মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, বাংলাদেশের ভারোত্তোলনের এক নারী যোদ্ধার নাম। ২০১০ ভারোত্তোলনে যার ক্যারিয়ার শুরু হয়।
সেবার সোনার পদক জিতে নিজে তো কেঁদেছিলেন, পাশাপাশি পুরো জাতিকে আনন্দের কান্নায় ভাসিয়েছিলেন। ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে ১৪৯ কেজি তুলেছিলেন মাবিয়া।
এর মাঝে ২০১৫ সালে কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ সিনিয়র ও জুনিয়রে রৌপ্য পদক এবং যুব কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে সোনার পদক জিতে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন মাবিয়া। তবে মাবিয়ার এই সাফল্য কিন্তু নিজের প্রচেষ্টায় অর্জিত। অথচ দেশের সেরা এই ভারোত্তোলককে নিয়ে ফেডারেশনের কোনো চিন্তাই নেই। তাকে নিয়ে নেই দীর্ঘ মেয়াদী কোনো পরিকল্পনা।
বাংলানিউজের সঙ্গে নিজের ক্যারিয়ারে পাওয়া আর না পাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন মাবিয়া। জানিয়েছেন তিনি ভারোত্তোলনে যে দেশকে সম্মান এনে দিয়েছেন সেই অনুযায়ী প্রাপ্য সম্মান পাননি। খেলাধুলার এই জগতে তার আসাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলে তিনি মনে করেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে খেলাধুলার এই জগতে আসতে উৎসাহ দেবেন না। ক্যারিয়ারে এখন একটাই লক্ষ্য, নিজের সেরাটা দিয়ে শেষ করতে চান।
করোনার বিরতির পর আবারও অনুশীলনে ফিরেছেন মাবিয়া। দীর্ঘ এই বিরতির সময় বাসায় তেমন কোনো অনুশীলন করতে পারেননি। যার কারণে এই মুহূর্তে শারীরিকভাবে ফিট নন তিনি।
মাবিয়া বলেন, ‘আমি অনুমতির অপেক্ষায় ছিলাম কবে অনুশীলন শুরু হবে। মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম নিজের জায়গাটা ধরে রাখতে পারবো। এর বাইরে আমরা বাসায় কোনো অনুশীলন করতে পারিনি। প্রথম দিকে কিছুদিন ইয়োগা করেছিলাম এরপর আর করা হয়নি। বাসায় বসে এটা করা হয়নি। বাসায় কোনো ফিল্ড অনুশীলন করা হয়য়নি, যেন পুরো স্পোর্টস জগত থেকেই বাইরে ছিলাম। এখন অনুশীলনে ফিরে বুঝতে পারি যে বাসায় থাকার ফল। আমরা এখন ফিট না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ক্রীড়াবিদদের লম্বা সময় বিরতি দেওয়া ঠিক না। পরিস্থিতির কারণে এবার লম্বা সময় বিরতি দিতে হয়েছে। এর ফলে মানসিকভাবে একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে, প্রভাব ফেলেছে নানাভাবে। যাদের পারফরম্যান্স পিক ছিল তারা কিন্তু অনেক নিচে চলে এসেছে। এটা কিন্তু মানসিকভাবে প্রভাব ফেলেছে। সেই পিক ফর্মে যেতে হলে এখন অনেক কষ্ট করতে হবে। সামনের এক বছরেও সেই ফর্ম ফিরে পাওয়া কঠিন হবে। ’
