ঢাকা: বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক তৎপরতাকে সন্দেহের চোখে দেখছে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই কূটনীতিকরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব তৎপরতা শুরু করেছেন।
তবে, কূটনীতিকদের এ তৎপরাকে সরকার সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং এ ব্যাপারে শক্ত অস্থান অব্যাহত থাকবে। সেই সঙ্গে আগামীতে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানো হবে বলে সরকার ও আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে আসা প্রতিক্রিয়া থেকেও এটা স্পষ্ট হয়েছে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদুতদের কিছু তৎপরতা সরকারের নজরে এসেছে। এগুলো বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের চেষ্টা এবং সেটা আগামী নির্বাচনকে উপলক্ষ করেই করা হচ্ছে বলে সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। তাদের এ তৎপরতাকে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা ।
সূত্রগুলো আরও জানায়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য বন্ধু প্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলবে সরকার। কিন্তু নির্বাচন, রাজনীতিসহ কোনো আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিরা তাদের পরামর্শ বা মতামতকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নেবে না সরকার ও আওয়ামী লীগ। এ কারণে কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক তৎপরতায় মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আগামীতে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে বিদেশিরা কোনো হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে সরকার কূটনৈতিকভাবে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদুত পিটার হাস গত ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহীনবাগে বিএনপির নিখোঁজ নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোনের বাসায় যান। তিনি সেখান থেকে ফেরার সময় বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ‘মায়ের কান্না’ নামে একটি সংগঠনের সদস্যরা তাকে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে কথা উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা চলছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সেখানে যাওয়ার বিষয়টিকে সরকার স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্রদূতের সেখানে যাওয়ার বিষয়টি তারা জানতেন না।
রোববার (১৮ ডিসেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, উনি (পিটার হাস) সেখানে যাবেন সেটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জানার কথা ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানে না, আমরাও (স্বরাষ্ট্রমন্ত্র) জানি না। তবে সেখানে রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি ছিল না।
শাহীনবাগের ওই বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের যাওয়ার বিষয়ে সমালোচনা ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে সরকারের দিক থেকে। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আমি সবিনয়ে তাকে (মার্কিন রাষ্ট্রদুত) জিজ্ঞেস করি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিমাসে কতজন গুম হয় সেই চিত্রটা কিন্তু সিএনএনে আমরা দেখেছি। কতজন নারী ধর্ষিত হয় সেটাও আমরা দেখেছি। কতজন খুন হয় সেই চিত্রও আমরা দেখেছি। পিটার হাস সাহেব, আপনি বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বর... যদি দেখতাম আপনি বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গেছেন সেই চিত্রটা বেশি ভালো লাগতো। কিন্তু উনি চলে গেছেন সুমনের বাড়িতে।
এদিকে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলনে নেমেছে বিএনপি। সরকারের পদত্যাগ এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে দলটি।
তবে, আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন আদালতের রায়ে বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আর কোনো সুযোগ নেই। গত দুটি নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনও হবে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকার বহাল থাকা অবস্থায়ই। নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। এর বাইরে কোনো দাবি সরকার মেনে নেবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে অনুযায়ী নির্বাচনের আর এক বছর বাকি রয়েছে।
গত ৬ ডিসেম্বর ঢাকার ১৫টি বিদেশি মিশন যৌথ বিবৃতিতে মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া সম্প্রতি কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত নির্বাচন, আন্দোলন নিয়েও কথা বলেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বলে সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। তবে এই নির্বাচন নিযে বিদেশিদের কোনো পরামর্শ বা হস্তক্ষেপ সরকার মেনে নেবে না এটা সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা তাদের বক্তব্যের মধ্যেও স্পষ্ট করছেন।
গত ৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত অভ্যর্থনা উপকমিটির সভায় ওবায়দুল কাদের যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, কারো ফরমায়েশ, হস্তক্ষেপ শেখ হাসিনা শুনবেন না। তিনি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পান না। বন্ধুত্বটা নষ্ট করবেন না।
কূটনীতিকদের সম্প্রতিক তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বাংলানিউজকে বলেন, সামনে নির্বাচন, নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনীতিকরা বিভিন্ন তৎপরতা শুরু করেছে।
সভাপতিমণ্ডলীর সিনিয়র সদস্য মতিয়া চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাচন সামনে, কূটনীতিকরা অতীতেও এগুলো করেছে। তবে আওয়ামী লীগের শিকড় অনেক গভীরে। শিকড় গভীরে থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রে কিছু হয় না। তবে সাবধানতা অবলম্বন করা ভালো।
আর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গত ৫০ বছর যাবৎ ষড়যন্ত্র হচ্ছে। দেশের একটি গোষ্ঠী বিদেশিদের দিয়ে এই ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এই গোষ্ঠী বিদেশিদের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে পারেনি। এরপর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। আজকে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই অগ্রগতিকে থামিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। আগামী নির্বাচন যাতে ভণ্ডুল হয় সেই ষড়যন্ত্র চলছে। নির্বাচন ভণ্ডুল হলে অস্বাভাবিক সরকার আসবে। তবে এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরকার শক্ত অবস্থানে আছে। কোনো ষড়যন্ত্রকে সরকার ভয় করবে না।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০২২
এসকে/এমএমজেড