পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার ধাক্কায় পর্যটন খাতে ইতোমধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে এই অবস্থা আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে আশঙ্কা তাদের।
ট্যুর অপারেটর অব বাংলাদেশ (টোয়াব) বলছে, বর্তমান এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আপাতত ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে সরকারকে দ্রুত টোয়াব সদস্যদের বিনা শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা দিতে হবে।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক তৈরি হয়। সংক্রমণ বাড়ার পর ধীরে ধীরে বিশ্বের পর্যটন খাতও অচল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দেশ অন-অ্যারাইভাল ভিসা স্থগিত করে দেয়। এই পরিস্থিতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশেও বিদেশি পর্যটক আসা বন্ধ হয়ে যায়।
তথ্যমতে, গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে অভ্যন্তরীণ পর্যটন খাত স্তিমিত হয়ে পড়ে। যা গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা হওয়ার পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। হোটেল-মোটেল সব বন্ধ এখন। প্লেন চলাচলও বন্ধ।
এতে আউটবাউন্ড, ইনবাউন্ড ও আভ্যন্তরীণ পর্যটনের শতভাগ বুকিং বাতিল হয়ে যায়। ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে পর্যটন খাত। এখন দিনে দিনে করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ায় জীবিকা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, এয়ারলাইন্স, পর্যটক পরিবহন, ক্রুজিং ও গাইডিং সংশ্লিষ্ট অন্তত ৪০ লাখ পেশাজীবী মানুষ।
ট্যুর অপারেটর অব বাংলাদেশ (টোয়াব) নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্যাকেজ-১ এর আওতায় ৩০ হাজার কোটি টাকা থেকে এই ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দিতে হবে।
পাশাপাশি পরবর্তীকালে মূলধন সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় দুই বছরের জন্য সহজ শর্তে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ঋণ দিতে হবে।
টোয়াব সভাপতি রাফেউজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ টোয়াব সদস্যদের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মচারীর বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া, ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য লোকসান সমন্বয় করার জন্য ঋণ চাই। এছাড়া মূলধন সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় পরবর্তী দুই বছরের জন্য সহজ শর্তে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার।
চলমান সংকট মোকাবিলা করে এ শিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যটন খাতের সামগ্রিক লোকসানের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব সম্পন্ন করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের কাছে আপৎকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি কয়েকটি সুপারিশও করেছে টোয়াব।
আপৎকালীন সুপারিশ:
১. সরকারের পক্ষ থেকে টোয়াব সদস্যদের আপৎকালীন আর্থিক সহায়তা দেওয়া।
২. প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ-১ এর অন্তর্ভুক্ত ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা রাখা হয়েছে। টোয়াব সদস্যদের এ প্যাকেজের আওতায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মচারীর বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া, ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য লোকসান সমন্বয় এবং মূলধন সংকট নিরসনে ওই প্যাকেজের আওতায় পরবর্তী দুই বছরের জন্য সহজ শর্তে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি ঋণের দ্রুত ব্যবস্থা করা।
৩. পর্যটনের এই কঠিন সময়ে আগামী তিন অর্থবছরের বাজেটে পর্যটন খাতের সুরক্ষা ও উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা।
৪. টোয়াবের সদস্যদের এআইটি এবং ট্রেড লাইসেন্স ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ফি, পস মেশিন ট্রানসেকশন ফি ও ইউলিটি বিল, টোয়াবের সহযোগী সদস্যদের, যাদের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট আছে, সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে আরোপিত ভ্যাট মওকুফ করা এবং যাদের চলমান ব্যাংক ঋণের কিস্তি আছে, সেগুলো পরিশোধ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত ও সুদ মওকুফ করা।
৫. সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রামণের এবং বিদেশিদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে টোয়াব সদস্যদের মাধ্যমে ট্যুর প্যাকেজ পরিচালনা করা।
৬. কক্সবাজার, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তরবঙ্গ, সিলেট, বরিশাল ও অন্যান্য অঞ্চলের পর্যটন সংশ্লিষ্ট স্বল্প আয়ের পেশাজীবীদের (স্থানীয় ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড, কমিউনিটি পর্যটন পরিবার, মাঝি, চালক ইত্যাদি) জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, জেলা প্রশাসন ও ট্যুরিস্ট পুলিশের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে আপৎকালীন আর্থিক অনুদান নিশ্চিত করা।
৭. টোয়াব সদস্যদের মধ্যে কেউ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে, তাদের পরিবারকে ন্যূনতম ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া।
৮. করোনা ভাইরাসের কারণে টোয়াবের বার্ষিক মেলা পিছিয়ে দেওয়ায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাই ভবিষ্যতে এই মেলা সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য আগামী তিন বছর মেলার নির্ধারিত বিআইসিসি ভেন্যু ভাড়া মওকুফ ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া।
স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ:
১. বাংলাদেশের সব আর্ন্তজাতিক ও আভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোতে ও অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ স্থানগুলোতে মিট অ্যান্ড গ্রিট বা ইনফরমেশন বুথ স্থাপনে টোয়াবকে অনুমতি দেওয়া এবং আর্থিক সহায়তা করা।
২. অন-অ্যারাইভাল ভিসার পাশাপাশি ই-ভিসা প্রবর্তন করা এবং অন-অ্যারাইভাল ভিসা ও ই-ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে টোয়ার সদস্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রত্যয়ণ ও ভ্রমণসূচি বাধ্যতামূলক করা।
৩. বাংলাদেশের পর্যটন পণ্য উন্নয়ন ও প্রসারে ইউএনডব্লিউটিও, ইউএনডিপি, আইএলও, এডিবি, জাইকা, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে অনুদান ও সহজ ঋণ আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৪. আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনের প্রচার, ব্র্যান্ডিং ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন এবং এ কার্যক্রমে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও পর্যটন করপোরেশনের পাশাপাশি টোয়াবকে সম্পৃক্ত করা। এছাড়াও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সব ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনে টোয়াবকে সম্পৃক্ত করা।
৫. টোয়াবের সহযোগী সদস্যদের, যাদের হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট আছে, সেগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট ক্রয়ে ট্যাক্স ফ্রি সুযোগ দেওয়া।
৬. স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা যেন উপকৃত হন, সেজন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে পরবর্তী এক বছরের জন্য বিদেশি অনলাইন বুকিং ইঞ্জিন (booking.com, agoda.com, expedia.com, makemytrip.com etc.) ও পর্যটন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও লেনদেন প্রক্রিয়ায় ক্রেডিট ব্যবহার সীমিত করে টোয়াব সদস্যদের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে নিশ্চিত করা।
৭. বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে টোয়াবের সদস্যদের জন্য পস মেশিন ও ইএমআই সুবিধা প্রণয়নের ব্যবস্থা করা।
৮. ‘ট্রাভেল উইথ ট্যুর অপারেটর’ শীর্ষক সামাজিক প্রচার কর্মসূচি পরিচালনা করা, যেখানে বার্তা থাকবে, সর্বোচ্চ সেবার জন্য টোয়াব সদস্যদের প্রাধান্য দেওয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২০
টিএম/টিএ