ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

প্রবাসে বাংলাদেশ

ব্রিটেনের সাউথশিল্ডস-এ বাংলাদেশিদের কারি সাম্রাজ্য

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ, যুক্তরাজ্য থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৬ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১২
ব্রিটেনের সাউথশিল্ডস-এ বাংলাদেশিদের কারি সাম্রাজ্য

সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে একেবারে নর্থইস্ট অব ইংল্যান্ডের টাইন অ্যান্ড উইয়ার নদীর তীর ঘেঁষে ছোট্ট ছিমছাম গোছানো এক শহরের নাম সাউথশিল্ডস। ক্যাথারিণ কুকসন শহর বলে খ্যাত এই সাউথশিল্ডস মূলত নর্থটাইনসাইড বারা’র মধ্যে অবস্থিত।



একসময় এই শহর শিপিং ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিলো, আজও দুনিয়া জোড়া এর খ্যাতি। আইরিশ সমুদ্রের একেবারে টলমলে কালো-নীল এই দুই রঙ এর পানির এক অপুর্ব সমাহার দেখা যায় এখানে। সাউথশিল্ডস এর এক পাশ ঘেঁষে যে পথ চলে গেছে সান্ডারল্যান্ড, নিউক্যাসল হয়ে, গাড়ি দিয়ে সেই পথ অনুসরণ করে চলতে-চলতে আপনি এর মনোরম প্রকৃতিতে বিমুগ্ধ হবেনই।

ভিন দেশের এই শহরে ঢোকার পর আপনি নিজ থেকেই অনুভব করবেন, কোথায় যেন বেশ আপন আপন মনে হয়। কারণ শহরের প্রাণকেন্দ্র মার্কেট প্লেস থেকে পূর্ব-দক্ষিণে সোজা হেঁটে বিখ্যাত সুপার স্টোর আসডা-ওয়ালমার্ট পেরিয়ে আপনি গিয়ে পড়বেন একেবারেই চির আপন, চিরন্তন বাঙালির বসবাসে মুখরিত প্রাণ-চঞ্চল ওসেন রোড-এ।

এখানকার বিখ্যাত কারি ব্যবসার প্রাণকেন্দ্রে বাংলাদেশিদের একচ্ছত্র আধিপত্য। বলা যায় জায়গাটি বাংলাদেশি কারি ব্যবসায়ীদের স্বর্গরাজ্যে। দীর্ঘ-লম্বা এই ওসেন রোডের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত যে দিকে তাকাবেন, সেদিকে দেখবেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের নানা রঙ আর নানা বাহারি নামের সাইনবোর্ড। রং বেরঙের খাবারের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো, সারাক্ষণই খদ্দেরের আনাগোণায় মুখরিত থাকে।

বলা হয়ে থাকে, এই ওসেন রোড কখনো ঘুমায় না। সেই সকাল থেকে শেষ রাত অবধি, কোনটা আবার একেবারে ফজরের নামাজ অবধি খোলা থাকে- প্রতিটা রেস্তোরাঁই কাস্টমারদের উপস্থিতিতে সদা ব্যস্ত থাকে।

ওসেন রোড এর দুই পার্শ্বেই রয়েছে বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। একসময় যে দু’একটা অন্য দেশিদের খাবারের হোটেল ছিলো, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পদচারণা ও দাপটে তারাও সেখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে কিংবা বাংলাদেশিদের কাছে বিক্রি করে চলে গেছে। এখানে সারা দিন-রাত ব্যবসা চলতে থাকে, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর আলো ঝলমলে রাতের বেলা ব্যবসার প্রসার বাড়তে থেকে মধ্যরাত অবধি।

ওসেন রোড এর নৈশ জীবন খুব ঝলমলে। নানা বর্ণের মানুষ, নানা ধর্মের ছেলে-মেয়েরা এখানে রাতের বেলা নাইট-লাইফ উপভোগ করতে জড়ো হয়ে থাকে। ইদানিং এই এলাকায় সব কিছু ছাড়িয়ে বিদেশিদেরকে যে বিষয়টি সবচাইতে বেশি আকর্ষণ করে তা হলো বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত রেস্টুরেন্ট এর খাবার। কারণ রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকারী বাংলাদেশিদের খাবারের মান খুব উন্নত, এর বিপরীতে দামও তুলনামূলকভাবে সবার নাগালের মধ্যে। আর বাংলাদেশিদের সেবার মান তো আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।