দেশ সেরা ভারোত্তোলক মনে করেন, বর্তমানে এই পেশার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত তাদের নিয়ে কোনো ধরনের পরিকল্পনা নেই ফেডারেশনের। আর ফেডারেশনের সহযোগিতা না পেলে ভালো করা সম্ভব নয়। নিজের চেষ্টায় দুই একটা সাফল্য এলেও সামগ্রিক সাফল্য কাখনোই আসবে না বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি ফেডারেশনকে দোষও দেব না, আবার ফেডারেশনকে দোষ না দিয়েও থাকতে পারবো না। আমি মাবিয়া যখন একটা মেডেল উপহার দেই তখন ফেডারেশনের মাথা ব্যথা হয়, সরকারের মাথা ব্যথা থাকে। এরপর আমাকে নিয়ে আর মাথা ব্যথা কমে যায়। আমার ক্ষেত্রে এটা হয়েছে। যদি আমাকে নিয়ে সবার মাথা ব্যথা থাকতো...আমি আমাকে নিয়ে বলবো কারণ, আমি পারফরম্যান্স দেখিয়েছি অন্যরা হয়তো সেটা দেখাতে পারেনি। ’
‘আমাকে নিয়ে যদি পরিকল্পনা থাকতো, তবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকেই আমাকে নিয়ে পরিকল্পনা করতো। লকডাউনের সময়তো কোনো খবর ছিল না, এখন তো পরিকল্পনা নেওয়া কথা। আমি তো অলিম্পিক কোয়ালিফাইংয়ে খেলবো। আমাকে নিয়ে যখন ফেডারেশনের এতো দিন কোনো পরিকল্পনা ছিল না, আমি মনে করি না আর কোনো দায়িত্ব দেখানোর প্রয়োজন আছে। ’
ভারোত্তোলনের এই পেশায় আসাটা তার জীবনের সবচেয়ে ভুল বলে মনে করেন মাবিয়া। দেশের সেরা এই ভারোত্তোলকের কাছ থেকে এমন কথা শোনার পর আর কেউ এই পেশায় আসতে চাইবে কিনা সন্দেহ আছে। কতটা অবহেলিত হলে স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত একজন অ্যাথলেটের কাছ থেকে এমন মন্তব্য পাওয়া যায়। তিনি এতটই বিরক্ত যে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে আর চিন্তা করেন না। এই খেলার সঙ্গেই আর থাকতে চান না।
মাবিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা স্পোর্টস করে তাদের মতো বোকা আমি দেখিনি। আমি যদি জানতাম স্পোর্টস এমন একটা জায়গা, যেখানে তাদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হয় না। আগে যদি জানতাম আমি কখনো ১০ বছর এখানে কাটাতাম না, আমি অনেক আগেই চলে যেতাম। আমাকে যদি বলা হয় আপনি আপনার জীবনের কোন জিনিসটা এখন পরিবর্তন করবেন, আমি স্পোর্টসটা পরিবর্তন করে দেব। হ্যাঁ এখানে আসার পর আমি অনেক কিছু পেয়েছি, নাম পেয়েছি, খ্যাতি পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু আমি যে সম্মনাটা বাংলাদেশকে দিচ্ছি সেই সম্মান অনুযায়ী আমার সম্মানটা কম হয়ে যাচ্ছে। ’
‘পরপর দুইবার এসএ গেমসে গোল্ড মেডেল এনে দিতে পারেনি কেউ, আমি এনে দিয়েয়েছি। সব টুর্নামেন্টে আমি স্ট্যান্ডার্ট পারফরম্যান্স দিয়েছি। সরকার যদি আমকে পেট্রোনাইজ করতে না পারে সেটা আমার দোষ না। আমি তাদের বারবার বলেছি, আমি তাদের সাপোর্ট ছাড়াই এতোদূর এসেছি। ’
মাবিয়ার আক্ষেপ ফেডারেশনের কানে পৌঁছালেও হয়তো ফেডারেশনের কোনো ধরনের চিন্তা হবে না। এতদিন যেহেতু কোনো ধরনের পরিকল্পনা করেনি আর, করবে কিনা সন্দেহ। নিজের প্রচেষ্টার এতো দূর এসেছেন। প্রতিভা ছিল বলেই মাবিয়া কোনো ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু সবার জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। তাই এই পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করাটা যে কারো জন্যই সহজই বটে।
বাংলাদেশ সময়: ২১০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০
আরএআর/এমএমএস