ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

আজমীরের পথে....

ভাস্কর সর্দার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৮, ২০১৪
আজমীরের পথে.... ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: শুরুটা হয়েছিল নিছকই আড্ডায়। পৃথিবীতে এমন কতগুলো তীর্থ রয়েছে যেসব স্থানে সব ধর্মবর্ণের মানুষ দ্বিধাহীন চিত্তে অবাধে যাতায়াত করে! ভারতে এমনই এক তীর্থ আজমীর শরীফ।

যেতে হবে সেখানে।

আজমীরের অবস্থান রাজস্থানে। এটাই খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগা।
সত্যিই এখানে বর্ণ বা ধর্মের পৃথক চিন্তা নেই। সবাই মানত নিয়ে আসে এ বাবার দরগায়। খাজাজীর দরগা নামেও খ্যাত এই আস্তানা।

কথা অনুযায়ী প্ল্যান, সঙ্গে বাংলানিউজের কয়েকজন প্রতিনিধি।

ভারতীয় রেলের সুবিধা যদিও আছে, কিন্তু কিছু হ্যাপা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি আজমীর শরীফ এক্সপ্রেস। টিকিট সহজলভ্য হলেও রেল গাড়িটি মন কাড়েনি অন্যান্য ট্রেনের ব্যবস্থাপনার তুলনায়।

সে যাই হোক, এসি ও নন এসি আসন সুবিধার শ’খানেক বগির এই ট্রেনে শুয়ে-বসে দিব্যি যেতে পারবেন আজমীর শরীফে। রাজকীয় ব্যবস্থা না থাকলেও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আছে ট্রেনের মধ্যেই। তবে কিনে খেতে হবে। দামও আপনার হাতের নাগালে। টানা ৩৬ ঘণ্টার রেল ভ্রমণ বলে কথা। যদি ট্রেন দেরি না করে তাহলে সকালের দিকে নামবেন আজমীরে। সমস্যা নেই হোটেল পেতে।

ট্রেন থেকে নামা মাত্রই আপনার কাছে ছুটে আসবে হোটেলের দালালরা। বর্ণনা দেবে রুমের। তারমধ্যেই একটা বেছে নিতে পারেন আপনার সাধ্য অনুযায়ী। ৫০০ থেকে ৫০০০ রুপির মধ্যে রুম পাবেন এখানে। আপনার রুমের ২৪ ঘণ্টা শেষ হবে যখন থেকে রুম বুকিং হবে তখনকার হিসেবে।

হাল্কা নাস্তা করে একটা গোসল দিয়ে তৈরি হয়ে নিন বাবার দরবারে যাওয়ার জন্য। অবশ্যই হোটেলে জানাবেন আপনি দরবারে যাবেন, না জানালেও তারা আপনাকে একবার অন্তত জানাবে, তাদের গাইড আছে।

গাইড হিসেবে হোটেলের পরিচিতকেই নেবেন। কেন গাইড নেবেন সে বিষয়ে পরে আসছি। যদি আপনি স্টেশনের কাছাকাছি থাকেন তাহলে পায়ে হেঁটে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগবে দরগায় যেতে। যদি হাঁটার অভ্যাস থাকে তবে ভালো, না থাকলে রিকশা বা সিএনজি চালিত অটোরিকশা তো আছেই।

অলিগলি দিয়ে পৌঁছুবেন বাবার দরগায়। গাইডের নির্দেশ অনুযায়ী দোকানে জুতো খুলে রাখুন। আপনি যদি চান সেখান থেকে নিতে পারেন ফুল, চাদর, আগরবাতি, আতর ইত্যাদি- যা আপনি দরগায় চড়াবেন।

এবার স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত স্থানে পা দিতে চলেছেন আপনি। প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ মানুষ আসেন এ স্থানে। আজ আপনিও তাদের একজন। কমপক্ষে সাত ধর্মের মানুষের আগমন হয় এই স্থানে।

এখানে প্রার্থনা করতে কোনো নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই। নানা ধর্মের মানুষ, নানাভাবে প্রার্থনা করে চলেছে। মুসলিমরা মুসলিমের শরীয়ত অনুযায়ী, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধরা তাদের মতো। এ এক অদ্ভুত মিলন মেলা।

বলা হয়, মন থেকে বাবার কাছে কেউ কিছু চাইলে খালি হাতে ফেরেন না তারা। আজমীর শরীফের সামনে বারবার একটি কথা শুনতে পাবেন, ‘বাবাকে ঘরমে দের হ্যায়, অন্ধ্যের নেহি’। এর মানে বাবার কাছ থেকে কিছু চাইলে সময়ের হেরফের হতে পারে, কিন্তু পাবেন না এমন নয়।

বাবার দরবারে আছে সাত সাতটা ফটক। আছে শাহজাহান মসজিদ। এখানে নারী-পুরুষের জন্য পৃথক ব্যবস্থা আছে নামাজ পড়ার। এছাড়া আছে বাবার দুই স্ত্রী এবং এক ছেলে ও এক মেয়ের সমাধি। দ্বিতীয় ছেলের সমাধি দরগা থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সারোয়ারে।

