ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

হেঁটে হেঁটে ‘কান্ট্রি ক্রস’

শাহাদত হোসেন সরকার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৫ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৫
হেঁটে হেঁটে ‘কান্ট্রি ক্রস’ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ সংগঠনের সঙ্গে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত হাইকিং করার সময়ই ভ্রমণের ভূতটা মাথায় চাপে। বিষয়টা জায়েদ ভাইকে বলতেই তিনিও রাজি হয়ে গেলেন।



আমাদের ইচ্ছা ২০১৫ সালের মধ্যেই তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ কান্ট্রি ক্রস হাইকিং করবো। বন্ধু বাপ্পীকেও দলে নিলাম। তিন জনের দলটা মন্দ হলো না।

ভ্রমণের প্রস্তুতির জন্য ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই প্র্যাকটিস শুরু করি। প্রতিদিন সকালে নির্দিষ্ট সময় নিয়ে দৌড়ানো, তারপর রুট প্ল্যান, খরচাপাতির হিসাব-নিকাশ ইত্যাদি।

প্ল্যান শুনে বন্ধুরা অনেকেই সমর্থন দিল। আবার কেউ কেউ পাগলামি বলেও উড়িয়েও দিল। চৈত্র মাসের গরমের কথাও স্মরণ করিয়ে কেউবা আবার ভয়ও দেখালো।

ভ্রমণ সংগঠন ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’ ও ট্যুরিজম প্রমোটার ‘ইকো ট্রাভেলার্স’র সঙ্গেও কথা বললাম। কান্ট্রি ক্রস হাইকিং সম্পর্কে অজানা অনেক কিছু্ই জানলাম। তারা সব দিক থেকে আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন।

টুটুল ভাই, মনা ভাই এবং আবু বক্করও বিভিন্ন টিপস দিলেন। এই কান্ট্রি ক্রস হাইকিং’ এর জন্য একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করা হলো হাসান ভাইয়ের সহযোগিতায়।

‘বাঁচলে নদী, বাঁচবে দেশ, নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রচারণামূলক কান্ট্রি ক্রস হাইকিংয়ের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো।

ঠিক হলো এপ্রিলের শুরুতেই বেরিয়ে পড়বো আমরা। ৩ এপ্রিল সকালে আমরা ৩ জন বাস যোগে রওনা দিলাম তেঁতুলিয়ার উদ্দেশে। আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন ভ্রমণ বাংলাদেশের আবু বক্কর ভাই।

সন্ধ্যায় আমরা তেঁতুলিয়া পৌঁছালাম। সেখানে আজাহার ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি রাতে আমাদের তেঁতুলিয়া জেলা পরিষদ ডাক বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করেন।

পরদিন সকালে আমরা দেশের উত্তরের সর্বশেষ সীমান্ত বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে পৌঁছে গেলাম। তেঁতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধা প্রায় ১৭ কিলোমিটার পথ।
৪ এপ্রিল সকাল ৭ টা ১৮ মিনিটে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে হাঁটা শুরু করি আমরা। কিছু দূর চলার পর রাস্তার পাশে চা বাগান দেখা গেল। আমাদের গন্তব্য টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের শাহপরীর দ্বীপ। এটি দেশের দক্ষিণে মূল ভূখণ্ডের শেষ স্থলভাগ।

এর আগে ২০১০ সালে ৬ নভেম্বর শুরু করে শরীফুল ইসলাম ও ইশতিয়াক আরেফীন জুটি ২৬ দিনে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ কান্ট্রি ক্রস হাইকিং করেছিলেন। আমাদের বিশ্বাস ছিল আমরা ২৬ দিনের কম সময়ে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ কান্ট্রি ক্রস হাইকিং শেষ করবো।

প্রথম দিন রাত্রি যাপন করলাম পঞ্চগড় শহরে। দ্বিতীয় দিন সকালে পঞ্চগড় শহরে রকস মিউজিয়াম দেখে হাঁটা শুরু করলাম। দুপুরে হাঁটার সময় এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে দেখা। যিনি একাত্তরে যুদ্ধের সময় এ অঞ্চলে ছিলেন। তিনি আমাদের ওই অঞ্চলের যুদ্ধের কথা বর্ণনা করলেন।

দ্বিতীয় দিন রাতে আমরা থাকলাম পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ ডাকবাংলোতে। এইভাবে পঞ্চগড় বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে পথ চলতে
চলতে নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর হয়ে দশম দিনে সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছালাম ঢাকায়।

গত ১০ দিনে তেঁতুলিয়া থেকে ঢাকায় আসার পথে অনেক মানুষের আন্তরিকতা, ভালোবাসা এবং আতিথেয়তা পেয়েছি। বিশেষ করে রংপুরের বন্ধু রাজনের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা মনে রাখার মতো। যা আমাদের অনাগত দিনের উৎসাহ হিসেবে কাজ করে।

পিটে ভ্রমণ ব্যাগ নিয়ে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর শহর রক্ষা বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় সকালে স্থানীয় এক বাজারে নাস্তা করছিলাম। এসময় এক ভদ্রলোক হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন- আপনারা কী ডুবুরি? নদীতে কী কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে?

