ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

প্রাচীন বন রেমা-কালেঙ্গা

মো. জাভেদ বিন-এ-হাকিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫
প্রাচীন বন রেমা-কালেঙ্গা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দেশের অন্যতম প্রাচীন বন সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারঘাট উপজেলার রেমা কালেঙ্গা। জানার পর থেকেই দেখতে মন উদগ্রীব হয়ে ছিল।



ভ্রমণপিপাসু মন, নতুন জায়গার সন্ধান পেলে না গেলে কী আর হয়! চট জলদি সারু ভাই সাদ্দাম আর এক মামা শ্বশুরকে প্রস্তাব দিলাম রেমা যাওয়ার, তারাও লুফে নিল প্রস্তাবটি।

দিনক্ষণ ঠিক হলো, রওনা দেবো ভোর পাঁচটায়। ঘুম থেকে ঠিক চারটায় উঠে জানালা দিয়ে দেখি টিপ টিপ বৃষ্টি, মনটাই খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র না, কারণ একবার যদি কোথাও যাওয়ার নাম নেই, তাহলে না যাওয়া পর্যন্ত মাথার পোঁকা নামে না অর্থাৎ ধ্যানে জ্ঞানে শুধু ওই স্থানই ঘোরে।

ঘুমকাতুরে ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি করতে বলি। ফজরের নামাজ আদায় করে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বের হই প্রকৃতির টানে।

ভ্রমণসঙ্গী রিপন, জিল্লুর রহমান, মামা সিদ্দিকুর রহমান আকাশ। আর সারু ভাই সাদ্দাম শ্যালিকা আলেয়ার বকুনি খেয়ে পিছুটান।

এরইমধ্যে আমাদের প্রতি বৃষ্টির মায়া হয়েছে! তাই হয়তো সূর্যি মামা কিরণ ছড়াচ্ছে। রৌদ্র পেয়ে মনও বেশ উৎফুল্ল।

পথিমধ্যে সকালের নাস্তা করে নিলাম। গাড়ি পুনরায় কালেঙ্গার পথে ছুটছে। আগে থেকেই গাইডের ফোন নম্বর ছিল, তাই পথ চিনতে কষ্ট হচ্ছিল না।

ইতোমধ্যে চুনারুঘাটে হাজির হলো গাড়ি। এবার সেই কাঙ্ক্ষিত রেমা কালেঙ্গার সরু পথে ছুটছে আমাদের গাড়ি।

পথের দু’পাশের দৃশ্যই বলে দেয় আমরা এগোচ্ছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভাণ্ডার কোনো এক নিসর্গ পানে।

গাড়ি থামলো বর্জুস নামক স্থানে, এবার কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথে হাটা, প্রায় পনের মিনিট হাটার পর ভাড়া করা বাইকে চড়ে সবুজ বনানীকে সঙ্গী করে রেমা কেলেঙ্গার মূল ফটকে হাজির হলাম আমরা।

দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল, বিনয়ী করিম সাহেব প্রাচীনতম বন রেমা কালেঙ্গার বিভিন্ন তথ্য আমাদের জানালেন। বললেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থাই রেমা কালেঙ্গার দুঃখ। ’

এবার গভীর অরণ্যের পথে পা বাড়াই। বনের ভেতর বন্যপ্রাণী ও অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য একঘণ্টা ও তিনঘণ্টার ট্রেইল পথ রয়েছে।

আমরা একঘণ্টার ট্রেইল পথেই প্রবেশ করি। বন ভ্রমণের পূর্ব পরিকল্পনা না থাকায় সাধারণ পোশোকেই অভিযান শুরু করি, তাই একটু বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন।

কিছুদূর যাওয়ার পর ওয়াচ টাওয়ার পাই। আরাম প্রিয় রিপন ভাই  হাপিয়ে উঠে, তারপরও চোখে তার জয়ের নেশা।

ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে রেমা বনকে অদ্ভুত সুন্দর লাগল! অবাক বিস্ময়ে তাকালাম। চারপাশে সবুজের মেলা, বৃষ্টির পরশে গাছের পাতাগুলো চকচক করছিল।

আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষ যেন একেকটি প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ শ্যামল এই দেশকে বিপর্যয় হতে রক্ষা করার জন্য। লেকের টলটলে জলে যখন নিজের চেহারা ভেসে উঠে, তখন আনমনে বিড়বিড় করে বলি, কত সুন্দর আমাদের এই দেশ।

অপরূপ সৌন্দর্য তার প্রকৃতি অথচ আমরাই ধ্বংস করছি তাদের, যেন দেখার কেউ নেই।    

রেমা কালেঙ্গা বন বিভাগের অন্তর্গত। সহযোগিতায় আছে আইপ্যাক নামে একটি সংস্থা। সরকার ১৯৯৪ সালে এখানকার ১৭৯৫ হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম ঘোষণা করে।

বনের মোট আয়তন তের হাজার দুই শত সতের দশমিক একুশ একর। এই বনে চাপালিশ, গর্জন, গামারি, জারুল, জাম, বনাক, আকাশি ও সেগুনসহ নানা ধরনের গাছ-গাছালি আছে।

একেকটি গাছের পরিধি ব্যাপক, যা চোখে না দেখলে বুঝানো সম্ভব নয়। বন্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে চিতাবাঘ, মেছোবাঘ, বার্কিং ডিয়ার কুলু বানর, চশমা হনুমান, লজ্জাবতি বানর, মুখপোড়া হনুমান, কালো কাঠবিড়ালি এবং ময়না বিলে বিপন্ন প্রজাতির উড়ন্ত কাঠবিড়ালির দেখাও মেলে।

গাইড জানালেন, এই বনে দুইশ’ পাঁচ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ভোরে বনে ট্রেইল করলে বন্য প্রাণীর সঙ্গে দোস্তি করা যাবে, আর সন্ধায় বন মোরগের ছোটোছুটি করবে বিমোহিত।

বনের ঠিক মধ্যখান দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা থেকে আসা কারিঙ্গী নদী বয়ে গেছে, নদী-বনের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ, চাইলে সাঁতার কাটাও সম্ভব।

বিদায় বনের রাজা রেমা, বিদায় নিসর্গের রানী কালেঙ্গা। ফিরতি পথ ধরতেই ফসলের মাঠে ঢেউ তুলে দমকা হাওয়া দেহমন জুড়িয়ে দিয়ে কানে কানে ফিস ফাস করে বললো,‘তুমি তো এতো শিগগির যাওয়ার মানুষ নও’। এরপরও বলতে হলো বিদায়-রেমা কালেঙ্গা।

ভ্রমণ পিয়াসীরা একটু সময় নিয়েই ঘুরে আসতে পারে রেমা-কালেঙ্গা। খরচা-পাতিও নাগালের মধ্যেই, ঢাকা থেকে যেতে পনেরশ’ টাকা হলেই যথেষ্ট। বন ভ্রমণের সহযোগিতায় রয়েছেন দক্ষ গাইড।

যাতায়াত:

ঢাকা-সিলেট রুটে যে কোনো পরিবহনে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা কিংবা লোকাল বাসে চড়ে যেতে হবে চুনারুঘাট বাজারে।

সেখান থেকে রিজার্ভ অটোরিকশা নিয়ে কিংবা মোটর সাইকেল ভাড়া করে ঘুরে আসতে পারেন প্রাচীন এই বন।

প্রবেশ ফি জনপ্রতি ২০/-(বিশ) টাকা, কটেজ ভাড়া সাতশ থেকে এক হাজার টাকা। খাওয়ার ব্যবস্থা কটেজ কর্তৃপক্ষের।    

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- 

                                                                                                                          
বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।