা যারা আমার মতো দূর দেশে পড়ে রয়েছে, ইন্টারনেটের সুবাদে তারা কেউ এখন বিচ্ছিন্ন নয়। এবারই প্রথম সেটা উপলব্ধি করলাম। আমার মতো কেউ হয়তো অন লাইনে খেলা দেখেছে, কেউবা ঘরে বসে টিভিতে। কিন্তু অনেকেরই ছিল খেলার সাথে ফেসবুক খোলা। যেখানে, যখন, যেভাবে দরকার হয়েছে প্রাণ খুলে নিজের ভাব, প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে। পুরো বিশ্বটা মনে হয়েছিল বাংলাদেশিদের স্টেডিয়াম।

ক্রিকেটারদের দাপুটে খেলা যতোটা অবাক করেছে, আরো বেশি অবাক হলাম এখানেও ভারত পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে আমাদের কারো কারো দু’ভাগ হয়ে যাওয়া দেখে। কেউ পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতি দেখালেই বাকিরা চেপে ধরেছে। একইভাবে দেশ রেখে ভারতের পক্ষ নিয়েছিল যে দু একজন, তারাও সম্মিলিত আক্রমণের শিকার হয়েছিল। ভাল লেগেছে এই লড়াই। স্টেডিয়ামে যেমন তামিম সাকিবরা ব্যাটে বলে জবাব দিচ্ছিল, মাঠের বাইরেও কিছু বিচ্ছিন্ন লোকের দেশকে রেখে এই দৃষ্টিকটু সমর্থন, বাকিদের কথার চাবুকে জর্জরিত হচ্ছিল।

শুধু খেলার মাঠ কেন, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের পরাশক্তি কিংবা রোল মডেলই হোল পাশের ভারত নয়তো খানিকটা দূরের পাকিস্তান। এদের একজনের দেশের জনগণের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ জঙ্গলে বিষ্ঠা ত্যাগ করে এবং আরেকজন তো নিজেই জংলী (জংগী) বানায়। এরা যদি হয় আমাদের স্বপ্নের স্থান, যার কারণে আমরা নিজ দেশের সমর্থনও উঠিয়ে নিই, তাহলে আমাদের কারো কারো মানসিকতা কেমন না বললেও চলে। ভিন দেশের সাথে খেলায় আমরা ভারত, পাকিস্তান কেন মালদ্বীপকেও সমর্থন করতে পারি। কিন্তু নিজ দেশের সাথে খেলার সময়েও যদি আমরা বলি, শচীন একশো, এর অর্থ কি দাঁড়ায়। শচীনের একশো মানেইতো আমাদের বিপর্যয়। কেউ কেউ এর প্রতি উত্তরে বলেছে, খেলা নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক না!

রাজনীতি? এখানে রাজনীতি কোথায়? দেশকে সাপোর্ট করা রাজনীতি নয়, এটা দেশপ্রেম। আমি নিজেও শচীনভক্ত। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ওরা বা ওদের কেউ আমার দেশের চেয়ে বড়। আর কে বলেছে, খেলায় রাজনীতি নেই? যেখানে শক্তি, যেখানে ক্ষমতা, সেখানেই তো রাজনীতি। মনে পড়ে, ছোটবেলায় ফরিদপুরের মিশনপাড়ার সাথে আমাদের মৌসুমী ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা হতো। দুই দলের ১১ এবং ১১ মোট ২২ জন খেলোয়াড় বাইশটা কাচের গ্লাস কিনে ম্যাচ খেলতাম। যে দল জিততো পরবর্তী খেলায় না হারা পর্যন্ত তাদের ভাবটা ছিল ব্রাক্ষ্ণগোত্রীয়। খেলাও মানুষকে বা এলাকাকে জাতে ওঠায়। এটা কি রাজনীতি নয়? খেলা মূলতঃ নিজেই রাজনীতির সংগে মিশে আছে। উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞামতে, রাজনীতি হলো “social relations involving authority or power”. এবার তাহলে ভেবে দেখুন!!

মাঠে ক্রিকেটযুদ্ধ হলেও মাঠ পেরিয়ে বাইরে তখন চলছিল ভারত-পাকিস্তানের লড়াই। সেই লড়াইয়ে ভারত কিংবা পাকিস্তানের কোনো লোক নেই। বেগাড় খাটা কিছু বাঙালি, উভয় দলের হয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই বাঁধিয়েছে। স্টেডিয়াম, ব্লগ কিংবা ফেসবুক জুড়ে এই লড়াইয়ে আমিও জড়িয়ে গেলাম। আবার স্ট্যাটাসে লিখলাম ছন্দে ছন্দে আমার প্রতিক্রিয়া--ভাদা, পাদার কাব্য:

নাম শুনেছো দাদা? ভাদা, পাদা, বাদা?
ফেসবুক আর ব্লগে দেখি নামের এত্তো ধাঁধা। ।

ভারতীয় দালালেরা ভাদায় পরিচিত    
পাদায় আছে পাকী গন্ধ, নষ্টামী আর কতো!

