ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সৈয়দ বংশীয় চোরদের ‘ক্ষমা’ বনাম শেয়ারবাজারে আস্থা

প্রণব মজুমদার, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১২

ফেইসবুক বন্ধু ফালগুনী রহমানের স্ট্যাটসে একটি ছবি। বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর ও ভাবনার।

রাজধানীর লালবাগে অনাহারী দুই সহোদরা। ক্ষুধার জ্বালায় কাতর। খেতে চেয়েছিলো ওরা। অপরদিকে লুটপাটকারী ক’টি হাস্যেজ্জ্বল এবং সমাজ শাসানো শাণিত মুখাবয়ব।
 
ক্ষুধা নিবারণ আর সাম্প্রতিককালের শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে অভিযুক্ত রাঘব বোয়ালদের নিয়ে একটি ক্যানভাসে পাশাপাশি দু’টি ছবি। ক্যাপশনে সমসাময়িককালে সত্য প্রকাশের এক নিগূঢ় বাস্তবতা এখানে স্পষ্ট। একটি ক্যাপশন- ‘ক্ষুধার জ্বালায় হতভাগ্য দু’ বোন একটু খাবার চুরি করেছিলো বীর বাঙালি তাই ওদের ক্ষমা করেনি। ’ অপর ছবিটি দেশের ৬ বিশিষ্ট শিল্পপতি ও শেয়ার ব্যবসায়ীর। এরা হলেন— সাএফর, আহমমোকা, মোআফা, এইচবিএমই, লুরবা এবং নূরা।

বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে সম্প্রতি প্রকাশিত শেয়ার কেলেংকারির তদন্ত প্রতিবেদন সংক্রান্ত খবরের পত্রিকা কাটিং এটি। পত্রিকার শিরোনাম অভিযোগের শীর্ষে যারা। নিচে ক্যাপশনে লেখা-‘এনারা বিশিষ্ট সৈয়দ বংশীয় চোর, হাজার কোটি টাকা চুরি করলেও বীর বাঙালি এদের নাগাল পায়নি। ’

কোলাজ ছবি দু’টি আমাদের কর্মময় জীবনের এক প্রতিবাদ। বিশেষ করে তাদের কাছে, যারা বুঝে বা না বুঝে দেশের শেয়ারবাজারে পুঁজি হারিয়ে নিঃম্ব আজ। এ প্রতিবাদের ভাষা তাদের স্বজনদের, যারা এখানে বিনিয়োগ হারিয়ে জীবন দিয়ে গেছেন। ফালগুনীর স্ট্যাটাসে ছবি দু’টি সম্পর্কে ৫ জন মন্তব্য করেছেন এবং ২৮ জন তা পচ্ছন্দ করেছেন। লেখার বিষয়টির সঙ্গে উল্লেখিত বিদ্রুপাত্মক এবং সংবেদনশীল হৃদয়স্পর্শী ঘটনাগুচ্ছের বেশ মিল রয়েছে।

আমরা যারা শ্রমজীবী মানুষ, দৈনিক কাজ না করলে আহার জোটে না; বিষয়গুলো নিয়ে তাদের শুধু চিন্তা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সমাধানের পথ জানা থাকলেও আমাদের সেই সময় কোথায়? গণপিটুনি খাওয়া ওই দু’ বোনের সঙ্গে পার্থক্য এটুকুই, ওদের উর্পাজন করার মেধা বা জ্ঞান নেই যা আমাদের আছে। আর হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী ‘সৈয়দ বংশীয় চোর’ নামের রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে রুটিরুজির সন্ধানে ব্যস্ত থাকা আমাদের তফাৎ-আমরা  চৌর্যবৃত্তির কৌশল জানি না। যে ‘মহাজ্ঞানের’ মহিমায় ওই ৬ জন ‘মহারথী’ সমাজে, রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্রের নানা কার্যক্রমে আজ গ্রহণীয় এবং পূজনীয় ‘ব্যক্তিত্ব’।
 
