ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারতের পথে পথে: ১

ওপারে বাংলাদেশির ঢল

মুহম্মদ জয়নাল আবেদীন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৪
ওপারে বাংলাদেশির ঢল

ফেনী নদীর শেকড় অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইন্সটিটিউটের দ্বারস্থ হতে বছর তিনেক আগে গিয়েছিলাম ফরিদপুর শহরে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বহু স্থানে যাওয়ার সুযোগ ঘটলেও উত্তরাঞ্চলটা আমার কাছে অজানা-অচেনা এক জনপথ।

ফলে ফরিদপুরের পরের বাংলাদেশটা দেখার আগ্রহের কমতি নেই।

প্রতিবেশী দেশ ভারত ভ্রমণে যাচ্ছি, এক ঢিলে অনেক পাখি। বাসযাত্রায় আগ্রহের বাস্তবতা মিলবে ভেবে গ্রিনলাইনের টিকিট আগেই নিশ্চিত করে রাখি। সঙ্গী দুজন- শান্তা, যে আমার জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন মিশিয়ে দিয়েছে। অন্যজন মোর্শেদ ভাই, ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
৬ ডিসেম্বর শনিবার, রাত সোয়া ১১টার বাসে ভারত ভ্রমণের যাত্রা শুরু। কুয়াশাচ্ছন্ন সড়কে গতিমন্থর গাড়ি। সাভার, মানিকগঞ্জের সরু সড়ক পেরিয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে যেতেই ঘড়ির কাঁটা রাত দুইটার ঘরে। শুভযাত্রা যে কোন লক্ষণে বিঁধতে যাচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

একপর্যায়ে গাড়ির চাকা থমকে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা।

ভোর চারটা। মুঠোফোনের নিউজপোর্টালে চোখ বুলাতেই হতাশার খবর! কুয়াশা ঘন কুয়াশায় পরিণত হয়ে মেঘনার ফেরি চলাচল সাময়িক বন্ধ! ভোরের অন্ধকার কাটলেও হতাশার আঁধার কাটে না। ঠিক সকাল আটটায় বাস উঠল ফেরির পিঠে। ছয় ঘণ্টা থমকে থাকার পর গাড়ি চলতে শুরু করলেও ওদিককার সড়কগুলোর দশা খুব একটা ভালো মনে হয়নি। যেমন সরু, তেমন ভাঙাচোরা। ফলে বাসের গতি আগের রাতের কুয়াশাক্রান্ত মন্থরতার মতোই।

দুপুর নাগাদ বেনাপোল পৌঁছায় আমাদের বহনকারী বাস। সীমান্তের সামগ্রিক আনুষ্ঠানিকতা সেরে পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ভারতের মাটিতে পা রাখি। কিছুক্ষণ আগে এপারে যে জায়গাটির নাম ছিল হরিদাসপুর, কয়েক গজ ব্যবধানে ওপারে সেটি হয়ে গেল পেট্রাপোল।

ওপারে যাওয়ার পর এক ভারতীয় (পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক) পেয়ারা বিক্রেতার মুখোমুখি হয়ে টের পেলাম টাকা আর রুপির হেরফের। নামে রুপি হলেও তারা এটিকে টাকাই বলছেন। গণ্ডগোলটা সেখানেই। প্রতিটি পেয়ারা আট টাকা হাঁকানোর পর কিনতে গিয়ে ঠকলাম রুপিতে গিয়ে সেটি নানা রকমের যুক্তিতে ২০ টাকায় রূপ নিল! সেটি অবশ্য পুরো ভারত সফরে অভিজ্ঞতা হয়ে কাজ করেছে।

দ্বিতীয় দফায় গাড়ি চলতে শুরু করলো। কলকাতা-পেট্রাপোল রুটে চলাচলরত বাসগুলোর মতো সেখানকার সড়কও বেহাল! ঘণ্টাখানেক পর বাস মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দিয়ে একটি হোটেলে দাঁড়ালো। ভেতরে ঢুকে মনে হলো, আমাদের দেশের দিনমজুরেরা কাজের ফাঁকে নাস্তা করতেও ওইরকম হোটেলে যান না। গ্রামের বুক চিরে বয়ে চলা সড়কের দুই পাশে আমার উৎসুক নজর। অনেকক্ষণ চলার পরও বড়সড় দালানের দেখা নেই। বাংলাদেশের ঝুপড়ি ঘরের মতো অনেকটা মিল আছে এমন ঘরও চোখে পড়ে। তবে এসব অবশ্য গ্রামের দিকেই।

ভারত ভ্রমণে কোথায় কোথায় ঘুরবো- তার একটা প্রাথমিক ছক আগেই আঁকা ছিল। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় অবস্থান করবো বলে বাস থেকে নেমে হোটেলের সন্ধান করি। শুরুতেই চোখে পড়ে দালালের দৌরাত্ম্য। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একজনের ‘সহায়তায়’ অবশেষে একটি গেস্টহাউজে উঠি।

হোটেলের চেয়ে এখানে ভাড়া কিছুটা কম। কলকাতায় স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভাড়া হোটেলে বা গেস্টহাউজে। রাত কাটাতে আপনি চাইলে ৪০০ রুপিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন, বিলাসিতা করে চার হাজার রুপিতেও পারেন। একটি বিষয় চোখ এড়ায়নি। অনুমানে মনে হলো, কলকাতায় যতোটা না ভারতীয়, তার চাইতে বেশি বাংলাদেশি। ওপার বাংলায় যেন বাংলাদেশির ঢল!
হোটেলে উঠতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেল। টানা ১৯ ঘণ্টার ধকল, তাই সে রাতে কোথাও ঘুরতে বের হওয়া সম্ভব হল না। তবে পাশেই নিউমার্কেট বলে এড়িয়ে গেলাম না।

কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে গেস্টহাউজে বসে পরদিনের পরিকল্পনা ঠিক করতে থাকি। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো, আমরা পরদিনই যাত্রা শুরু করব ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির পথে।

৭ ডিসেম্বর রোববার। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দূরন্ত এক্সপ্রেস আমাদের নিয়ে যাত্রা করবে নয়াদিল্লির পথে। দিনটি কলকাতায় আশপাশে কাটাতে চাইলাম। তিনজন ছুটে চললাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের দিকে। গাড়িতে না উঠে হেঁটেই চলেছি। সড়কের ওপর একইসঙ্গে যানবাহন এবং মেট্রোরেল দেখে নিজেদের ওপর ক্ষুব্ধ হলাম। আমরা কেন আজো সেটি পারছি না।
কলকাতার পথঘাট অনেকটা স্বচ্ছ-পরিস্কার। যানবাহনগুলো ট্রাফিক আইন মেনে চলছে। মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক নেই, অথচ লাল বাতি দেখামাত্রই গাড়িগুলোর চাকা থমকে যাচ্ছে!
ভিক্টোরিয়ার পথে দেখি ‘শহীদ উদ্যান’।

২১ জুলাই যাদের রক্তে ভেসেছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজপথ, তাদের স্মরণে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে এটি। আরেকটু দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতরত্ন ইন্ধিরা গান্ধীর বিশাল প্রতিকৃতি। সামনের মোড় পার হয়ে ডানে দুই মিনিট হাঁটতেই ভিক্টোরিয়ার গেট। মাত্র চার রুপিতে পাওয়া যায় ভেতরে প্রবেশের টিকিট!

ভিক্টোরিয়ার ভেতরে ঢুকে মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক বড় একটি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। মাঝখানে মূল মহল। চারপাশে বৈচিত্র্যময় দৃশ্যে সাজানো ছবির মতো একটি দর্শনীয় স্থান। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক সেখানে ঘুরছেন, দেখছেন।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ নামেও পরিচিত। এটি রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ। ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী উপাধির অধিকারী ছিলেন। ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ মূলত জাদুঘর হলেও এটি এখন কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ।

বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করেন স্যার উইলিয়াম এমারসন। প্রথমে তাকে ইতালিয়ান রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীতে স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করতে বলা হলেও তিনি শুধুমাত্র ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রয়োগের বিরোধিতা করেন। তিনি ইন্দো-সারাসেনিক শৈলীর সঙ্গে মুঘল উপাদান যুক্ত করে মূল সৌধের নকশা প্রস্তুত করেন। ভিনসেন্ট এসচ ছিলেন এই সৌধের অধিক্ষক স্থপতি। সৌধ-সংলগ্ন বাগানটির নকশা প্রস্তুত করেছিলেন লর্ড রেডেসডেল ও স্যার জন প্রেইন।

কলকাতা ময়দানের দক্ষিণ কোণে অবস্থিত এবং সুরম্য উদ্যান পরিবেষ্টিত শ্বেতপাথরে নির্মিত সুবৃহৎ ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৯০৬ সালে। সৌধটির উদ্বোধন করা হয় ১৯২১ সালে। সৌধের সর্বোচ্চ গম্বুজে বিউগল-ধারিণী বিজয়দূতীর একটি কালো ব্রোঞ্জমূর্তি রয়েছে। বায়ুপ্রবাহ শক্তিশালী হলে বল-বিয়ারিং যুক্ত একটি পাদপীঠের ওপর স্থাপিত মূর্তিটি হাওয়ামোরগের কাজ করে। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি-প্রাক্তনী এ সি মিত্র ভিক্টোরিয়ার নির্মাণপ্রকল্পের কার্যনির্বাহী বাস্তুকার।

রোববার ভারতে ছুটির দিন হওয়ায় ভিক্টোরিয়া জাদুঘরে ঢোকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম। তবে চারপাশের জায়গাটি এতো বিশাল যে, পুরো চত্ত্বর ঘুরে দেখতে গিয়ে দু’বার বসে বিশ্রাম নিতে হলো আমাদের।

আর সবচেয়ে আশ্চর্য হই, ভিক্টোরিয়া মহলের চারপাশের একই চিত্র দেখে। আপনি যে পাশেই যান না কেন, মনে হবে যেন এটিই সামনের অংশ।

কলকাতায় দেখার মতো আছে আরো অনেক কিছু। সেগুলো দেখেছি ফিরতি পথে। সেদিন ভিক্টোরিয়া এবং আশপাশের আরো কিছু এলাকা ঘুরে দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এলো। আমরা ছুটে চলেছি শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনের দিকে। নির্ধারিত সময়ের আগেই স্টেশনে হাজির হলাম। ছয়টার দিকে পাঁচ নম্বর লাইনে ট্রেন থামলো। ভেতরে গিয়ে নিজেদের আসনে বসার পর ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ছয়টা ছুঁতেই ট্রেন ছুটতে শুরু করল নয়াদিল্লির পথ ধরে।


মুহম্মদ জয়নাল আবেদীন: সাংবাদিক, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২২২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৪

** হোটেল রুম সংকট, বুকিং না দিয়ে কলকাতায় যাবেন না

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।