ভিড় ঠেলে বাবার সমাধিতে যেতে বেশ লম্বা লাইন পাড়ি দিতে হবে। এই লাইন সবার জন্য। সে আপনি সাধারণ মানুষ হোন কিংবা  কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্বই হোন। সবার জন্য নিয়ম একই। অবাক হবেন না, যদি কোনো ফিল্মি তারকাকে আপনার লাইনে দেখতে পান। প্রথা অনুযায়ী নিয়ম করে বলিউডের কোনো সিনেমা রিলিজ হওয়ার আগে নায়ক-নায়িকারা আসেন বাবার দরগায়। লাইনের এ নিয়ম মানতে হয় ভারতসহ যে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি এলেও।

বাবার সমাধির সামনে দাঁড়াতে সময় পাবেন মাত্র এক থেকে দুই মিনিট। তার মধ্যেই ফুল, চাদর চড়িয়ে দেবে আপনার সহযোগী। সারাক্ষণই লাইন চলমান।

মাজার জিয়ারতের এক পর্যায়ে রীতি অনুযায়ী মুখে একটা ফুলের পাঁপড়িও নিতে হবে আপনাকে।

আপনার সহযোগী ক্ষণিকের গাইড সবই বলবে আপনাকে তার মতন করে। তার কথাতেই একবার আপনার চোখ যাবে সোনার চূড়ার দিকে।

৫১ কেজি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি এই চূড়া। ত‍ৎকালীন রামপুরের নবাব তৈরি করে দিয়েছিলেন। দেখার আছে স্ত্রী ও ছেলে মেয়ের সমাধি। এই জায়গায় হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পাবেন আপনি।

এখানে আছে চারটে হাণ্ডি বা বিশাল আয়তনের কড়াই। এগুলো কোনো সাধারণ কড়াই নয়। একটাতে ১২০ মণ, দ্বিতীয়তে ৬০ মণ, তৃতীয়তে ২.৫ মণ এবং চতুর্থটিতে ৫৫ কেজি ‘মিঠা ভাত’ হয়। কোনো ব্যক্তির মনোবাসনা পূর্ণ হলে সে তার ইচ্ছা অনুযায়ী ‘মিঠা ভাত’ দিতে পারে। যথাক্রমে যার মূল্য আড়াই লাখ, দেড় লাখ, ১১ হাজার ও দশ হাজার রুপি। মজার ব্যাপার, প্রতিদিনই রান্না হয় এক বা একাধিক হাণ্ডিতে। ‘মিঠা ভাত’ তৈরি হতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা।  

বলা হয়, সুদূর ইরান থেকে প্রায় ৯০০ বছর আগে খাজা মউনুদ্দিন চিশতীর আগমন ঘটে এই জায়গায়। জীবিত থাকাকালে তিনি সব সমস্যার সমাধান করতেন এ স্থানে। হাজার সমস্যার ডালি নিয়ে হাজির হতেন তৎকালীন রাজা, বাদশাহ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। এখনও একই প্রথা চলে আসছে এখানে। তখন থেকেই বাবার সেবকরা বংশপরম্পরায় এখনও দরগার সেবা করে আসছেন। তারই কোনো বংশধর হয়তো আপনার গাইড।

কেন গাইড
তাদের কারোরই টাকা-পয়সার দাবি-দাওয়া নেই। সবাই আজমীর বোর্ড থেকে পারিশ্রমিক পান। তবে মন থেকে ভালোবেসে আপনি দিলে নাও করবে না সে। পদে পদে সতর্ক করবেন তারা। যেখানেই তীর্থস্থান সেখানেই পবিত্রতার সঙ্গে কিছু খারাপ দিকতো আছেই। ঠিক প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতো। যেমন, কলকাতায় কালীমন্দিরের পাশে গড়ে উঠেছে পতিতা পল্লী। যেমন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আশপাশে গড়ে উঠেছে প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য ঘণ্টাখানেকের লজ।

ঠিক তেমনি আজমীরে সবই আছে। চোখের পলকে ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে আপনার সাধের মানিব্যাগ থেকে দামি জুতোসহ আরও অনেক কিছু। কালোবাজারি থেকে শুরু করে অনেক অসাধু ব্যক্তির আগমনও হয় এখানে। যেখানে ট্যুরিস্ট সেখানেই কালোবাজারি। কিন্তু তাতে ভয় নেই যদি গাইড থাকে আপনার সঙ্গে।

তবে এই অন্ধকার আজমীর শরীফের মাহাত্ম ম্লান করতে পারেনি। আজমীর শরীফের মাহাত্ম তাই যুগ-যুগান্ত পার করেও অম্লান হয়ে আছে। সেই মাহাত্ম মিলনের মাহাত্ম। সেই মাহাত্ম দেশ, সীমা, ধর্ম, বর্ণ ছাড়িয়ে মানবিক ধর্মের মাহাত্ম। কবির ভাষায়-
‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান।
বিবিধের মাঝে যেন মিলন মহান। ’

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।