ঢাকা, শুক্রবার, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩১, ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০৩ সফর ১৪৪৬

খেলা

ফুটবলের জন্যই কলকাতা ছেড়েছিলেন আশরাফ

স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৩
ফুটবলের জন্যই কলকাতা ছেড়েছিলেন আশরাফ

ঢাকা: ১৯৪৬ সালে কলকাতায় জন্ম শেখ আশরাফ আলীর। সেখানেই ফুটবলে হাতেখড়ি।

১৯৬৫ সালে চলে আসেন ঢাকায়। এরপর থেকে তিনি ঢাকার ফুটবলার। খেলেছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে। বাংলাদেশ দলের নিয়মিত খেলোয়াড়ও ছিলেন। ফায়ার সার্ভিস, মোহামেডান, ইস্ট এন্ড ক্লাবের হয়ে খেলার পর ১৯৭২ সালে যোগ দিয়েছেন আবাহনী স্পোর্টিংয়ে। খেলোয়াড়ি জীবন শেষও করেন আবাহনীতে। বাংলানিউজকে দেওয়া শেখ আশরাফ আলীর একান্ত সাক্ষাৎকারের আকর্ষণীয় অংশ তুলে ধরা হলো।  

প্রশ্ন: পরিবারে খেলার চর্চা ছিল?

আশরাফ: আব্বা ক্রিকেট খেলতেন কালিঘাটে। ভারতীয় দলে খেলতে পারেননি, কিন্তু প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার ছিলেন। পাশাপাশি ফুটবল, সাঁতার এবং অ্যাথলেটিক্সেও ভালো ছিলেন। আমাদের পরিবারটাই খেলার সাথে জড়িত। আমার বোনরাও স্কুলে অ্যাথলেটিক্স করতো। সেই সূত্রে আমারও খেলোয়াড় হওয়া।

প্রশ্ন: ফুটবলে হাতেখড়ি কোথায়, কলকাতায় না ঢাকায়?Interview

আশরাফ: কলকাতায়ই আমার ফুটবলে হাতেখড়ি। চুনি গোস্বামী এবং ছন্দ রাজের খেলা দেখে মুগ্ধ হই। পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে পড়ার সময় ফুটবল শিখেছি। এখানে আসার আগে বেঙ্গলস স্কুল ফুটবল দলেও খেলেছি। ১৯৬০ সালে মোহনবাগান জুনিয়র দলের ফুটবলার ছিলাম।

প্রশ্ন: ঢাকায় এলেন কখন?

আশরাফ: ১৯৬৫ সালে কলকাতা থেকে যশোর আসি। গেন্ডারিয়াতে এরশাদ নামে আমার এক বন্ধু ছিল যে পার্ক সার্কাস স্কুলে পড়তো। সে-ই আমাকে যশোর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং খেলার ব্যবস্থা করে দেয়। এরশাদ আমাকে ফায়ার সার্ভিসে নিয়ে যায়। কোচ বজলু ভাই ট্রায়াল নেন এবং আমার খেলা পছন্দ করেন। ওই শুরু হয় ঢাকায় ফুটবল খেলা।

প্রশ্ন: স্বপরিবারে না একা এসেছিলেন?

আশরাফ: আমার বড় ভাই এখানে চাকরি করতেন। পেশায় তিনি প্রকৌশলী। আমরা দুই ভাই পূর্ব পাকিস্তানে ছিলাম। বাকি সবাই কলকাতাতেই থাকতেন। বাবা এখানে বেড়াতে আসতেন কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কলকাতায় ছিলেন, পুলিশে চাকরি করতেন। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় আব্বার আত্মীয়-স্বজন তিন’শ জনের মতো মারা গিয়েছিল। তাই আত্মীয়-স্বজন বলতে আব্বা এবং এক ফুপুর পরিবার।
 
প্রশ্ন: ঢাকায় খেলোয়াড়ি জীবন কেমন ছিল?

