ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

লেডিবয়ের দেশে

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৪ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৫
লেডিবয়ের দেশে ছবি: সংগৃহীত

থাইল্যান্ড থেকে ফিরে: পাতায়াতে বিচ রোডের সই টুয়ের পশ্চিম পাশ থেকে বের হলে কেএফসি আর পিজা হাট। সেন্ট্রাল সেন্টার পাতায়ার সামনে বিয়ার ব্র্যান্ড হ্যানিকেনের খোলা চত্বর।

রাত ১০টা থেকেই খোলা আকাশের নিচে গান জমে এখানে। শ্রোতারা পানের সঙ্গে যে গান অনুরোধ করেন, গাওয়া হয়।
 
এক গ্লাস আপেল জুস নিয়ে বসে পড়ি। পর্যটকদের মধ্যে পাতায়াতে এসে জোড়া তৈরি করেছেন এমন সংখ্যাটাও এখানে কম নয়, তবে অবশ্যই তা অর্থের বিনিময়ে। সকলের গানের অনুরোধের মধ্যে আমিও প্রিয় বব মার্লির বাফোলো সোলজার গাওয়ার অনুরোধ পাড়ি। হায়! যখন পালা এলো দেখা গেলো চায়নিজ গায়ক বা গায়িকা- কেউই গানটি পারেন না। দুঃখ প্রকাশ করে গায়ক জানালেন, তিনি শুধু ‘নো ওম্যান নো ক্রাই’ গানটিই পারেন। জঘন্য সুরে সেই গানটি শোনানো হল। চত্বরের রোমান্টিক পরিবেশে খুব বেখাপ্পা শোনালো গানের কথাও। শেষে গায়ক বললেন, ‘দিস ইজ থাইল্যান্ড, হোয়েন ইউ হেভ নো ওম্যান, দেয়ার হেভ লেডিবয়, সো নো ক্রাই। ’
 
লেডি বয়ের দেশ থাইল্যান্ড। ফেরার দিন বৃদ্ধা ট্যাক্সি চালক কানোকোয়ান রাস্তায় দাঁড়ানো লেডিবয়দের দিকে নির্দেশ করে বলেছিলেন- ব্যাংককে আনঅফিসিয়ালি এই লেডিবয়ের সংখ্যা ৩০ হাজার প্রায়।
 
দুপুরের কড়া রোদে কোরাল আইল্যান্ডে নতুন ট্যুর অপারেটর স্বাগত জানালেন। লম্বা চুল আর সাজগোজ যতই নারীর হোক, ভারতীয় সহযাত্রী বন্ধু বললেন, আস্ক হিম, নাউ হোয়্যার উই উইল গো? তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুড়িয়ে ট্যুর অপারেটর বললেন, হেই ‌আই অ্যাম নট হি, আই অ্যাম শি।

বোঝা যায়, বেশ স্বাচ্ছ্যন্দের সঙ্গেই থাইল্যান্ডের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন লেডিবয়রা। এখানে তাদের হিজড়া গাল শুনতে হয় না। বরং তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে লেডিবয়রা নিজেদের পরিচয়কে বেশ প্রকাশ করেই বেড়ায়।

১৯ এপ্রিল দুপুরেই পৌছাই ব্যাংককের ডান ওয়াঙ্গি বিমানবন্দরে। খুব বেশি বিমানবন্দর দেখা হয়নি। তবে নিজের দেখা বাজে বিমানবন্দরের তালিকায় ডান ওয়াঙ্গি থাকবে। প্রথমবার থাইল্যান্ড প্রবেশের পাপ যখন করেছি, ইমিগ্রেশনে সবুজ পাসপোর্টের যন্ত্রণা যে সইতে হবে, আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। প্রস্তুতি অনুযায়ী একটি স্পেশাল সাক্ষাৎকার দিয়েই পেলাম ব্যাংকক প্রবেশের অনুমতি। আর বুঝতে পারলাম, এই দেশ খুব সহজ নয়। ভাষা জটিলতায় ভুগতেই হবে।

প্রায় ২০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে মোবাইলের সীম কিনলাম। কোনো দেশের সংস্কৃতি বুঝতে গণপরিহনের বিকল্প নেই। এই বয়সেই নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করার আরামদায়ক ট্যাক্সিকে না জানালাম।
 
নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসা করতেই বাসের পথ দেখিয়ে দিলেন। ঠিক যেন, বাসার দরজা থেকে গাড়িতে ওঠা। টিকেট কাউন্টার চোখে পড়লো না। একেতো দেশে মোটর বাইক আরোহী, তারওপর তিন সপ্তাহ মালয়েশিয়ায় অবস্থান। গণপরিবহন ভুলতে বসেছিলাম। ঢাকার মুড়ির টিন মার্কা বাসের স্বাদ পেলাম এবার ব্যাংককে।

ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠেই বুঝলাম, গেটেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ইঞ্জিনের পাশে ব্যাগ রেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা মধ্য বয়সী নারী বাস চালক। মোবাইলে আমার ছবি তোলা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন- ব্যাংককে নতুন? 
 
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসের কনডাকটর এলেন ভাড়া চাইতে। রূপবতী কনডাকটরও একই ইউনিফর্মে রয়েছেন। তবে আমার চোখে কিছুক্ষণের মধ্যেই শরষে ফুল উড়লো, যখন এক যাত্রী হাঁক দিয়ে রুপসীকে ডাকলেন, ক্যাথওয়ে। এর মধ্যেই জেনে গিয়েছিলাম, লেডিবয়ের স্থানীয় ভাষা ক্যাথওয়ে।
 
শুধু এশিয়া বা আফ্রিকা নয়, পশ্চিমেও লেডিবয় বা ট্রান্সজেন্ডার অথবা হিজড়াদের এখনো অবজ্ঞা করা হয়। লুকিয়ে রাখে সমাজ ও পরিবার। সেদিক থেকে এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছে থাইল্যান্ড। বরং সামাজিকভাবে এই তৃতীয় লিঙ্গকে স্বীকৃতি দিয়ে মূলধারার সঙ্গে মেশানো হয়েছে।

২০০৭ সালে সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে থাইল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় লেডিবয়দের স্বীকৃতি। পাসপোর্টসহ অন্যান্য সরকারি নথিতেও অর্ন্তভুক্ত করা হয় লেডিবয় বা ক্যাথওয়েদের নির্দেশ করার সুযোগ। আর শারীরিক গঠনের পরিবর্তন করতে চাইলেও পারবেন তারা।
 
এর আগে ১৯৯৬ সালে থাইল্যান্ডের জাতীয় ভলিবল দলে দুই জন লেডিবয় জায়গা করে নেন এবং আর্ন্তজাতিক আসরে অংশগ্রহণ করেন। থাইল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা বক্সিং। আর ১৯৯৮ সালে লেডিবয় নং তুম জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হলে সকলের নজরে আসেন।
 
এখন থাইল্যান্ডে সুন্দরী প্রতিযোগিতার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় ক্যাথওয়ে কনটেস্ট। আর সব স্থাপনাতেই তাদের জন্য থাকে ভিন্ন সুযোগ। সংগীত শিল্পী থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে সেরা অভিনেত্রী রয়েছেন লেডিবয়। অল্প সংখ্যক হলেও চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী হিসেবেও রয়েছেন লেডিবয়রা।
 
থাইল্যান্ডে লেডিবয়রা সাধারণত মেয়েদের পেশাগুলোতেই রয়েছেন, যেমন- দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট, বিউটি পার্লারে। এছাড়াও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে কাবারেট  ও যৌনকর্মী হিসেবে লেডিবয়দের প্রভাব রয়েছে বেশ। আর এক্ষেত্রে এইডসের ঝুকিঁও রয়েছে ভয়াবহ হারে।
 
পর্যটনের জন্যে বিনোদনের অবারিত দ্বার খুলে রাখায় সারা বিশ্বের মানুষের কাছে জনপ্রিয় এখন ব্যাংকক। তবে সুকুমভিতে পৌছালে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বা শপিং মলে যে সুন্দরী আপনাকে ইশারা করেন, অবশ্যই নিশ্চিত হওয়া যাবে না, আসলেই তিনি নারী। জিজ্ঞাসা করলেই হয়তো অবলীলায় বলবেন, ‘নো, আই অ্যাম লেডিবয়। ’
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৪ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৫
এমএন/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।