ছুটে আসছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। ডিজেপার্টির গান-বাজনায় মুখরিত হয়ে ওঠছে পুরো এলাকা।
কেউ কেউ পানির নিচে থাকা কংক্রিটের রাস্তায় নেমে সমুদ্র সৈকতের মতো সাঁতার কাটছেন। আবার কখনও উপভোগ করছেন সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য। এ আনন্দের সঙ্গে রয়েছে হরেক রকম জিনিসপত্রের দোকান। বিনোদনকে ঘিরে এলাকার শতশত মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। ঈদের দিন বিকেল থেকে শুরু করে সাত দিন পর্যন্ত চলছে একই রকম পরিস্থিতি। এ যেন এক সমুদ্র সৈকত।
নাটোর জেলা শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার উত্তরে নলডাঙ্গা উপজেলার এ হালতিবিল বর্ষা মৌসুম এলেই সমুদ্রের মতো রূপ ধারণ করে। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরে। ঢেউয়ের গর্জন শোনা যায় অনেক দূর থেকে। আর বিলের ভেতরের গ্রামগুলো দেখতে অনেকটা দ্বীপের মত মনে হয়। দেখলে মনে হবে গ্রামগুলো যেন পানিতে ভাসছে। এ যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য। এছাড়া বিলের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ডুবন্ত সড়কে পানিতে হেঁটে বেড়ানোসহ বিলের পানিতে সাঁতার কাটা ও নৌকা ভ্রমণ বাড়তি আনন্দ যোগ হয় দর্শনার্থীদের। এতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মত আমেজ উপভোগ করেন তারা। প্রায় তিন মাস এ আনন্দ উপভোগ করা যায় অনায়াসে।
তবে দর্শনার্থীদের ভিড়ের কারণে এ সময়ে বিলগ্রামের মানুষদের যাতায়াতের বিড়ম্বনাসহ নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এরপরও তাদের এলাকায় বিপুল দর্শনার্থীদের আগমনে এলাকাবাসী খুশি। তাই আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দিতে নিজেরাই স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এছাড়া পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তো রয়েছেই। এর সঙ্গে এ বছর যুক্ত হয়েছে প্রতিটি নৌকায় লাইফ জ্যাকেট।
অন্যদিকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ যাত্রী ছাউনি, টয়লেট থাকলেও নেই পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা। এমন অভিযোগ রয়েছে দর্শনার্থীদের। তাই পর্যটন সুবিধা পেতে হালতিবিলের এ এলাকাকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি করেছেন দর্শনার্থীসহ স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, বিশালায়তনের এ হালতিবিলে বর্ষার সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসে হাজার হাজার দর্শনার্থী। এজন্য এ বিল এখন ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে পরিচিত অনেকের কাছে। ঈদ কিংবা দুর্গাপূজা অথবা বিশেষ দিন ও ছুটির দিনে বিভিন্ন জেলা থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি ও শ্যালো গাড়ি নিয়ে বিল দেখতে আর আনন্দ উপভোগ করতে আসেন দর্শনাথীরা। তারা আরও জানান, এসব এলাকার মানুষের যাতায়াত সুবিধার জন্য ২০০৪ সালের দিকে পাটুলঘাট থেকে খাজুরাহাট পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার সাব মারসেবল সড়ক (ডুবন্ত সড়ক) নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ। পরে পর্যায়ক্রমে খোলাবাড়িয়া থেকে মাধনগর ও একডালা থেকে দীঘিরপাড়, খাজুরা থেকে চানপুর হয়ে করেরগ্রাম পর্যন্ত একই রকম ডুবন্ত সড়ক নির্মাণ করা হয়। যা বর্ষার সময় সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে থাকে।
আর শুষ্ক মৌসুমে সড়কগুলো দিয়ে সবধরনের যানবাহন চলাচল করে। মূলত এসব ডুবন্ত সড়ক নির্মাণের পর থেকে পাটুলঘাটে বিনোদনকেন্দ্র গড়ে ওঠে। আর বর্ষা মৌসুম এলেই প্রায় প্রতিদিনই ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে আসেন এ পাটুলঘাটে। প্রাকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন তারা। নির্মল আনন্দ উপভোগ করতে স্থানীয়রাও প্রায় প্রতিদিন আসেন এখানে।
তবে এবার বর্ষার শুরুতেই পানিতে ডুবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মৃত্যুতে স্থানীয় সুবিধাভোগীদের মধ্যে দেখা দেয় চরম হতাশা।
