ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটনের বিকাশ, আশীর্বাদ না অভিশাপ

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০২২
টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটনের বিকাশ, আশীর্বাদ না অভিশাপ

তাহিরপুর, (সুনামগঞ্জ) থেকে ফিরে: ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দেশের অন্যতম শীতল জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর।  দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের ওই হাওর বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ, আসতে শুরু করেছে বিদেশি পর্যটকরাও।



সম্ভাবনার বিশাল এই জলাধারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নৌ-পর্যটন। দেশের অন্যতম সুন্দর, বড় ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির ঠিকানা। পরিযায়ী পাখি আর দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য এ হাওর সুন্দরবনের পর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’।
 
আগে অল্প-বিস্তর মানুষের আনাগোনা হলেও গত এক দশকের মধ্যে এই হাওরে পর্যটন বিকশিত হয়েছে দ্রুতগতিতে এবং তা রুপ নিয়েছে বাণিজ্যিক আকারে। দেশের বিভিন্ন এলাকার তরুণরা হাওরের জলে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছেন, নামিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিনচালিত অভিজাত নৌকা। এসব নৌকায় পর্যটকরা আসছেন, থাকছেন এবং রাত যাপনও করছেন। নৌকায় রান্না হচ্ছে, হাওরের মাঝে হচ্ছে উচ্চ শব্দে গান বাজনা, শীতল জলে গা ভেজাচ্ছেন দর্শনার্থীরা।

পর্যটনের এমন অনিয়ন্ত্রিত আনাগোনা কি জীববৈচিত্র্যের আঁধার এ হাওয়ের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ এই আলোচনা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে । পর্যটন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের আনাগোনা বাংলাদেশের পর্যটনে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। অপরদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন হাওরে অনিয়ন্ত্রিত আনাগোনার কারণে বিশাল এই জলাভূমির জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে কমতে শুরু করেছে জলজ উদ্ভিদ, মাছ এবং পাখি। পর্যটকরা এসে হাওরে থাকছেন।

পায়খানা প্রস্রাব করছেন, প্লাস্টিক ফেলছেন হাওরের জলে, নৌকার তেল মিশছে হাওরের জলে। এর ফলে মারাত্মকভাবে পরিবেশের বিপর্যয় হচ্ছে।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন আশীর্বাদ:

টাঙ্গুয়ার হাওরের পর্যটনের শুরুটা কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। দেশীয় কিছু তরুণ পর্যটক নিজ উদ্যোগ হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নৌকা নিয়ে হাওরের বুকে ভেসে বেড়াত। তারপর আস্তে আস্তে এর ব্যাপকতা লাভ করতে শুরু করে। এখন তা বাণিজ্যিক আকার ধারণ করেছে। কয়েক হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা হয়ে উঠেছে খাতটি।

এ বিষয়ে কথা হয় ট্যুর গ্রুপ বিডির (টিজিবি) উদ্যোক্তা মো. ইমরানুল আলমের সঙ্গে।

তিনি জানান, বাংলাদেশ একটি পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা, তা বিগত ৫ বছরের সমৃদ্ধি খেয়াল করলেই মোটামুটি ধারনা পাওয়া যায়। এদেশের মানুষ চমক পছন্দ করে, নতুনত্ব পছন্দ করে। এরই ধারাবাহিকতায় হাওরে নৌকায় রাত্রিযাপন একটি নতুন চমক এদেশের পর্যটকদের জন্য। বিগত চার থেকে পাঁচ বছর ধরেই মানুষ ক্রমান্বয়ে এই চমক পরখ করে আসছে যা প্রতি বছরই বেড়েই চলেছে।

প্রথমে শুরু হলো সাধারণ যাত্রীবাহী নৌকায় কোনোভাবে রাত্রিযাপন, সেখানে মানুষের প্রচুর আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। তারপর নৌকায় এলো ভালো ওয়াশরুম, ফ্যান-লাইট, জেনারেটর। তারই ধারাবাহিকতায় আসলো নৌকার ভেতরে আরামে হাঁটাচলা করার ব্যাপারটা, সঙ্গে এলো নান্দনিকভাবে উপস্থাপন। সর্বশেষ নৌকার ভেতরে কেবিন, লবি, আইপিএসসহ রিসোর্ট সমমানের সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন হাউজ বোট। প্রতিটি ধাপেই মানুষের আগ্রহের মাত্রা বেড়েই চলেছে। ছুটির দিনগুলোতে নৌকা পাওয়াই দুষ্কর হয়ে যায়। এতে স্পষ্টতই বলা যায় হাওরের পর্যটন অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।