কেন দু’ বোন চুরি করে খেয়েছিলো? ওদের মা বাবা কি রোজগার করতে অক্ষম, নাকি ওরা অনাথ? সে জন্যই কি ওরা এ অন্যায় করেছিলো? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে না ফিরে বরং সহজলভ্য শাস্তি ওদের আমরা দিয়েছি। কিন্তু পুকুর চোরদের কিছুই আমরা করতে পারিনি। কেননা তাদের টিকির নাগাল আমরা পাই না। এসব রাঘব বোয়ালকে আশ্রয় দেয় সরকার এবং বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো। যাদের চাঁদা ও পৃষ্টপোষকতায় সরকারি এবং বড় দলগুলোর আয়ু উজ্জীবিত। বড় বড় অংকের আয়কর ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যান এসব রাঘব বোয়াল। অনেক সময় সে খবরও ধামাচাপা পড়ে যায় স্বার্থ আর সুবিধার কাছে বলি হয়ে। আর সরকারের করের সে বোঝা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মাধ্যমে সামলাতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে।
 
অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থান- জনগণের এ মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের। সংবিধানেও সে কথা বলা আছে। জনগণের নিরাপত্তা সেটা জীবন বা জীবিকার যেটাই হোক না কেন তা পালনের দায়িত্বও রাষ্ট্র বা সরকারের। আমাদের সরকার বা রাষ্ট্র কি সে দায়িত্ব পালন করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি হয় হ্যাঁ হয়, তাহলে খাবার চুরির দায়ে দু’ বোন পিয়া ও শুমিকে রাস্তার লোকদের হাতে মার খেতে হবে কেন? কেন শেয়ারবাজারকে গ্রামগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হলো? ২৭ লাখ বিও (বেনিফিসারি ওনার্স) হিসাবধারীর পুঁজিই বা হারাতে হলো কেন? ‘যারা’ শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর পুঁজি লুণ্ঠনকারী তাদের কেন বারবার ‘ক্ষমা’ করা হবে?
 
দেশের পুঁজিবাজারে আস্থার সংকটের কথা দীর্ঘ সময় ধরে বলা হচ্ছে। বাজারে আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকারতো আন্তরিক বলে হয় না। ’৯৬ সালের শেয়ার কেলেংকারির ঘটনায় অধ্যাপক আমীরুল ইসলাম চৌধুরী কমিটির প্রকাশ করা সেই তদন্ত প্রতিবেদনের বিচার আজও হয়নি। অভিযুক্তরা পুনর্বাসিত হয়েছেন। বিচারের বদলে ‘ক্ষমা’ পেয়ে পুঁজিবাজারের এই লুটপাটকারীরা বরং বীর বাঙালির মতো অস্ত্র ধরে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হত্যা করেছেন। কলঙ্কজনক সেই ঘটনার অভিযুক্ত একজন ছিলেন ঢাকার শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের (ডিএসই) সদ্য বিদায়ী সভাপতি। বর্তমান সভাপতিও সেই ঘটনার অভিযুক্ত ৪৫ জনের একজন। তিনি তৃতীয়বারের মতো ডিএসইর প্রধান। দেশে ’৯৬ এবং ২০১০ সালের শেয়ার কেলেংকারির ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অভিযুক্ত একজন সাম্প্রতিককালে যার ঋণ খেলাপীর বদনাম দূর হয়েছে তিনিতো খোদ প্রধানমন্ত্রীরই একজন উপদেষ্টা। এসব ‘সৈয়দ বংশীয় চোরদের’ পরিচালনায় শেয়ার বাজারসহ দেশের আর্থিক কার্যক্রম স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয় কিভাবে?

তাছাড়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা নিয়ে সরকারের মেলোড্রামার কি প্রয়োজন ছিলো? কমিটির প্রধান সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে অপ্রত্যাশিত এবং বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে কেন? কেন শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা রাজপথে থাকবেন? ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন নিয়ে এতো তালবাহানা কেন?
 
এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেই রয়েছে। সময় অনেক অতিবাহিত হয়েছে। কালক্ষেপন আর নয়। অপরাধীদের আদর না করে যোগ্য বিচারসহ তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে তাই বিশ্বাস বা আস্থা ফেরানো সম্ভব। আর তা না করা হলে প্রায় সাড়ে ৩ বছর বয়সের বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় পুণরায় আসা প্রায় অসম্ভব হবে। কেননা পুঁজি বাজার দেশের তৃণমূলে এখন বিস্তৃত। আর বিনিয়োগকারীদের বৃহৎ এই গোষ্ঠী দেশের বড় এক ভোট ব্যাংকও বটে।

লেখক : অর্থনীতি বিষয়ের সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় : ১৮২৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১২

সম্পাদনা : আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।