আশরাফ: এখানে তখন মাকরানি খেলোয়াড়দের রাজত্ব। তারওপর আমি জুনিয়র। আমাদের তখন চিন্তা ছিল কী করে তাদেরকে বিট করবো। একটা ঝোঁক ছিল বেশি বেশি প্র্যাকটিস করে স্কিল দিয়ে মাকরানি খেলোয়াড়দের পেছনে ফেলতে হবে। ফায়ার সার্ভিস থেকে ১৯৬৯ সালে মোহামেডানে যোগ দেই। এক বছর খেলে ৭০ সালে গেন্ডারিয়ার ইস্ট এন্ড ক্লাবে যাই। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে চলে যাই কলকাতায়। সেখানে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলার সুযোগ পাই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলাই আমার জীবনের সেরা অর্জন।

১৯৬৫ সালে ঢাকায় এলেও পূর্ব পাকিস্তানে খেলার সুযোগ হয়নি আশরাফের। ক্লাব ফুটবলের পাশাপাশি ঢাকা জেলা এবং বিভাগের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর যোগ দেন আবাহনীতে। জাতীয় দলের এই ফুটবলারের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে।

Interviewপ্রশ্ন: বাংলাদেশ দলে খেলেন কবে?

আশরাফ: ১৯৭২ সালে ঢাকা একাদশের হয়ে গৌহাটির বরদৌলী ট্রফিতে খেলতে যাই। ফিফার স্বীকৃতি না থাকায় ঢাকার হয়েই খেলতে হয় প্রথমদিকে। ১৯৭৩ সালে জাতীয় দলের হয়ে মালয়েশিয়ায় মারদেকা কাপে খেলি। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত টানা জাতীয় দলে ছিলাম। এরপর কোন একটা কারণে জাতীয় দলে খেলার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলি।

প্রশ্ন: আবাহনীতে এসেছিলেন কেন?

আশরাফ: দেশ স্বাধীন হলে ঢাকায় ফিরে আসি। শুনতে পাই শেখ কামাল আবাহনী দল বানাচ্ছে, সেখানে অনেক খেলোয়াড়ই যাচ্ছে। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম আবাহনীতে খেলার। কারণ শেখ কামাল ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। এসব কারণে আবাহনীতে আসি। আমাকে ওয়ান্ডারার্স থেকে টাকাও দিয়েছিল। সে টাকা ফেরত দিয়ে ক্লাবের অনুমতি নিয়ে আবাহনীতে আসি।

প্রশ্ন: শেখ কামালের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

আশরাফ: কামাল ভাই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন, তিনি ক্লাবে কম আসতেন। কিন্তু জামাল (শেখ জামাল) প্রতিদিন ক্লাবে আসতো। আমি তাকে তুমি করেই বলতাম। মঞ্জুরুল কাদের এবং জামালের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। এই দু’জনের সঙ্গে আমারও একটা সুসম্পর্ক ছিল। জামাল হোন্ডা চালাতো। আমার হোন্ডার খুব শখ ছিল। ১৯৭৩ সালে জামালকে একদিন বলি, খেলার টাকা দিতে হবে না আমাকে হোন্ডাটা দিয়ে দাও। ও বললো, আশরাফ ভাই হোন্ডা নিবেন? আমি বললাম হ্যাঁ হোন্ডা নিব। পরের দিন এসে হোন্ডা রেখে চাবি দিয়ে চলে যায়। বললো আশরাফ ভাই নেন আপনাকে হোন্ডা দিয়ে দিলাম। আমার মনে হয়েছে সে দুষ্টামি করছে। পরে তাকে বলি, হোন্ডা দিয়েছ এবার ব্লুবুক এবং কাগজপত্র আমার নামে করে দাও। তা নাহলে আমাকে রাস্তায় ধরবে। সেটাও সে করে দেয়। ৭৫ পরবর্তীতে হোন্ডাটা আমি ফুটবলার সার্জেন্ট রহিম ভাইয়ের কাছে রাখতে দিয়েছিলাম। তিনি সেটা আর ফেরত দেননি।

প্রশ্ন: ৭৫ পরবর্তীতে আবাহনীতে খেলা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?Interview

আশরাফ: একটা কথা না বললেই নয়, ’৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত আমরা মাঠে গেলেই দর্শকরা বিরোধীতা করতেন। ঢিল ছুঁড়ে মাথা পর্যন্ত ফাটিয়ে দিয়েছে। এর কারণ হলো বিভিন্ন ক্লাব থেকে খেলোয়াড় নিয়ে আবাহনী গড়ে উঠে। সেটা দর্শকরা মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু ৭৫ পরবর্তীতে মাঠে গিয়ে অবাক হই। হাতের এপিঠ ওপিঠ মনে হতে থাকে। ওই আবাহনী, সেই আগের দর্শকই স্টেডিয়ামে ছিল। মাঠে নামার সাথে সাথে দর্শকের তালি। বেশিরভাগই ওয়ান্ডারার্স গ্যালারি থেকে ঢিল ছোঁড়া হতো, সেই গ্যালারির দর্শকরা সবার আগে করতালি দিয়েছে। আসলে ৭৫ এ অমন একটা ঘটনার পরও যে আবাহনী টিকে রয়েছে এবং সেই খেলোয়াড়রাই খেলছে এটা দর্শকদের খুব আন্দোলিত করে। এরপর জনপ্রিয়তা তৈরি হয় আবাহনীর।
 
প্রশ্ন: খেলে কেমন টাকা পেতেন?

