ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সবুজ পাহাড়ে রাইক্ষ্যং লেকের অপূর্ব সৌন্দর্য্য | সানজাদুল ইসলাম সাফা

ভ্রমণ/ট্রাভেলার্স নোটবুক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৫
সবুজ পাহাড়ে রাইক্ষ্যং লেকের অপূর্ব সৌন্দর্য্য | সানজাদুল ইসলাম সাফা ছবিঃ লেখক ও রেদুয়ানুর রহমান

সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই, গহীন পাহাড়ের দুর্গম উঠা-নামা পথ। যতই দেখি প্রাণ ভরে না।

ক্ষুধা তৃষ্ণা বেড়েই চলেছে। দুঘণ্টা ট্রেকিংয়ের পর পেলাম উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ছোট্ট একটি জনবসতি সাইকত পাড়া। বম জাতির বসবাস। আপাতত রাত কাটানোর জন্য এখানেই আশ্রয়ের তালাশ করবো। চূড়ায় উঠতে চারদিকে আঁধার। পাহাড়ি কুকুরগুলো চেঁচিয়ে উঠলো, উত্তপ্ততা আনলো আমাদের সাথে আসা ‘বাঘা’। বাঘার ঠিকানা কেওক্রডং, প্রযত্নে কেওক্রডংয়ের মালিক লালা বম। বান্দরবান থেকে বগালেকে পোঁছে সিয়াম বমের দোকানবাড়ি বিশ্রাম নিয়েই ট্রেকিং আরম্ভ। তখন থেকেই বাঘা আমাদের পিছু নিয়েছে। বেশ কয়েকবার তাড়ানো সর্বাত্মক চেষ্টায় বিচ্যুত করা যায়নি নাছোড়বান্দা প্রাণীটিকে। হয়ে গেল দলের আরেক ভ্রমণসঙ্গী।

সাইকত পাড়ায় পোঁছে খুঁজে পেলাম গ্রামের কার্বারি সাংচুয়াং বমের বাড়ি। কার্বারি হচ্ছেন পার্বত্য অঞ্চলের গ্রাম প্রধান। আমাদের সাদরে গ্রহণ করে তার টং বাড়ির একপাশ ছেড়ে দিলেন। আমাদের ছোট্ট দলে আছেন ভ্রমণে অভিজ্ঞ শাকিব ভাই, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র শামিম ভাই আর রুমা বাজারে থেকে গাইড আবদুল মালেক। পোঁছেই গাইড মালেক ভাই রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত।

রন্ধনশালায় পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্পেসল্পে বাড়ির কর্তা সাংচুয়াং বম জানালেন গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উঁচু অর্থাৎ বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু গ্রাম সাইকত পাড়া। কার্বারি সাহেবের জীবন সম্পর্কে জানা গেল তার ছোট ছেলে ক্লাস ওয়ান পড়ে, বড় মেয়ের সংসারে চট্টগ্রামে থাকে। প্রতিমাসে আট হাজার টাকা করে খরচ পাঠাতে হয়। পাহাড়ে আদার চাষ করেই পরিবারের খরচ মেটান। গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও দুর্গম এ জনপদে শিক্ষক আসে না। বাধ্য হয়েই সন্তানকে পাঠিয়েছেন শহরে। রান্না শেষ, খাবারের মেন্যুতে জুমের ভাতের সাথে ডিম আর ডাল। সারাদিনের খিদে আর পরিশ্রমে খাবারের স্বাদ যেন অমৃত। নয়’টা নাগাদ শুতে গেলাম। উঁচু জনপদে রাতের এক নতুন অভিজ্ঞতা। টং ঘরের নিচ দিয়ে তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস ঘুমের যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।

ছ’টায় ঘুম থেকে উঠে দেখি পুরুষ শূন্য। চলে গেছে জুম চাষের জন্য। বমরা বেশ পরিপাটি। কোনরকমে পাকানো খিচুড়ি খাওয়ার সময় গৃহকর্ত্রী দিদির সাথে কথা বলে আরও কিছু জানার চেষ্টা কিন্তু তিনি বাংলা একেবারেই জানেন না। অতপর গ্রামের শিশুদের চকলেট উপহার দিলাম। দুর্গম জনপদের শিশুরা অনেকে হয়তো চকলেট চোখেই দেখেনি তবু কি আনন্দ! গ্রামের সবার কাছে বিদায় নিয়ে আটটায় বেরিয়ে পড়লাম দ্বিতীয় দিনের অভিযানে।