ওসেন রোডে কম করে হলেও শতাধিক বাংলাদেশির নতুন ও পুরনো রেস্টুরেন্ট রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, একবার যে ওসেন রোডে ‘পাত্তি গেড়েছে’, তাকে আর পেছনে ফিরে তকাতে হয়নি।

এই ওসেন রোডে বাংলাদেশিদের প্রাচীনতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যে আছে মাস্টার সাহেবের স্টার অব ইন্ডিয়া, আনোয়ার মিয়া, সানু(মরহুম)মিয়া ভ্রার্তৃদ্বয়ের আশা বালতি হাউস, মমতাজ রেস্টুরেন্ট, মাহতাব মিয়ার(শুরুতে) ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি। একইভাবে রয়েছে আজকের প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে ভিন দেশের এই শহরে এসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বাংলাদেশিদের সুনামকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এ প্রজন্মের মধ্যে রয়েছে- ক্যাফে ইন্ডিয়া গ্রুপ অব কোম্পানিজ এর নূর আহমদ কিনু মিয়া ও মুফতি বোরহান উদ্দীনসহ আরো অনেকেই।

মাত্র কিছুদিন আগেও এই দুই ব্যবসায়িক পার্টনার অন্যের রেস্টুরেন্ট এ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কাজের প্রতি একাগ্রতা, নিজেদের সততা, অধ্যবসায় আর পরিশ্রম তাদেরবকে এনে দিয়েছে স্বর্ণোজ্জ্বল সাফল্য। বর্তমানে নূর আহমদ অ্যান্ড পার্টনার টিম সাউথশিল্ডস এর মাটিতে বেশ কিছু বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার সাথে সাথে বাংলাদেশেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের সাথে ইনভেস্টমেন্ট করে চলেছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশের সকল জাতীয় দিবস উদযাপণসহ প্রাবাসীদের সকল কর্মর্কাণ্ডে সমানভাবে সক্রিয় থাকছে তারা। প্রবাসে বাংলাদেশ থেকে আগত নেতা-নেত্রীদের নিয়ে সভা-সমাবেশ ও সংবর্ধনা প্রদানেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তারা।

প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সংসদীয় আসনের একেবারে নিকটবর্তী হওয়াতে, একই সাথে ব্রিটেনের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড এর সংসদীয় আসন এই সাউথশিল্ডস হওয়াতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সাথে স্থানীয় লেবার দলীয় নেতাদের বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছে।

তবে এক্ষেত্রে সবার ওপরে বাংলাদেশিদের পরিবেশিত উন্নতমানের খাবার বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশিধের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড বেশ কয়েকবার নূর আহমদের ক্যাফে ইন্ডিয়াতে আগমণ করেই ক্ষান্ত হন নাই, তাদের খাবারে ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে মিলিব্যান্ড ক্যাফে ইন্ডিয়াতে কারি কুকিং এ অংশগ্রহণ করেন। এটি বাংলাদেশিদের প্রতি ব্রিটিশ রাজনীতিকদের  আগ্রহ আর গুরুত্বের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
 
ক্যাফে ইন্ডিয়ার নিজস্ব ওয়েব সাইটে www.cafeindia1.com ভিজিট করে যে কেউ সেই সব ক্লিপ অতি সহজেই দেখতে পাবেন, যাতে মিলিব্যান্ডের ওই কর্মকাণ্ডের  প্রমাণ রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন বাংলাদেশি ব্যাবসায়ীদের সাথে মিলিব্যান্ডের ওই আন্তরিকতা তখনকার ব্রিটিশ মিডিয়ায়ও বেশ আলোচিত হয়েছিল।

ওসেন রোডে বর্তমানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি আজকের বাংলাদেশি প্রজন্মকে নতুন নতুন ব্যবসা যেমন মোবাইল ফোন, ট্রাভেলস, গ্রোসারি ছাড়াও সমাজ সেবামূলক অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত হতে দেখা যাচ্ছে। আর এসব ক্ষেত্রে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার মতই সাফল্য দেখাতে শুরু করেছে তারা। অর্থাৎ বাঙালি তার ঝানু ব্যবসায়ী রূপটি অন্তত এই প্রবাসে সমুন্নত করে তুলে ধরেছে।

[email protected]

বাংলাদেশ সময় : ১৭৪৪ ঘণ্টা, ১০ মে, ২০১২

সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।