ঢাকা, বুধবার, ১ কার্তিক ১৪৩১, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২ রবিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-১) 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৮
ব্ল্যাক ম্যাদোনার খোঁজে (পর্ব-১)  মন্সেরাতে পাহাড়, ছবি: সংগৃতীত

বার্সেলোনা বেড়াতে যাবো শুনে বন্ধু মানসীদি বললেন, ওখানে গেলে মন্সেরাত যেও। মন্সেরাতে পাহাড়ের ওপর হাজার বছরের পুরনো চার্চ আর ব্ল্যাক ম্যাদোনাকে দেখে এসো। তার হাত ধরে যা প্রার্থনা করবে তাই ফলবে।

শুনে আমার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেলো। পাহাড়ের উপর হাজার বছরের পুরনো চার্চ, তাতে ব্ল্যাক ম্যাদোনা, না জানি কত ইতিহাস আছে সে জায়গা ঘিরে! কী রোমাঞ্চকর! কী রোমাঞ্চকর!

ইন্টারনেট ঘেঁটে যা জানতে পারলাম, মন্সেরাত হলো এক পাহাড়শ্রেণী, বার্সেলোনার কাছেই অবস্থিত।

পাহাড়ের উচ্চতা ১২৩৬ মিটার, মানে প্রায় ৪ হাজার ফুট। তার ওপর প্রায় চূড়ার কাছে আছে একটি চার্চ, যাকে ব্যাসিলিকা বলে, সেটা একটি তীর্থস্থান। এটা সম্ভবত অষ্টম শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল। এর নাম সান্টা মারিয়া দে মন্সেরাত, স্প্যানিশ এই শব্দের বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় কুমারী মেরীর পবিত্র আবাসস্থল।

 ১২০৫ সালে বিশপ অবি ভিক ও অলিবা নামে মঙ্ক বা সন্ন্যাসীদের গুরু এখানে আশ্রম স্থাপন করেন। ছোট্ট সেই আশ্রমটি ক্রমে তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের মুখে ভার্জিন মেরীর অলৌকিক চমৎকারিত্বের কাহিনী চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৪০৯ সালে এই মঠটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়। এটি ১৯ শতকে নেপোলিয়ন বাহিনীর মাধ্যমে দু’বার পুড়েছিলো ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত এটি সংস্কারের জন্য বন্ধ ছিল, স্প্যানিশ সিভিল ওয়ার (১৯৩৬ -১৯৩৯) এর সময়ও এটি বন্ধ ছিল। স্পেনের সরকার এই তীর্থস্থানটিকে তখন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। আজও এখানে বহু মানুষের আগমন ঘটে, হাজার বছর পরও এই কুমারী মেরীর মন্দির তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।
হাজার বছরের পুরনো চার্চ, ছবি: সংগৃহীতবার্সেলোনা খুব সুন্দর একটি শহর। পাহাড়, সমুদ্র, উজ্জ্বল রোদ, সবুজ বন সব মিলিয়ে ভীষণ প্রাণবন্ত জায়গা। বার্সেলোনা এয়ারপোর্টে যখন নামলাম, তখন দূরের ঢেউ খেলানো পাহাড় দেখে মনটা চনমন করে উঠলো। সৌভাগ্যক্রমে এক বাঙালি ভদ্রলোকের হোটেল খুঁজে পেলাম, সেখানেই ওঠা হলো। বিদেশ বিঁভুইয়ে নিজের দেশের মানুষ পাওয়া গেলে কী যে আনন্দ হয়!

