ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

চায়ের দেশে দুইদিন

রফিকুল ইসলাম সাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৪
চায়ের দেশে দুইদিন

পৃথিবীর প্রাকৃতিক-সুন্দর রূপ কখনো নিজেই ধরা দেয় আমাদের কাছে, কখনো আবার দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাহাড়, চা-বাগান, নদী, ঝর্না সব মিলিয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট।

প্রকৃতির আদিম ও নিবিড় সানিধ্য অনুভব করার জন্য এখানে আছে বৈচিত্র্য ও আধুনিক সুন্দর জনপদ। আকাশভেদি পাহাড়, ছলছল ঝর্নাধারা বৈচিত্র্য সব দৃশ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায় রূপ কথার পাতায় পাতায়।

সকালে সিলেট কদমতলী বাস টার্মিনালে পৌঁছে বাস থেকে নামলাম। আম্মা, সালমা ও আমাকে বাস কাউন্টারের সামনে দাঁড় করিয়ে আব্বা গেলেন ঢাকা ফেরার ট্রেনের টিকেট আনতে।

কিচ্ছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই আব্বা ফিরলেন টিকিট নিয়ে। এবার আমরা রিকশায় উঠলাম। রিকশা চলছে। একটু পরেই দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল সুরমা ব্রিজ। একটু সামনে এগোতেই রিকশা পিছন থেকে ঠেলা দেওয়ার জন্য একজন এলেন। ব্রিজ খাড়া হওয়ায় রিকশা চালককে রিকশা ব্রিজের উপর তুলতে তিনি ঠেলা দিয়ে সহযোগিতা করলেন। রিকশাটিকে ঠেলে ব্রিজের মাঝামাঝিতে নিয়ে আসার পর তাকে পাঁচ টাকা দিতে হলো। টাকা নিয়েই সে দৌড় দিলো আরেকটি রিকশা ঠেলতে। এরকম আরো অনেক মানুষ ব্রিজের এপাশে-ওপাশে অপেক্ষা করে ঠেলা দেওয়ার জন্য। তাদের পেশা ঠেলা দেওয়া।

ছোট-বড় দালান দেখতে দেখতে হজরত শাহ জালাল (র.) এর মাজারের কাছে পৌঁছলাম। প্রথমে আমরা হোটেলে রুম ভাড়া করলাম। একসাথে দুই রুম। ভাড়া ৮০০ টাকা। রুমে ঢুকে ফ্যান লাইটের সুইচ টিপে বুঝতে পারলাম কারেন্ট নেই। ম্যানেজার জানালেন কারেন্টের লাইনে কাজ চলছে। আমাদের রুমে জেনারেটরের লাইন দিতেই লাইট জ্বলে আবার সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেলো। এবার জানলাম জেনারেটরের তেল শেষ। কি আর করা মোবাইলের টর্চ লাইটের আলো জ্বালিয়ে হাত মুখ ধুয়ে বের হলাম মাজার জিয়ারত করার উদ্দেশে।

হজরত শাহ জালাল (র.) এর মাজার গেইটের ভেতর প্রবেশ করার আগে সকালের নাস্তা করলাম। তারপর মাজার গেইটের ভেতর প্রবেশ করলাম। ডানদিকে বেড়া দিয়ে ঘেরা চারপাশ যার ভেতর জালালী কবুতর। তা দেখতে অসংখ্য দর্শনার্থীর ভীর। কেউ কেউ মানত করা কবুতর নিয়ে এসে এখানকার কবুতরগুলোর মাঝে উড়িয়ে দিচ্ছিল। আমরাও দাঁড়ালাম কয়েক মিনিট।

একটু সামনের দিকে এগিয়ে গজার মাছ দেখতে গেলাম। এখানেও কয়েক মিনিট দাঁড়ালাম। কেউ কেউ গজার মাছগুলোকে ছোট ছোট মাছ খেতে পানিতে ফেলছে। এই ছোট মাছ গুলো পুকুরের পাশেই একজন বিক্রি করে। আব্বা-আম্মা ও সালমা মাজার জিয়ারত করতে গেলেন। তারা ফিরে আসার পর এখান থেকে বের হলাম।

এবার গন্তব্য হজরত শাহ পরাণ (র.) এর মাজার। সিএনজি অটোরিকশায় উঠলাম। সিলেট জাতীয় ঈদগাহ ময়দান ও এমসি কলেজের পাশ ঘেষে যাওয়া রাস্তা হয়ে ছুটে চলল অটোরিকশা। প্রায় ত্রিশ মিনিট সময় লাগলো মাজার গেইটে পৌঁছতে। জনপ্রতি ত্রিশ টাকা করে চারজনে একশ'ত বিশ টাকা মিটিয়ে দিলাম চালককে। মাজার গেইটে অনেক বছর পুরনো বিশাল আকৃতির দু’টি বট গাছ ছায়ায় ঢেকে রেখেছে গোটা মাজার এলাকা। মাজার জিয়ারতের পর দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা ফিরে গেলাম হোটেলে।

সেদিন আর কোথাও গেলাম না, বিশ্রাম নিলাম। সন্ধ্যার আগে ইচ্ছে জাগে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার। হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে জানলাম পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখার মতো পরিবেশ এখানকার কোনো সিনেমা হলে নেই। সিনেমা আর দেখা হলো না।