তিন হাজার ফুট সাইকত পাড়া থেকে নিচে আসতে ঘড়ির কাঁটায় ন’টা। শীতের ঠাণ্ডা বাতাসেও প্রচুর ঘাম ঝরছে। পাদদেশে রুমা খাল। খালের ঝিরির ন্যাচারাল ঠাণ্ডা পানি পানে আবারো চাঙ্গা হলাম। উঠা নামা পথ সমতলের লেশ নেই।

হঠাৎ দু’একজন পাহাড়ির সাথে দেখা হচ্ছে। তাদের সাথে হাত মেলানো, নাম জিজ্ঞেস করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আরেকটি পাহাড়ের চূড়ায় ত্রিপুরা জাতির বসবাস আনন্দ পাড়া অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছি। সুন্দর ছিমছাম, শিশু নারী জুমের ধান ভানায়। দিনে পুরুষবিহীন বাকি সদস্যরা উঁকি দিয়ে আগুন্তুকদের দেখছে।

গহীন অরণ্যের বুকে একেকটি ঝুঁকিপূর্ণ সরুপথ, বিশাল পাথরের পাহাড় আবার ঝিরি পানির সন্ধান। যতই এগোই প্রকৃতির নতুন রূপ। এটাই বাংলাদেশের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের স্বাভাবিক চিত্র।

দুপুর ১’টা নাগাদ পোঁছালাম পুকুর পাড়ার নিকটবর্তী পাহাড়ের বৃহৎ চূড়ায়, পাশেই বিস্ময়কর রাইক্ষ্যং লেকের সৌন্দর্য দেখা যাচ্ছে। রাতটুকু পুকুরপাড়া কাটাবো। গ্রামটিতে ত্রিপুরাদের বসবাস। এটি রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত কিন্তু দুর্গম হওয়ায় গ্রামের বাসিন্দাদের রাঙ্গামাটির সাথে যোগাযোগ করে হয় বান্দরবান ঘুরে। বিশ্রাম নিয়ে আবারো ট্রেকিং শুরু এবার শুধু নামা। দু’টায় খাড়া পথের সাথে কাঠের তক্তা বেয়ে পৌঁছালাম পুকুরপাড়া। উঠলাম সুজন মাস্টারের অতিথিশালায়।

জিনিসপত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম বাংলার নায়াগ্রা রাইক্ষ্যং ঝরনার উদ্দেশ্যে। এক ঘণ্টার পথ। সেখানেই আমরা গোসল আর পেটে দানাপানি সেরে নেবো। রাইক্ষ্যং লেক পেরিয়েই একটি স্কুল সামনে ছোট্ট শহিদ মিনার। গভীর বনের ভিতর দিয়ে বিশাল আয়তনের রাইক্ষ্যং ঝর্নার পানিতে গোসল সেরে নিলাম। সকালে পাকানো খিচুড়ি দুপুরে প্রচণ্ড ক্ষুধায় স্বাদ অমৃত হয়ে গেল। গরম খিচুড়ি কলাপাতায় পেঁচিয়ে পলিথিনে রাখায় তাপ, স্বাদ ও গন্ধ অটুট।

রাইক্ষ্যং লেকের পাড়ে ফিরে এসে পরিচয় হল প্রজংপাড়ার যতীন্দ্র ত্রিপুরার সাথে। তিনি বাঁশের ভেলায় মাছ ধরেন। তিনি জানালেন শিং, কই, মাগুর প্রচুর পাওয়া যায়। তার ভেলায় লেকটা ঘুরালেন। শেষে ঘটলো বিপত্তি, পড়ে ভিজে গেলাম পানিতে। পার্শ্ববর্তী সেনা ক্যাম্পে কথা বলে জানা গেল রাইক্ষ্যং লেকের আয়তন দৈর্ঘ ১২০০ ফুট ও প্রস্থ ৪০০ ফুট। বিশাল লেকটির চারপাশেই পাহাড়। লেকের পানি স্বচ্ছ আর পরিষ্কার রঙ্গিন আকাশ মনমাতানো এক অপূর্ব পরিবেশ।