ভাদা পাদায় ঠাসাঠাসি, ভীষণ গণ্ডগোল
লজ্জাতে তাই বাঙলা দালাল, বাদার মুখটা গোল। ।

দেশের স্বার্থ বামে রেখে, ভাদা, পাদার দল
দিনে রাতে দেশ বিক্রির, করতে থাকে ছল...। ।
    
সঙ্গে সঙ্গে দেখি অনেক লাইক এবং মন্তব্য। এরা সবাই বাদা, অর্থাৎ বাংলাদেশের দালাল। সহজ কথায় দেশকে ভালবাসে। ভাদা আর পাদার জম্পেস লড়াই দেখে চুপসে ছিল। আবারো পেলাম দারুণ একটা শিক্ষা। বাংলাদেশকে ভালবাসে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। শুধু দরকার পরিবেশটা তৈরি করে দেওয়া। সেই পরিবেশটা তৈরি করবে কে?

এই যে পানি, যার অভাবে আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে মরা মাঠ হয়ে যাচ্ছে, সেখানেও ভারতের পক্ষ নিয়ে কথা বলার লোকের অভাব নেই। অন্যদিকে, ভারতের কোনো ভাল কাজের প্রশংসা করলেও সেরেছে। যেন সে মহা দেশদ্রোহী। এর কারণ কিন্তু দেশপ্রেম নয়, পাকিস্তান প্রেম। কারণ পাকিস্তানের শত্রু ভারত, তাই ভারত আমাদেরও শত্রু। ভারতকে আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো বন্ধু মনে করি না। কিন্তু সেই যুক্তিটা একান্তভাবে আমার দেশের স্বার্থের সংগে যুক্ত, পাকিস্তানের সংগে নয়। ধর্মের ভিত্তিতে যারা পাকিস্তানকে বন্ধু মনে করতে চায় তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। ইসলাম মানে যেমন জামায়াত-শিবির নয়; ঠিক একই যুক্তিতে মুসলমান হলেই ভাই ভাই নয়। সমানভাবে এ কথাও সত্য যে, স্বাধীনতায় ভারতের আমাদের পক্ষাবলম্বন মানেই যে ভারত আমাদের বন্ধু হয়ে গেল সেটাও ঠিক নয়। আমি আগেও লিখেছি, সে সময় বাংলাদেশ ভারত কাছাকাছি আসার কারণটা ছিল ‘উইন-উইন সিচুয়েশন। ’

এটাতো গেল পাশের দুই দেশের প্রসঙ্গ। খেলার বাইরেও যেখানে একটা খেলা আছে। এটা ছাড়িয়েও সব বিষয়েই আমাদের বিভক্তি। সেই দূরের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে ফুটবলের বিশ্ব আসরের সময়ে পুরো দেশে যে বাড়াবাড়ি রকমের বাড়াবাড়ি চলে সেটা এক ধরণের আদিখ্যেতা। কাউকে সমর্থন করা আর কারো পক্ষে এক ধরনের অ্যাকটিভিষ্ট হওয়া দুই রকম কথা। নিজের দেশের বাইরে অন্য দেশের সমর্থনে এতোটা বিভাজন কিংবা মাতামাতি বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। দুই দলের সমর্থনে মিছিল হতে দেখেছি, মারামারিও কম হয়নি। আসলে এই বিভক্তিই আমাদের মধ্যে খেলা চলাকালীন কিছুটা হলেও ঐক্য নিয়ে আসে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার সমর্থকদের নিজেদের মধ্যে কি মাখামাখি, কি গলাগলি! অপূর্ব ঐক্য! কোথাকার কোন দেশের জন্য!
 
ক্রিকেটের এই রমরমা অবস্থা থেকে আরেকটা শিক্ষা আমি পেয়েছি। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে ফুটবল ছিল আমাদের দেশে সবচেয়ে প্রিয় খেলা। মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্সের খেলোযাড়দের নাম ছিল সবার মুখস্ত। আজ কি দশা ফুটবলের? ক্লাব ফুটবল তো দূরের কথা জাতীয় দলের খেলোয়াড়ের নাম ক’জন বলতে পারবে! কিন্তু ক্রিকেটারদের নাম? সবার ঠোঁটস্থ। এমনিতে হয়নি। পারফমেন্স বদলে দিয়েছে বাংলাদেশিদের পছন্দ। ক্রিকেটে অনেক অর্জন, তাই তারা সমর্থনও পেয়েছে দেশবাসীর। ফুটবল সময়ের সাথে আগাতে পারেনি বলেই দূরে সরে গিয়েছে। একটা সময় মনে হতো, অনেক কিছুই পাল্টাবে কিন্তু ফুটবলে মোহামেডান এবং আবাহনীর জনপ্রিয়তায় কখনো ভাটা পড়বে না। সেটা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

