ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

ত্রিপুরার প্রাচীন পিলাকে ময়নামতির প্রতিচ্ছায়া

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৬
ত্রিপুরার প্রাচীন পিলাকে ময়নামতির প্রতিচ্ছায়া ছবি- জাকারিয়া মন্ডল

পিলাক (ত্রিপুরা) থেকে ফিরে: বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে দক্ষিণ ত্রিপুরার বিস্ময়নগরী পিলাকে। ওখানকার সব নির্দশনের সঙ্গেই বাংলাদেশের পাহাড়পুর আর ময়নামতি সভ্যতার দারুণ মিল।

 খ্রিস্টিয় ৮ম শতক থেকে শুরু করে ১৩তম শতক পর্যন্ত বিকশিত এই সভ্যতার টেরাকোটা ফলকগুলোতে পাহাড়পুর-ময়নামতিতে পাওয়া টেরাকোটা ফলকেরই প্রতিচ্ছায়া।

প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের মতে, ত্রিপুরার এই বিস্তৃত সমভূমি প্রাচীনকালে পূর্ববঙ্গ ও সমতট শাসনকারী বেশ ক’টি রাজবংশের অধীনে ছিলো। তাদের কিছু ছিলো বৌদ্ধ, কিছু হিন্দু। অধিকাংশ শাসকের রাজধানী ছিলো এই এলাকার কাছাকাছি। প্রাচীন রাজ্য পেটিকারার রাজধানী ছিলো কুমিল্লায়। আর পিলাকের অবস্থান কুমিল্লা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।  

কার্যত প্রাচীন পেটিকারা রাজ্য চট্টলের পর পিলাক থেকে শুরু করে বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা, ময়নামতী হয়ে ফের ত্রিপুরার বক্সনগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।  

এই পিলাকের অবস্থান আগরতলা থেকে শত কিলোমিটার দূরে, ৪৪ নম্বর জাতীয় মহাসড়কে জুলাইবাড়ির পাশে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ষাট দশকের শেষের দিকে খনন কার্য চালায় এখানে। সে সময় অনেক ইট নির্মিত স্তূপ পাওয়া যায়। এরপর ওই এলাকায় মাটির নিচে চাপা পড়া সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন আবিষ্কারে আরো উদ্যোগ নেওয়া হয়।  

এখানকার শ্যামসুন্দর টিলা, দেব বাড়ি, ঠাকুরানির টিলা, বালির পাথর, বাসুদেব বাড়ি ও সাগর দেবা খুঁড়ে দেখা যায়, পাথর কেটে গড়া ভাস্কর্য ও টেরাকোটা ফলক ছড়িয়ে আছে এখানকার বিভিন্ন এলাকায়। এসব খনন স্থানে পাওয়া যায় পাথরে খোদাই করা অনেক ছবিও।

‌এসব ভাস্কর্য ও ছবির শিল্পরীতি বাংলার পাল ও গুপ্ত আমলের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বেশ। তবে আরাকান ও বার্মার সঙ্গে স্থানীয় শিল্পরীতির অভূতপুর্ব মিশেলও দেখা যায় এসব প্রত্নবস্তুতে।  
 
আগরতলা থেকে সাব্রুম রোডে জুলাইবাড়ি পর্যন্ত ভাড়া ৬০ রূপী। বিলোনিয়া মোড় থেকে জনপ্রতি ১০ রূপীতে পৌছে যাওয়া যাবে পিলাকে।
 
প্রথমেই হাতের ডানে রাস্তার ধারেই পড়বে গাছের শেকড়-বাকড়ের নিচে কোনো এক দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষ। এটা নিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও খনন এখনো বাকি।  
আর একটু এগুতেই হাতের বাঁয়ে শ্যামসুন্দর টিলা। মাটির স্তূপ খুঁড়ে বের করা হয়েছে বৌদ্ধ বিহারের অবিকল অবয়ব। মাঝের একটি গোল ঘরকে ঘিরে সেখানে অনেক ছোট ছোট কক্ষ। বহি:দেওয়ালে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা টেরাকোটায়। দু’টি বিশাল বপুর প্রস্তর মূর্তি এখনো রাখা হয়েছে এখানে।   
 
খুব সম্ভবত ৮ম ও ৯বম শতকে সভ্যতার বিকাশ ঘটে এখানে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে এখানে পাওয়া প্রত্নবস্তুগুলোতে শিব-সূর্য-বৈষ্ণবীর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের অভূতপূর্ব সহাবস্থান দেখা গেছে। যা থেকে ধারণা করা যায়, ধর্মী সম্প্রীতির বীজ অনেক গভীরে প্রোথিত ছিলো প্রাচীন ত্রিপুরায়।  

আর একটু এগুলে হাতের ডানে বাজারে পাশে ঠাকুরানি টিলা। খনন স্থলের মধ্যিখানে বিশাল এক পাকুড় গাছ। গাছ ঘিরে খননে আবিষ্কৃত ৮টি ছোট মন্দিরের ইষ্টক নির্মিত ভিত্তি ও প্রদক্ষিণ পথের কিছু অংশ।
 
এখানে একটি মন্দিরে স্ফটিক শিবলিঙ্গসহ বালি-পাথরের যোনীপিঠ পাওয়া গেছে-যা শৈব মন্দিরে পরিচয় বহন করে। এছাড়া সূর্য, গণেশ, শক্তি ও বিষ্ণুর মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। একটি বিশাল দণ্ডায়মান সূর্য মূর্তি পাওয়া গেছে-যেটাকে গঠন শৈলী অনুসারে ত্রয়োদশ শতাব্দীর বলে মনে করা হয়।  
 
এখানে পাওয়া অধিকাংশ প্রত্নবস্তু আগরতলায় উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হলেও সূর্য দেবতার মূর্তি এখনো এখানেই রাখা। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া দেখাশুনা করছে সাইটগুলো।  
আগরতলা থেকে ১শ’ কিলোমিটার হলেও উদয়পুর থেকে পিলাকের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটারের মতো। বাংলাদেশের রামগড় সীমান্তের দিক থেকে এলে এখানকার দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার মাত্র। আর দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার হেড কোয়ার্টার বিলোনিয়া এখ‍ান থেকে মাত্র ২১ কিলোমিটার পশ্চিমে।  
 
রাতিবাস করতে চাইলে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে জুলাইবাড়ি শহরে পিলাক ট্যুরিস্ট লজ আছে এখানে। জুলাইবাড়ি পেরিয়ে আগরতলার পথে শান্তিপুর থানা। ওই শান্তিপুর হয়ে বগাফা বনের ভেতর দিয়েই আসে আগরতলার গাড়ি। সব মিলিয়ে সময় লাগে ঘণ্টা চারেকের মতো।  

আরও পড়ুন

**কসবা ওখানে কমলাসাগর 
** ১০ টাকায় পুরা ত্রিপুরা! 
** রুদ্রসাগরের জলপ্রাসাদে
** গোবিন্দের ভুবনেশ্বরীতেই রবি ঠাকুরের রাজর্ষি বিসর্জন
** ত্রিপুরা সুন্দরীর কল্যাণ সাগরে বোষ্টমী ধুঁকছে (ভিডিও)
** আগরতলায় শতবর্ষী মসজিদ, প্রাসাদের আদলে স্টেশন
** রাজ প্রাসাদ যেখানে জাদুঘর
** মাণিক্য রাজ্যের নাম কি করে ত্রিপুরা
** আড়াইশ’ টাকায় আগরতলা, ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টা


বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৬, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।