সাথে এও বলা উচিত যে হাওরের পর্যটন এর ওপর ভিত্তি করে পুরো সুনামগঞ্জ জেলা এবং আশেপাশের কিছু থানারও জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাড়ছে। এর কারণে ক্রমান্বয়ে মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ছে। এটিও সম্ভাবনার আরো একটি কারণ বলা যায়।

আরেক ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ন্যানেবেজ ট্রাভেলার্সের পরিচালক মো. রাফিউল হক বলেন, একদম ফিক্সড করে বলতে না পারলেও আনুমানিক বলতে পারি। টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢাকার মালিকের বোট আনুমানিক ৫০ থেকে ৬০ টা হবে। সুনামগঞ্জ এর স্থানীয়দের ও বোট সংখ্যাও প্রায় এর কাছাকাছি। সব মিলিয়ে ১২০ থেকে ১৫০ বোট চলে আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওরে।

প্রতিটা নৌকায় মাঝি, বাবুর্চি, গিয়ার ও কেয়ারটেকার এসব পোস্ট এ মিনিমাম চার জন করে স্টাফ থাকে। চার জন করে যদি প্রতি নৌকায় থাকে তাহলে ১৫০ নৌকায় ৬শ জন স্টাফ। এর মানে ৬শ পরিবার। ৬শ পরিবারে কয়েক হাজার মানুষ। এরা সবাই ওই খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
 
টাঙ্গুয়ার হাওরের তাহিরপুর এলাকার বাসিন্দা আজমান আলী বলেন, এখানকার মানুষ সারা বছর মুখিয়ে থাকে হাওরের পর্যটন মৌসুমের জন্য। মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য এটি এখন অনেক বড় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক গরিব-অসহায় মানুষের পেট চলে পর্যটন মৌসুমে কাজ করে।  

যা বলছে মৎস্য বিভাগ: 

পর্যটকদের এই অনিয়িন্ত্রিত আনাগোনাকে পরিবেশের জন্য হুমকি বলে মনে করছেন বিভাগ।

এ বিষয়ে কথা হয় সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মণ্ডলের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি অনেক সময় মাছের পেটের মধ্যে প্লাস্টিক পাওয়া যায়। এটি হচ্ছে পর্যটকদের অতিরিক্ত আনাগোনার কারণে। এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে হাওরের বায়োডাইভারসিটি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকার কারণে হাওরের পানিতে তেল পড়ছে। এটাও হাওরের পানির দূষিত করছে। এর ফলে অ্যাকুয়াটিক প্ল্যানও (জলজ উদ্ভিদ) ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  

এ মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, হাওরের প্রাণ বৈচিত্র‌্য রক্ষা করতে হলে হাওরে প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ করতে হবে এবং মাছের জন্য অভয়াশ্রম করতে হবে। যেখানে পর্যটকরা যেতে পারবে না এবং জেলরাও মাছ ধরতে পারবে না। এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীব-বৈচিত্র‌্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, বিশাল এই জলাধারকে বলা হয় দেশি মাছের আঁধার।

এক জরিপে দেখা যায় এ হাওরে আছে প্রায় ১৪১ প্রজাতির বেশি স্বাদু পানির মাছ। এছাড়াও হাওরে ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি ও ২১ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা ২৬ প্রজাতির বন্য প্রাণীর আবাসভূমিও ওই হাওর।  

পর্যটকদের শিক্ষিত ও সজাগ করে তুলতে হবে:

টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি। এছাড়াও শীতে হাওরে আসে অনেক ধরনের পরিযাযী পাখি। হাওরে পর্যকদের আনাগোনায় পাখির কোনো ক্ষতি হয় কিনা। এ বিষয়ে কথা হয় পাখি বিশেষজ্ঞ, আলোকচিত্রী, লেখক ও পর্যটক ইনাম আল হকের সঙ্গে।

তিনি জানান, ‘আমাদের পর্যটকরা যাচ্ছেন বর্ষার এই সময়ে। এ সময়ে পাখির অতটা সরাসরি সমস্যা হয় না। কারণ পাখি ওখানে তখন তেমনটা থাকে না। পাখি থাকে শীতে।  