পরদিন সকালে উঠে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম মন্সেরাত যাওয়ার জন্য, সারাদিন সেখানে কাটাবো এই ছিল ইচ্ছে। কিন্তু হোটেলের মালিক উত্তম বাবু বললেন, এখন মন্সেরাতে গিয়ে কি করবেন? ওখানে সারাদিন কাটানোর কিছু নেই। বিকেলের দিকে যাবেন, আমি গাড়ি ভাড়া করে দেবো। বেশ আশাহত হলেও চুপ করে রইলাম।  

অতঃপর সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে কাটালাম। শহরে অনেক আকর্ষণীয় জিনিস দেখার থাকলেও মন পড়ে ছিল মন্সেরাতে। শেষে বিকেল তিনটার দিকে গাড়ি এলো। কী আনন্দ! ড্রাইভারও বাঙালি! উত্তম বাবু ড্রাইভারকে বুঝিয়ে বললেন কোথায় যেতে হবে। ক্রমে গাড়ি হাইওয়ে তে পড়লো। বার্সেলোনা বেশ উষ্ণ শহর, বছরের বেশিরভাগ সময় জুড়ে থাকে গ্রীষ্মকালের মতো গরম। মে মাসে সূর্য ডুবতে ডুবতে রাত্রি ন’টা।  

বেলা তিনটার কড়া রোদে চারপাশ তপ্ত হয়ে আছে। পাহাড়ি শহর বার্সেলোনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মনজুক নামে একটি পাহাড়, তার উপরে একটা পুরনো দুর্গ। হাইওয়ে ধরে গাড়ি চলতে লাগলো, কিছুক্ষণের মধ্যে শহর ছাড়িয়ে এলাম। নির্জন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভার বললেন, একটু জিরিয়ে নিই, পাহাড় বেয়ে অনেকখানি ওপরে উঠতে হবে গাড়ি নিয়ে।

গাড়ি থেকে নেমে এসে দাঁড়ালাম। ভীষণ সুন্দর জায়গাটি! বড় বড় কতগুলো পাথর ছড়িয়ে আছে সেখানে, ছোট বড় ঝোপঝাড় আর গাছপালায় ভরা। দূরে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত আকৃতির একসারি পাহাড়চূড়া। ড্রাইভার ভদ্রলোক বললেন ওটাই নাকি মন্সেরাতে পাহাড়। রাস্তা দিয়ে একটা দু’টো গাড়ি যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই সেখানে। একটি ছোট হরিণ আমাদের সামনে দিয়ে লাফিয়ে চলে গেলো। এতো সুন্দর জায়গাটিতে পিকনিক করা গেলে বেশ হতো।

এসব ভাবছিলাম, এমন সময় ড্রাইভার আমাদের ডাকলেন। আবার গাড়িতে গিয়ে বসতে হলো। গাড়ি পাহাড়ে উঠতে শুরু করলো। কখনও গাছপালা ঘেরা রাস্তা, কখনও শহরের মধ্য দিয়ে গাড়ি চললো। পাহাড়ের গায়ে প্যাঁচানো রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা ওপরে আসতে নিচে ছড়িয়ে থাকা রোদ ঝলমলে লোকালয় দেখা গেলো। মন্সেরাতে চারটি গ্রাম আছে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে গড়ে ওঠা এই পর্বতশ্রেণীর পাথরগুলো বহুকালের রোদ ঝড় জলের প্রভাবে লম্বা লম্বা স্তম্ভের আকার ধারণ করেছে। শুধু তাই নয়, এই পাথুরে স্তম্ভগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন প্রাণীর আকারের মিলও মানুষের কল্পনাবিলাসী মন খুঁজে পায়!

যাইহোক, দেখতে দেখতে গাড়ি পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উপরে চলে এলো। চূড়ার ঠিক নিচটাতে ব্যাসিলিকা অবস্থিত। একপাশে গাড়ি রাখার জায়গা, তারপর সিমেন্ট বাঁধানো লম্বা চাতাল। একপাশে দেখলাম কেবল কারের বেসক্যাম্প আর একটা রেলস্টেশন। বার্সেলোনা থেকে ট্রেনে করেও এখানে আসা যায়, আবার পাহাড়ের নিচ থেকে কেবলকারে করেও চূড়ার নিচের এই জায়গায় পৌঁছানো যায়।  