তারপর ভদ্রলোককে নিয়ে বাজারে সবার সঙ্গে আমাদের উদ্দেশ্য ও প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে কথা বললাম। তিনি আমাদের এই কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানালেন।
পরে টাঙ্গাইলের কুরতুবী ফাউন্ডেশনের আতিথেয়তাও আমাদের মন ছুঁয়ে গেছে।

ঢাকায় আসার পরদিন রাতেই অনেকে আমাদের সঙ্গে দেখা করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমাদের ভ্রমণের গল্প শোনার জন্য তারা আগ্রহ  প্রকাশ করলেন। জায়েদ ভাইয়ের বাসায় একরাত এ নিয়ে গল্পও হলো, আড্ডা এবং জম্পেশ খাওয়া দাওয়া।

পহেলা বৈশাখে আমরা ঢাকার রাজপথে হেঁটে চললাম। সঙ্গে ছিলেন আবু বক্কর ভাই, দোলা আপা ও অন্যরা। এরপর আমরা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হয়ে  টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের শাহপরী দ্বীপের দিকে এগিয়ে যাই।

চাঁদপুরের চিতষীতে এসে রাতে আমরা ইয়াহিয়া ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। রাতে খাবার পর তিনি আমাদের নিয়ে একটি কবিতা লিখে শোনালেন। পরদিন সকালে  তিনিও আমাদের সঙ্গে কিছুটা পথ হাঁটলেন এবং মোঘল আমলের একটি মসজিদ ঘুরে দেখালেন। ফেনী থেকে আমরা মহুরী প্রজেক্ট দিয়ে চট্টগ্রামের
পরদিন আমরা রাত কাটাই সীতাকুণ্ড শহরে। সন্ধ্যার পর গ্রামের রাস্তায় হাঁটার সময় স্থানীয়রা জানান, এখানে গত রাতে ডাকাতি হয়েছে। তাই নিরাপত্তার জন্য দ্রুত সীতাকুণ্ড শহরে যাবার কথা বলেন।

এর পরদিন চট্টগ্রাম শহরে এসে মাউন্টেনারিং ক্লাব ‘ভার্টিকাল ড্রিমারর্স’র বাবর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়। সেখানকার মানুষের ভাষা ও জীবন-যাপন সম্পর্কে তিনি আমাদের ধারণা দেন।

১৯তম দিনে আমরা কক্সবাজার পৌঁছালাম। ভ্রমণ বাংলাদেশ’র সভাপতি আরশাদ হোসেন টুটুল ভাই মারমেইড হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এক পাশে পাহাড় অন্য পাশে সমুদ্রকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া।

ভ্রমণের ২০তম দিনে শিলখালীর বন্ধু মোহাম্মদ আলী রাতে থাকার ও খাবার ব্যবস্থা করলেন। মধ্যরাতে প্রচণ্ড ঝড় হলো। এই প্রথম এতো কাছ থেকে সামুদ্রিক ঝড় দেখলাম। ঝড়ে সমুদ্র যে এতো ভয়ংকর রূপ নেয় তা আগে জানা ছিল না।

এদিকে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে আমাদের মোবাইল ফোনগুলো বন্ধ হবার উপক্রম। যা আমাদের বেশ দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দেয়।

এবার আমরা গন্তব্য থেকে মাত্র ৩৮ কিলোমিটার দূরে। ২১তম দিনে বেলা ১১টার পরপরই আমরা নিজেদের টেকনাফ শহরে আবিষ্কার করলাম।

এখান থেকে শাহপরী দ্বীপ মাত্র ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে। বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম শ‍াহপরী দ্বীপে। এ সময় ভিন্ন রকম এক শিহরণ আমাদের রক্তে প্রবাহিত হয়।

অভিযাত্রীকের রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি নিয়ে আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে হাইকিং বা পায়ে হাঁটা অভিযান শেষ করি।

এই কান্ট্রি ক্রস হাইকিং শেষ করতে ২১ দিনে প্রায় ২৭৪ দশমিক ৩৫ ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছে। অতিক্রম করতে হয়েছে ৪টি বিভাগের ১৭টি জেলার প্রায় এক হাজার ৫০ কিলোমিটার পথ।

যাত্রাপথে বিভিন্ন অঞ্চলের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আমাদের কথা বলতে হয়েছে, ভাব বিনিময় করতে হয়েছে। আমাদের ভ্রমণে প্রতিপাদ্য বিষয়ে কথা তুলে ধরতে হয়েছে।

এ সময় একে তো চৈত্র মাসের রোদে পোড়া চেহারা তার ওপর পোশাক ও ব্যাকপ্যাকের কারণে অনেকেই আমাদের ভিনদেশি মনে করতেন। কেউ কেউ হিন্দি, উর্দু অথবা ইংরেজিতে কথা বলতে আসতেন যা আমাদের বাড়তি আনন্দ দিয়েছে।

আমরা বিশ্বাস করি, পরিবেশ রক্ষায় নদী সংরক্ষণ ও বৃক্ষায়ণ অন্যতম নিয়ামক। এই উপলবদ্ধি থেকেই এ কান্ট্রি ক্রস হাইকিং। যা আমাদের স্মৃতির আখরে চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে।
যেভাবে যাবেন

প্রথমেই মনে রাখতে হবে এটি কোনো সাধারণ ভ্রমণ নয়। এই ধরনের ভ্রমণের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন শারীরিক সুস্থতা। ঢাকা কল্যাণপুর থেকে হানিফ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন সরাসরি তেঁতুলিয়া যায়।

ভাড়া ৭০০/৭৫০ টাকা। তেঁতুলিয়া থেকে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, রিকশা কিংবা, ভ্যান নিয়ে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে চলে যান। আর সেখান থেকেই শুরু করতে পারেন জীবনের এক অনন্য-অবিস্মরণীয় অধ্যায়।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- 



বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৫
টিআই/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।