রাতের খাবারের আয়োজনে শামিম ভাই পাহাড়ি মুরগি খেতে চাচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ি মুরগি নেই, দেশি মুরগি। আর ডিম ২৫ টাকা প্রথমে কম মনে হলেও পরে চোখ কপালে। প্রতি পিস ২৫ টাকা আর ১০০ টাকা হালি। অনেক দূর থেকে কিনে আনতে হয়, দাম হবেই তো। সন্ধ্যায় সুজন মাস্টারে রন্ধনশালায় খেয়ে ও গল্প সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুরে এলাম পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এক কক্ষের স্কুল গোটা চল্লিশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন শ্রেণির জন্য আলাদা বেঞ্চ। পাহাড়ি শিশুদের কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত শুনে মনে জাতীয়তা বোধের অনুভূতি পেলাম।

সুজন মাস্টার, বৌদি ও পাড়ার লোকজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভিন্নপথে বগালেকের উদ্দেশ্যে। রুমা খাল দিয়ে আসার পথে নজর কাড়ে খালের অপরূপ সৌন্দর্য, বিশাল পাথর, দুপাশে ঝর্না। কিছু দূর যেতেই পরিবর্তন হয়ে যায় সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক উপকরণ। রুমা খাল হয়ে পৌঁছাই মেনতক পাড়ায়। এটি মুরং বা ম্র জাতির বসতি। আমাদের গ্রামে প্রবেশেই লুকোচুরি খেলা শুরু। ঘরগুলোয় নারী পুরুষ বাচ্চারা পালায়। লুকিয়ে আমাদের দিকে তাকায়, ক্যামেরা দেখলে মুখ লুকোয়। বিচিত্র এক অভিজ্ঞতা। তারা বান্দরবানে এখনো আদিম। অপরিচিত লোক দেখলে দৌড়ে পালায়। দুর্গম বনে বাঙ্গালি চোখে পড়লো, তারা জানালো কাঠ কাটতে এসেছে। আবার কাঠ পরিবহনের জন্য কেউ পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির কাজে এসেছে। বিশাল বিশাল কাঠের স্তূপ পড়ে রয়েছে। ৪০০ টাকা মজুরি পায় শ্রমিকরা কাজ করবে টানা দেড় মাস। তারপর অন্যরা আসবে। পাহাড়গুলো আদিবাসীদের ব্যক্তি মালিকানাধীন। তারাই বাঙ্গালি বেপারীর কাছে কাঠ বিক্রি করেছে। সেই বেপারী কাঠ বহনের জন্য বিশাল পাহাড়ের পাশ দিয়ে কেটে ঝুঁকিপূর্ণ পথ তৈরি করছে। বিকেল নাগাদ চিংড়ি ঝর্নায় পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বগালেকে এসে যাত্রা শেষ হলো। রাতটুকু এখানে কাটিয়ে পরদিন রোম হয়ে ঢাকার দিকে যাত্রা।

কিভাবে যাবেন

বান্দরবান থেকে বাস বা জিপে রুমা বাজার যেতে হবে। বাস ভাড়া ১০০ টাকা। চান্দের গাড়িতে করে বাজার ৩০ টাকা। রুমা বাজার থেকে গাইড নিবেন তারপর চান্দের গাড়িতে করে বগালেক যাবেন। বগালেক পর্যন্ত থেকে ভাড়া ১০০ টাকা। চাইলে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ নিতে পারেন। বগালেক থেকে হেঁটে পুকুর পাড়া যেতে হবে। আদিবাসীদের বাড়িতে থাকার ক্ষেত্রে গাইড সাহায্য করবে।

প্রয়োজনীয় তথ্য: বগালেক থেকে রাইক্ষ্যংলেক দুর্গম পথ। ব্যাগ যেন ভারি না হয়। পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবেন না। বিনা অনুমতিতে ছবি তোলা থেকে বিরত থাকবেন। ভালো গ্রিপের জুতা পড়তে হবে। রুমা বাজারে ভালো গ্রিপের প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় খাবার ও ঔষধ সঙ্গে নিবেন।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- 


বাংলাদেশ সময়: ১৬০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।