আশরাফ: ফুটবল খেলে টাকা উপার্জন করতে হবে সেটা কোন দিনই চিন্তা করিনি। ওই সময় যে টাকা দেওয়া হতো সেটাও অনেক ছিল আমাদের জন্য। ফায়ার সার্ভিস মাসে আড়াইশ টাকা বেতন দিতো এবং ৫০০-৭০০ টাকা দিত হাত খরচ। ৬৯ সালে মোহামেডান থেকে পেয়েছি দুই হাজার টাকা। ৭২ সালে আবাহনী থেকে পেয়েছিলাম সাত হাজার টাকা। ৭৬ সালে ১৫ হাজার টাকা করে পেয়েছি। সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছি আবাহনীতে।

প্রশ্ন: ভাড়ায় খেলতে যেতেন?

আশরাফ: বাংলাদেশের সব জায়গায় ভাড়ায় খেলতে গেছি। তবে বেশি পছন্দ ছিল ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা। কারণ ঢাকা থেকে এসব জায়গায় যাতায়াত সহজ ছিল।

প্রশ্ন: ঢাকা ছাড়া কোন জেলার মাঠে খেলতে ভালো লাগতো?

আশরাফ: ফরিদপুরের মাঠে খেলতে আমার খুব ভালো লগতো। ওখানে দর্শকরাও প্রাণভরে খেলা দেখতেন।

প্রশ্ন: সমসাময়িক কার খেলা ভালো লাগতো?

আশরাফ: গোলাম সারওয়ার টিপুর খেলা ভালো লাগতো আমার কাছে। তার খেলার স্টাইল সুন্দর ছিল। এছাড়াও জাকারিয়া পিন্টু ভাই, সালাউদ্দিন, এনায়েত, নান্নু, অমলেশ এবং পিন্টু ভাই’র খেলা ভালো লগতো। পিন্টু ভাই কোন দিন ফাউল করে খেলেননি।

Interviewপ্রশ্ন: আপনার দৃষ্টিতে কে বড় খেলোয়াড় সালাউদ্দিন না এনায়েত?

আশরাফ: এনিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। দু’জন তাদের পজিশনে ভালো খেলতেন। তবে সালাউদ্দিন ছিলেন স্টাইলিশ খেলোয়াড়। চেহারা, লম্বা চুল এবং দৌঁড়ের আর্ট দেখে মানুষ তার খেলা বেশি পছন্দ করতো।  

প্রশ্ন: বাংলাদেশের সেরা ডিফেন্ডার কাকে মনে করেন?

আশলাফ: এককথায় বললে মোমেন মুন্না। তার মতো এত সাহসী এবং সতর্ক ডিফেন্ডার আমি বাংলাদেশে দেখিনি।

প্রশ্ন: কোচিং পেশায় থাকলেন না কেন?

আশরাফ: আমি খেলোয়াড়দের সঙ্গে খুবই ফ্রি। কিন্তু শৃঙ্খলার ব্যাপারে খুব কঠিন ছিলাম। এখনকার খেলোয়াড়রা অন্যরকম, অফিসিয়ালদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে কোচের বিরুদ্ধে যায়। এসব দেখে কোচিং ছেড়ে দেই।

প্রশ্ন: এখন কী করেন?

আশরাফ: বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ছোট ভাই কাজী শাকিলের স্টিল মিল আছে টঙ্গীতে। এসএস স্টিল মিলের চেয়ারম্যান শাকিল আমাকে চাকরি দিয়েছে ২০০০ সালে। তার মতো ভালো মানুষ আমার জীবনে দেখিনি। আমাকে ভাইয়ের মতো সম্মান করে। সর্বাত্মক ভাবে সহযোগিতা করে আসছে। কাজী শাকিলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৩
এসএ/এএইচবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।