দর্শনার্থীদের মধ্যেও সৃষ্টি হয় ভীতিকর পরিস্থিতি। তবে জেলা প্রশাসন ওই মৃত্যুর ঘটনার পর এসব ভীতি কাটাতে এবং নিরাপত্তার জন্য হালতিবিলের নৌকা মাঝিদের মধ্যে লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করায় ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে অনেকটা ভীতি কেটে গেছে। বেড়াতে আসা পাবনার সোনিয়া, বড়াইগ্রামের তানজিলা, শহিদুল, দয়ারামপুরের হাফিজুল জানান, নৌকা ভ্রমণের প্রবল ইচ্ছে থাকলেও দর্শনার্থীদের চাপে নৌকা না পেয়ে পাটুলঘাটেই বসে থেকে ফিরে যেতে হয়েছে। তবে নৌকায় যেতে পারলে আরও আনন্দ পাওয়া যেত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মৌমিতা, সানজিদা, রাসেল মাহমুদ ও সুকুমার জানান, হালতিবিলের নৈর্সগিক সৌর্ন্দযে কক্সবাজারের আমেজ অনুভব করছেন তারা। প্রতিবছরই তারা এখানে সহপাঠিদের নিয়ে বেড়াতে আসেন। জায়গাটি বেশ আনন্দময়। সরকারি উদ্যোগে পর্যটন সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারলে খুব ভালো হয় বলে দাবি করেন তারা।
স্থানীয় নৌকার মাঝি শফির মণ্ডল, জেকের আলী ও সাফি জানান, এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। আর দর্শনার্থীদের চেয়ে নৌকার সংখ্যাও কম। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়েই নৌকা চালাতে হচ্ছে। প্রতিদিন নৌকা প্রতি ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা করে আয় হচ্ছে। এখানে প্রায় ২৫০টি নৌকা ভাড়া খাটছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আকতার হোসেন জানান, বিলের মধ্যে ডুবন্ত সড়ক নির্মাণের পর থেকেই এখানকার অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। এখানকার দিনমজুররা এখন বছরের অর্ধেক সময় চাষাবাদ এবং বাকি সময় নৌকা চালিয়ে ভালো মতই জীবন-যাপন করছেন। অনেকেই বিলের পাড়ে বিভিন্ন দোকান, কার-মোটরসাইকেল গ্যারেজ করে বাড়তি আয় করছেন।
পাপর, চটপটি ও বাদাম বিক্রেতা বদর উদ্দিন জানান, প্রতিদিন বেচা বিক্রি করে গড়ে এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা করে আয় হচ্ছে তাদের। এতে অভাব ঘুচে গেছে অনেকটা। পিপরুল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কলিমুদ্দিন জানান, এ স্থানে যাতে কোনো প্রকার অঘটন না ঘটে, সেজন্য গ্রাম পুলিশ রাখা হয়েছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরাও কাজ করছেন। ইউপির পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। নলডাঙ্গা থানা পুলিশও নিরাপত্তা দিচ্ছে।
নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাকিব আল রাব্বি বাংলানিউজকে জানান, পর্যটন সম্ভাবনাময় এ হালতিবিল এলাকায় অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল এ স্থানটি পরিদর্শন করে গেছে। আশা করি, ইতিবাচক একটা কিছু পাওয়া যাবে। এছাড়া জেলা পরিষদের পক্ষ থেকেও বেশকিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শাহরিয়াজ বাংলানিউজকে বলেন, হালতিবিলের পাটুলঘাট এলাকাকে পর্যটন সুবিধার আওতায় আনতে বেশকিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এবার দর্শনার্থীর নিরাপত্তায় লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করা হয়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ের সহযোগিতা প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
যেভাবে যাবেন
নাটোর শহরের মাদ্রাসামোড় থেকে দিঘাপতিয়া উত্তরা গণভবনের পাশ দিয়ে ঠাকুর লক্ষ্মীকোল-হাপানিয়া হয়ে পাটুলঘাট। দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন যানবাহনে যাওয়া যায়। অটোরিকশায় ২৫ টাকা, ইজিবাইকে ২০ টাকা ভাড়া। যা খাবেন
পাটুলঘাটে গড়ে ওঠা হোটেলে দেশীয় ছোট মাছ, বড় মাছ, মুরগি, গরুর মাংস, সাদা ভাত। দাম নাগালের ভেতরেই। এছাড়া মুখরোচক হরেক রকম খাবার সুবিধা।
অন্যান্য সুবিধা
গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে চারটি গ্যারেজ এবং টয়লেট সুবিধা। নৌকা ভাড়া রির্জাভ ঘণ্টায় ২০০-২৫০ টাকা। তবে দু’টি গ্রাম ঘুরে আসতে জনপ্রতি মাত্র ২০ টাকা। এতে একসঙ্গে ২৫ থেকে ৩০ জন ভ্রমণ করা যায়। নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি নৌকায় লাইফ জ্যাকেট, টিউব রয়েছে। তবে রাত্রি যাপন করতে হবে নাটোর শহরের বিভিন্ন হোটেলে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৯
আরবি/