দোহা : শুক্র ও শনি, এ দুদিন কাতারে ছুটি। এ দুদিন কাতারের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশিরা এসে জড়ো হন ন্যাশনাল (রাজধানী শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত কেন্দ্র) এবং আশেপাশের এলাকায়।
এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন বাংলাদেশিরা। কেউ কেউ দেশের জায়গা জমির দাম আবার কেউ রাজনীতির হিসাব মেলাতে ব্যস্ত।
সপ্তাহখানেক ধরে কাতারে ধরপাকড় চলছে। অবশ্য সারা বছরজুড়েই কাতারে অবৈধ বিদেশিদেরকে ধরপাকড় করা হয়। সপ্তাহ দুয়েক আগে এ ন্যাশনাল থেকে ছদ্মবেশে এসে গোয়েন্দারা চারজন বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেছে। ‘আল ফাজআ’ অর্থাৎ কাতারের পুলিশবাহিনী হরদম এ ধরনের অভিযান চালায়।
আটক ওই বাংলাদেশিদের অপরাধ, এরা লুকিয়ে ফেরি করে পান বিক্রি করছিল (ভালো দামেই বিক্রি হয় এখানে পানের খিলি)। তাম্বুল রসে ঠোঁট রাঙিয়ে মনটাকে চাঙ্গা করে নেওয়ার সুযোগ প্রবাসী উপমহাদেশীরা তো বটেই, এমনকি স্থানীয়রাও সুযোগ পেলে তা হাতছাড়া করে না।
অপরদিকে, কাতারে পান বিক্রয় এবং প্রকাশ্যে পান খাওয়া অপরাধ (পান খেয়ে যত্রতত্র পানের পিক ফেলে দেয়াল-রাস্তা নষ্ট করা এর একটা কারণ)। তবে এ নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করেন না অনন্যোপায় বাংলাদেশিরা।
রাতের আঁধার নেমে এলেই নির্ধারিত অলিগলির কোণায় পলিথিনে পানের পোটলা পকেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বিক্রেতারা। এদের অধিকাংশের ভিসা অবৈধ। নির্ধারিত ক্রেতা বা খদ্দের এসে গাড়ির হর্ণ বাজালে নাম্বার প্লেট দেখে চিনে ফেলেন তারা। দামদর তো জানা আছেই দু’পক্ষের। কাজেই বাড়তি কথা বলে সময় ব্যয় নয়, এক হাতে বিক্রেতা রিয়াল আর ওদিকে অপর হাতে পোটলা বুঝে নেন ক্রেতা। দশ রিয়াল (২২০ টাকা) দিলে দশ-বার খিলি পান পাওয়া যায়। পোটলা বুঝে পেয়েই ভো দৌঁড়।
সৌদি আরব থেকে এখানে মূলত পানের আমদানি করা হয় লুকিয়ে, তাই দাম বেশি। কখনো কখনো বাংলাদেশ থেকে আসার সময় কেউ লুকিয়ে লাগেজে ভরে পান এনে এখানে বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে গোপন কার্যক্রম বলেই খরচা বেশি পড়ে যায় বিক্রেতাদের। কোথাও কোথাও শ্রমিকদের ক্যাম্পের ভেতরে ছোট কুঠুরিতে পান বিক্রি চলে গোপনে।
এভাবেই চলে অবৈধ পান কেনা-বেচা। তবে গত শুক্রবারের চিত্র ছিল ভিন্ন। অপরিচিত কারো সাথে কোনো কথা বলতে নারাজ পান বিক্রেতারা। এমনকি যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের নামটুকুও বলতে ইচ্ছুক নন। ‘আরে ভাই, আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি ওদেরকে চিনিও না, জানিও না। ’ মুখচেনা পান বিক্রেতাদের সবার মুখে একই কথা। ‘অপরিচিত আমি’ খোঁজ খবর নিচ্ছি দেখে আরও কয়েকজন এ দোকানে ও দোকানে গা ঢাকা দিল। দূর থেকে একজনকে পান বিক্রি করতে দেখার পর তার কাছে গিয়ে পান সর্ম্পকে জিজ্ঞেস করা মাত্র বেচারা ‘কই ভাই, না তো’ বলে সোজা সামনে দ্রুত হেঁটে পালালেন।
নাম বলতে নারাজ একজন বিক্রেতা জানালেন, এতদিন পান বিক্রেতা ধরার পর জরিমানা করে ছেড়ে দিত পুলিশ। এখন আর সেদিন নেই, ধরা পড়লেই ভিসা বাতিল, সাথে সাথে দেশে ফেরত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েকদিন জেলে রেখে দেশে ফেরত।
গত কয়েক মাসে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি এভাবে ধরা পড়েছেন পান বিক্রির ‘অপরাধে’। তবুও থেমে নেই পান-বাণিজ্য। বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলোর আশপাশের দেয়ালগুলোর নানা অংশ লাল হয়ে আছে পানের পিকের দাগ লেগে।
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের লোকজনের পানজনিত এ বিশৃঙ্খল আর কদাকার আচরণে অতিষ্ঠ কাতার কর্তৃপক্ষ।
সবশেষ জানা গেছে, ২০২২ সালের বিশ্বকাপকে সামনে রেখে আধুনিক কাতার গড়তে অঙ্গীকারাবদ্ধ কাতার সরকার আরও কঠিন আইন কার্যকর করবে এসব অপরাধ রোধে। সম্প্রতি কাতারের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
অর্থাৎ সমস্যার বোঝার ওপরে শাকের আঁটি পড়তে যাচ্ছে অসহায় পানওয়ালা বাংলাদেশিদের। তারা আসলে কেউ সত্যিকারার্তে চায় না এভাবে বিপদের মুখে অনিশ্চতয়তার এই পেশায় জড়াতে। প্রতিশ্রুত কাজ না পেয়ে, কিংবা বেতন না পেয়ে একান্ত নিরুপায় হয়েই ‘পানওয়ালা’ বনে যায় তারা। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় তারা জানে না। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কেউ কি জানেন?
বাংলাদেশ সময় : ১৭৪২ ঘণ্টা, ০৬ মে, ২০১২
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
[email protected]