আমরা যখন সেখানে পৌঁছালাম তখন পড়ন্ত বিকেল। পর্যটকের ভিড় একেবারেই নেই। ব্যাসিলিকার সামনে একটা বিশাল উঠোন মতো জায়গা। একপাশে নিচে দেখা যাচ্ছে রোদ ঝলমলে উপত্যকা, আরেকপাশে পাহাড়ের পাথরের স্তম্ভগুলোর ওপর ছায়া ঘনিয়েছে। সেই বিকেলের ছায়ায় পাহাড়চূড়ার অদ্ভুত আকৃতির পাথরস্তম্ভগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন কতগুলো দীর্ঘদেহী মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।  

ব্যাসিলিকার দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, বিশাল একটা পাথুরে চাতাল, তার মাঝে বিরাট পদ্মফুল আঁকা, তিনদিকে ব্যাসিলিকার মূল দালান উঠে গেছে। মাঝখানের অংশটি ব্যাসিলিকা আর দু’পাশের দালানগুলো অফিস ও অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়। লোকজন নেই বললেই চলে, ব্যাসিলিকায় কর্মরত লোকজন শুধু চোখে পড়লো। ব্যাসিলিকার মূল অংশে ঢোকার দরজাটি বন্ধ। একপাশের বারান্দার প্রান্তে একটা ছোট দরজা খোলা দেখে সেদিকে এগোলাম।  

কিন্তু একজন পাদ্রী আমাদের বাধা দিয়ে বললেন যে, আজ আর ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না, পর্যটকদের জন্য সময় শেষ, কাল আসতে হবে। কী যে আশাহত হলাম তা বলার নয়। ভীষণ মন খারাপ হলো। অগত্যা কী আর করা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম চারপাশ।  

বারান্দা ধরে হাঁটছিলাম, এমন সময় আমার বর এক কোণায় একটা দরজা দেখিয়ে বললেন, ওই দরজা দিয়ে কি ভেতরে ঢোকা যাবে? চলো গিয়ে দেখি।
পাহাড়ি ঢালে বাড়ি, ছবি: সংগৃহীতঅন্ধকার দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে মন ভালো হয়ে গেলো; না, ব্যাসিলিকার ভেতরে ঢুকতে পারিনি, সেই জায়গাটা একটা বারান্দা মতো। ওপরে অর্ধেক ছাউনি দেওয়া। খোলা আকাশের আলো আসছে কিছুটা। একপাশে সারি সারি মোম জ্বলছে; কোনো শব্দ নেই, আমরা দু’জন ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই, সে এক অদ্ভুত নির্জনতা। শত শত মোমের আলোয় এক রহস্যময় পরিবেশ! আমরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ। সেই সময়টিতে কিছু বলার ছিলও না, সে ছিল শুধু অনুভব করবার সময়, নির্জনতা যেন মুখর হয়ে ছিল সেখানে, মোমের সলতে পোড়ার একটা আবছা শব্দ শুধু শোনা যাচ্ছিলো।  

আমাদের কর্মমুখর জীবন আর জীবনযাত্রার কলরব ছাপিয়ে সে নীরবতা বুঝি ধ্যানস্ত হয়ে ছিল, সময়ের সেই ধ্যান ভাঙার সাহস কোনো মানুষের থাকাই উচিত নয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ কিছু লোক কথা বলতে বলতে সেখানে আসায় সম্বিত ফিরে পেলাম। যন্ত্রচালিতের মতো বাইরে বেরিয়ে এলাম কিন্তু দু’জনের কেউই কোনো কথা বললাম না। গাড়ির কাছে আসতে ড্রাইভার কিছু বললেন কিন্তু কি বললেন ঠিকমতও কানেও ঢুকলো না।  

গাড়ি যখন পাহাড় বেয়ে নিচে নামছিলো, সূর্যাস্তের রঙিন আলো চোখে লাগলো, সবুজ উপত্যকা সোনালি করে দিয়ে সূর্য ডুবছিলো, কিন্তু আমি কিছুই দেখছিলাম না; মনটা আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো কিছুক্ষণ আগে দাঁড়িয়ে থাকা সেই জায়গাটির নির্জনতায়, চোখ বন্ধ করে সেই নীরবতার স্পর্শ শুধু অনুভব করতে লাগলাম।  

(চলবে…) 

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৮
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।