শুধু একটা ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন নেই বিধায় সেখানটাতে ইতিবাচক কোন পরিবর্তনও নেই। সেই জায়গাটা হচ্ছে রাজনীতি। আমাদের নেতারা যে কথায় কথায় ‘রাজপথ কাউকে ইজারা দেইনি’ বলে বাগাড়ম্বর করেন, কথাটা তারা মন্দ বলেন না। আমরা জনগণ পাঁচ বছর পরপর বড় দুই দলের একদলকে দেশটাকে ভোটের মাধ্যমে ইজারা দিয়ে দেই পরের পাঁচ বছর যা ইচ্ছা তা-ই করার জন্য। নেতারাও জনগণের দেওয়া ‘সময়বাঁধা গণতন্ত্রকে’ মেনে নিয়ে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেয়। ভাল না খেললে যে খেলা পাল্টে যেতে পারে, সে সিগন্যাল দলগুলো পায় না বিধায় তারাও তাদের রাজনীতির খেলায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনে না। জনগণও অসহায়। ফুটবলের বিপরীতে তো ভাল খেলা ক্রিকেট পেয়েছিল সমর্থনের জন্য। কিন্তু দুই দলের বিপরীতে আস্থা রাখা যায় এমন গণতান্ত্রিক শক্তি কোথায়?

তবে আমরা যে যতোই শিক্ষা পাই না কেন, সব থেকে বড় শিক্ষাটা দিয়েছে তামিম ইকবাল বিসিসিবির মহাক্ষমতাধর সভাপতি লোটাস কামালকে। পরপর চার খেলায় চার চারটা দুর্দান্ত অর্ধ শতক মেরে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে খেলায় রাজনীতি থাকলেও সবখানে সেটা খাটে না। খেলা শেষে তামিম যেভাবে চার আঙুল এক এক করে উঁচিয়ে দেখিয়েছে, মনে হলো সে চারটা অব্যর্থ শেল মেরেছে লোটাসের অনিয়মের বিরুদ্ধে।

ওলে ওলে ওলে
চার ফিফটি তামিম হাঁকায়
আনন্দে দেশ দোলে।

এবারের ক্রিকেটে আরেকটি বড় অর্জন ছিল দুই নেত্রীকে গ্যালারিতে টেনে আনা। দুই জনের সব বিষয়ে ভেদাভেদ থাকলেও খানিক সময়ের জন্য ক্রিকেট তাদের মাঝে একটা ঐক্য আনতে পেরেছিল। সেই ঐক্যের ক্ষেত্রটা ছিল ক্রিকেটকে ভালবাসা ।

খেলা শেষ হবার পরে ফেইসবুকের স্ট্যাটাসে লিখলাম;

“কড়া নেড়ে স্বপ্ন বিদায়। তবুও অভিনন্দন বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের। লড়াই করে হেরেছে। সাবাস! তোমাদের সাবাস!”

এবার একটাও লাইক পড়েনি। আমি অবাক হলাম বন্ধুদের ব্যবহারে। আমরা কি এতোটাই অকৃতজ্ঞ! ছেলেগুলো আপ্রাণ চেষ্টা করেছে দলকে জেতানোর জন্য। তারপরেও পারেনি। ওরাতো স্বপ্নপূরণ করতে পারেনি বলে কোটি মানুষের সামনে দুঃখে কেঁদেছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা তো কোটি মানুষের স্বপ্ন ভেংগে দিয়ে নিজেরা হাসে। তাদের তো মুহুর্তে ক্ষমা করে দিয়ে বানের পানির মতো সমানে ছুটে যাই জনসভায়। হায়রে জনগণ। সব সময় পেতে চাইলে চলবে না। ওদের হারাটা দেখলে, কমিটমেন্টটা দেখলে না।

সবাই কিন্তু হতাশ করেনি। কষ্টের ধকলটা কাটিয়ে উঠে যারা খেলার শেষের সাথে সাথেই অনেককে গালি দিয়ে স্ট্যাটাস লিখেছিল, কিছু পরে দেখলাম তাদের মুখেই প্রশংসা। ক্রিকেটারদের অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা।

আবারো ক্রিকেট আরো একটি বিষয় পরিস্কার করল, জাতি হিসেবে আমরা বীরদের সম্মানও দেখাতে পারি। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে প্রশংসা করার এই ছবক এবং আমাদের কৃতী ক্রিকেটারদের কাছ থেকে লড়াই করার মানসিকতার সাথে সাথে ব্যর্থতার গ্লানি মাথায় নিয়ে যেদিন আমাদের নেতানেত্রীরা কাঁদতে পারবেন, শুধু সেদিনই মনে করব, আমরা গর্ব করার আরেকটি মাইল ফলক পেরোলাম।

সেই স্বপ্নটা দরজায় কড়া নাড়বে কখন?
 
[email protected]
 
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।