বর্ষায় মানুষ পানি দেখতে যায়, শীতে পাখি দেখতে মানুষ কম যায়। তবে অনেক বেশি ইঞ্জিনবাহিত নৌকার কারণে পানি দূষিত হতে পারে। এটা সরকারের দেখা উচিত।

এই পাখি বিশেষজ্ঞ ও পর্যটক বলেন, পর্যটক এলেই যে খারাপ- এমন কথা মনে করার কোন কারণ নেই। বহু জায়গায় অনেক পর্যটকরাই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করেন। কারণ সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলে তা আর কিছু দেখার থাকেই না। অধিকাংশ পর্যটক সেটা বোঝে। না বুঝলেও সম্ভব। সুতরাং আমি মনে করি, আমি পর্যটনের বিপক্ষে নই-পর্যটনকে উৎসাহিত করতে হবে। পর্যটকদের সজাগ শিক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত করার দায়িত্ব সরকার, সুশীল সমাজ ও আমাদের। সেটুকু পালন করতে পারলেই ঠিক আছে আমার মনে হয়’।  

টনক নড়েছে প্রশাসনের: 

টাঙ্গুয়ার হাওর মূলত সুনামগঞ্জের ছোট-বড় প্রায় ১২০টি বিলের সমন্বয়ে গঠিত। তবে প্রধান বিল ৫৪টি এছাড়াও এ হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষা মৌসুমে সব খাল, বিল ও নালা মিলেমিশে একাকার হয়ে রূপ নেয় নীল জলের সমুদ্রে। জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১শ বর্গকিলোমিটার, যার দুই লাখ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টরই জলাভূমি। বিশাল এই সম্পদকে রক্ষা করার জন্য ইতোমধ্যেই টনক নড়েছে স্থানীয় প্রশাসনের।  

আমাদের সুনামগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট আশিকুর রহমান বলেন, সম্প্রতি রামসার কনভেনশনের আওতায় সংরক্ষিত এ হাওরে পর্যটক প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে ১২টি শর্ত দিয়েছে প্রশাসন।  বাধ্যতামূলক নিবন্ধনসহ ১২টি শর্ত না মানলে কোনো নৌযান পর্যটক নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রবেশ করতে পারবে না।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান কবির এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন।  বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা ১২টি শর্তের মধ্যে দুটি নৌযানের নিবন্ধন সংক্রান্ত এবং বাকি ১০টি পর্যটন পরিবহন ও পরিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। নিবন্ধিত নৌযানকে পর্যটন পরিবহনে যে ১০ শর্ত মানতে হবে। তা হলো:

১. নদী, হাওর, বিল, পুকুরের পানি ও উন্মুক্ত স্থানে কোনো ধরনের ময়লা, আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলা যাবে না।

২. নৌযানে অবস্থানকালে প্রতিটি নৌযানে সংরক্ষিত ঢাকনাযুক্ত বড় ডাস্টবিনে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে হবে এবং নিজ দায়িত্বে ময়লা-আবর্জনা নির্ধারিত স্থানে স্থানান্তর করতে হবে।
৩. নৌযানে লাউডস্পিকার, মাইক প্রভৃতিসহ উচ্চ শব্দ উৎপাদনকারী কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।
৪. লাইফ জ্যাকেটসহ যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া নৌযানে ভ্রমণ করা যাবে না। বিরূপ আবহাওয়ায় নৌযানে ভ্রমণ করা যাবে না।
৫. নৌযানে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা যাবে না।
৬. নৌযানে পর্যটকদের জন্য মানসম্মত পরিবেশ তথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. নৌযানে ভ্রমণের সময় কোনো ধরনের অসামাজিক কাজ কিংবা অনৈতিক কাজ কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায় এমন কাজ করা যাবে না।
৮. স্থানীয় এলাকাবাসীর ভাবাবেগ ও সামাজিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে
৯. অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না।
১০. নৌযানে চলাচলের সময় পর্যটকদের মালামাল রক্ষার বিষয়ে ও দুষ্কৃতকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট, স্থানীয়, পরিবেশ কর্মী ও মৎস্যবিদ সব পক্ষই বলছেন নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কথা। যারা হাওর দেখতে যাবেন তারা যদি হাওরের পরিবেশগত দিক মাথায় রেখে আচরণ করেন তাহলে দেশের ওই বিশাল সম্পদের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০২২
এসএইচডি/এএটি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।