পরদিন সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম জাফলংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ দেখতে। সিলেট শহর থেকে পাথরের তৈরি পিচ ঢালা রাস্তা সোজা চলে গেছে জাফলংয়ের দিকে। পথের দু'পাশের দৃশ্য দেখার মতো। পাহাড়ের বুকে ঝর্নার পানি গড়িয়ে পরার দৃশ্য। যাওয়ার পথে একটি ব্রিজ পার হয়ে নামলাম। হেঁটে আবার ব্রিজের উপর এসে দাঁড়াই। নদীর পাশেই চোখ জুড়ানো মন মাতাল করা ছোট বড় পাহাড়। আবার জাফলংয়ের পথে চললাম।

জাফলং যাওয়ার আগেই পথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেক লীলাক্ষেত্র তামাবিল জিরো কি. মি. দেখে সেখানে থামলাম। এখানে একপ্রান্তে বিজিবি’র চৌকি অন্যপ্রান্তে বিএসএফ’এর চৌকি। বাংলাদেশ-ভারতের দূরত্ব শূন্য কিলোমিটার। এপাশে বাংলাদেশ ওপাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্য।

এখানকার পাহাড়গুলো বেশ উঁচু উঁচু, যেন মেঘ ছুয়ে আছে। কোথাও কোথাও পাহাড় মেঘে ঢাকা পড়েছে। এপাশে বাংলাদেশের পর্যটক, অন্যপাশে ভারতীয় পর্যটক। শুধু মাঝখানে লোহার সীমান্ত রেখা। ওপাশে ভারতের পতাকা উড়ছে। ভারতীয় কয়লাবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ভারতীয় ট্রাকগুলোর বডি পুরো ভিন্ন। ভারতের উঁচু পাহাড় বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে দীর্ঘ প্রাচীর তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে সে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য।

তামাবিল থেকে কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছে যাই পিয়াইন নদীর তীরে জাফলং। প্রকৃতির আরেক নৈসর্গ জাফলং। প্রথমেই চোখে পরে পাথর তোলার দৃশ্য। এখানে বিভিন্ন দোকানও দেখতে পেলাম। এই দোকানগুলোতে ভারতীয় অনেক পণ্য পাওয়া যায়। অনেকে আগ্রহ নিয়ে কেনাকাটা করছে। উপজাতীদের হাতের তৈরি শাড়ি, বিছানার চাদর, জামা ইত্যাদির প্রতি পর্যটকদের বেশি আকর্ষণ।

দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। এদিকটায় ঘুরে তারপর আমরা চারশ’ টাকায় ট্রলার ভাড়া নিয়ে জিরো পয়েন্টে চলে যাই। এরপরেই নোমেনস ল্যান্ড। এখান থেকে দেখতে পাই ভারতের শিলং রোড। দূরে দেখা যায় ভারতের ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতু। সীমান্তের ওপারে ভারতের উঁচু উঁচু পাহাড় থেকে ঝর্নার পানি গড়িয়ে আছড়ে পড়ছে আমাদের দেশে। পানির সাথে ভেসে আসে পাথর। জাফলং পিয়াইন নদীর তীরে গড়ে উঠেছে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তুপ। চা-বাগানের ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম কমলা বাগান। বিকেলে সিলেট শহরের দিকে রওনা করলাম। রাতে ব্যাগ গুছিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। ভোরে ঢাকা ফেরার জন্য ট্রেন।
 
ঘুম ভাঙ্গলো মোবাইলে এলার্মের শব্দে। সময় হয়ে এলো প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যাওয়ার। প্রস্তুত হয়ে গেলাম হোটেল ছাড়তে। হোটেল কাউন্টারে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম। আশে-পাশে তখনও অন্ধকার। দিনের আলোয় আলোকিত হয়নি।

রেল স্টেশন পৌঁছে মনে হলো আমরাই প্রথম স্টেশনে আসলাম। আর কোনো যাত্রীকে দেখতে পেলাম না। সিলেট রেল স্টেশনের একটি অন্যরকম আকর্ষণ পাখির ডাক। ভোর বেলা স্টেশনের ভেতরে চড়ুই পাখির ডাকে অন্য কিছু শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্টেশনে হাজার হাজার চড়ুই পাখির বাসা। স্টেশনের ভেতরে একবার এদিক, একবার ওদিক পায়চারী করতে থাকলাম। একে একে অন্যান্য যাত্রীদের আনাগোনা শুরু হলো। দিনের আলো একটু একটু করে উকি দিচ্ছে। ঠিক সময় মতো ৬.৪০ মিনিটে ট্রেন ছাড়ল। জানালা দিয়ে চোখ রাখলাম বাইরের দিকে। ট্রেনের গতি বাড়ল। আর হারিয়ে গেল সিলেট রেল স্টেশন।

কিভাবে যাবেন
ঢাকা সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে হানিফ, শ্যামলী, ইউনিক, আল-মোবারাকা, মিতালীসহ আরও অনেক বাস সিলেট যায়। জনপ্রতি ভাড়া ২৫০- ৪৭০ টাকা। এছাড়া ট্রেনে জনপ্রতি সিলেটের ভাড়া ২৪৫ টাকা (শোভন) ও ৫৬৪ টাকা (এসি প্রথম শ্রেণি)।



বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।