ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এক চিমটি ‘র’, এক মুঠো ‘আইএসআই’

ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১২
এক চিমটি ‘র’, এক মুঠো ‘আইএসআই’

প্রবাস জীবনের এক দশক পূর্ণ করেছি গত বছরেই। এই দশ বছরের প্রতিটি মুহূর্তেই অনুভব করেছি বাংলাদেশকে কতটা ভালবাসি।

শত ব্যস্ততায়ও দেশের খবর রাখার চেষ্টা করি, অফিসের জরুরি কাজ ফেলেও মাঝেমধ্যে ইন্টারনেটে বাংলা সংবাদপত্রের পাতায় ডুবে থাকি। তারপরও দেশের ব্যাপারে মন্তব্য করার সময় খুব সতর্ক থাকি। বিশেষ করে আজকাল যখন দেশের কেউ কেউ রাখঢাক না রেখে বলেই ফেলেন, ‘বিদেশের মাটিতে আয়েশি জীবনযাপন করে বড় বড় কথা বলা সহজ’। হয়তো ব্যাপারটা সত্য। তবে দেশে থাকতেও যার রাজপথে কেটেছে যৌবন, মিছিলে শ্লোগানে উত্তোলিত ছিল যার হাত, তার ইতিহাস হয়ত এখন আর কারো মনে রাখার প্রয়োজন নেই। শূন্য কিংবা এক দশকের তোড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় আশি-নব্বইয়ের দশক। সব সময় তাই আমার প্রথম উপন্যাসের নামের মতই মনে হত ‘কাছে নেই দূরে তো আছি’, পরিবর্তে এখন অনেক বেশী মনে হয় সুহৃদ আকিদুল ইসলামের গ্রন্থের শিরোনাম ‘আমি এখন কোথাও নেই’।

এবারের স্বাধীনতার মাস মার্চের শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তাল। জামাত-বিএনপির মহাসমাবেশ, সেই সমাবেশে স্বাধীনতার মাসেই বেলুনের গায়ে কলঙ্কজনকভাবে গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদীদের মত ঘাতক-রাজাকার ‘যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চাই’ লিখে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া, সরকার সমর্থক ১৪-দলের পাল্টা মহাসমাবেশ করে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন এবং সুবিধাবাদী এরশাদের জাতীয় পাটির সেই সমাবেশে যোগ না দেওয়া, নিজেদের সদস্যপদ বজায় রাখতে কিংবা ‘গণতন্ত্র রক্ষায়’ বিরোধীদলের সংসদে যোগদান, সংসদে গিয়ে পাপিয়ার মত ‘অসভ্য’ সাংসদদের উচ্চারণের অযোগ্য অশালীন কথাবার্তা নিয়ে সরগরম রাজনীতির মাঠ। এর পাশাপাশি বোমা ফাটিয়েছে বিদেশি কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম। তারা জানিয়েছে গত ১৪ মার্চ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান আসাদ দুররানি পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টে প্রদত্ত হলফনামায় বলেছেন, ‘১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের আগে আইএসআই বিএনপিকে পাঁচ কোটি রুপি দিয়েছিল’। এই খবরে চরম বেকায়দায় পড়ে যায় বিএনপি। আওয়ামী লীগও যেন বিশাল মওকা পেয়ে যায় হাতে। আপাতত দিশেহারা বিএনপি পাল্টা অভিযোগ তোলে ১৯৯৬ এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়েছিল, যদিও বিএনপি তাদের এই দাবির স্বপক্ষে কোনরকম সুত্রের উল্লেখ করতে পারেনি ।
অবশেষে বিএনপিকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছে পাকিস্তানী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ২২ মার্চ তারা জানিয়েছে যে আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান আসাদ দুররানি বিএনপিকে অর্থ দিয়েছিলেন মর্মে পাকিস্তান আদালতে হলফনামায় স্বীকার করেছেন- বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে এমন যে খবর বেরিয়েছে তা ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর।

সরকারি প্রেসনোটের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নসাপেক্ষ হলেও পাকিস্তানের এই সরকারি প্রেসনোটে শুধু বিএনপি একাই নয়, আমরা অনেকেই স্বস্তি পেয়েছি। তবে যার ভাষ্য নিয়ে এত হৈচৈ সেই আসাদ দুররানি নিজে মিডিয়ায় মুখ খুলে ব্যাপারটা সম্পর্কে সম্যক ধারনা দিলে আমাদের আরো ভাল লাগত। আমরা দুররানির বিস্তারিত ব্যাখার অপেক্ষায় থাকলাম।

তবে পাকিস্তানী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোন বিবৃতি দিল কী না কিংবা দুররানী ব্যাপারটা খোলাসা করলেন কী না তার চেয়ে জরুরি হল কেন আমাদের রাজনীতিতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে প্রায়শই ‘র’ কিংবা ‘আইএসআইয়ের’ সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে? কেন আমরাই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ঘায়েল করতে ‘ভারত’ কিংবা ‘পাকিস্তানের’ দালাল বলে অভিহিত করি? আসলে এই অভিযোগের ভিত্তি কোথায়? একি কেবলি ভিত্তিহীন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, নাকি আদৌ এর কোন সত্যতা আছে?

আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্ম ও দীর্ঘ পথ পরিক্রমা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানসহ বিভিন্ন ঘটনায় আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের বন্ধুত্বের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে চোখ রাখলে দেখা যায় যে ভারত সেই পুরোনো সম্পর্কের বৃত্তে নিজেকে আটকে রাখেনি। বরং সব পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের স্বার্থকেই বড় করে দেখে। তিস্তা চুক্তি, টিপাইমুখ বাধ তার জ্বলন্ত প্রমান। তাছাড়া, ভারতের কাছে বাংলাদেশের বিশাল বাজারটা ধরে রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির চেয়ে কীভাবে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখা যায় তা নিয়েই ভারত অধিক মনোযোগী। নেহেরু, ইন্দিরার ভারতের সাথে মনমোহনের আজকের ভারতের আকাশ-পাতাল তফাৎ।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করার মিশন নিয়ে সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া জিয়াউর রহমানের দল বিএনপিকে বরাবরই পাকিস্তানপন্থী দল বলে মনে করা হয়। তাদের রাজনৈতিক দোসর জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে এই ধারনাটি আরো পোক্ত হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ বেশ পুরোনো। কিন্তু হাল আমলে নিজেদের অভ্যন্তরীণ নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তান নিজেই অস্থির। তারপরও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে পাকিস্তানের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এখন কেবল আমাদের নয়, পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদেরও দাবি। সেদিকেও তাদের কোন নজর আছে বলে মনে হয় না।

যাই হোক, নিজেদের স্বার্থ রক্ষায়ই ব্যস্ত ভারত-পাকিস্তান। তাহলে আমাদের রাজনীতিবিদরা কেন বাংলাদেশের স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবেন না? আমাদের প্রত্যাশা, তারাও নিশ্চয়ই দেশের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবেন। তারাও নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন যে পরস্পরকে ‘র’ কিংবা ‘আইএসআই’য়ের দালাল বলে কেবল নিজেদের নয়, তারা প্রকৃতপক্ষে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে, দেশের পনেরো কোটি মানুষকেই অসম্মানিত করেন।

ভারত কিংবা পাকিস্তানের নয়, আমরা চাই আমাদের সম্মানিত রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের দালাল হোক।

ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন: অস্ট্রেলিয়ায় স্বেচ্ছানির্বাসিত কবি ও চিকিৎসক।

বাংলাদেশ সময় ২০১৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।