রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর থেকে: ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় অার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম ফতেপুরে। প্রায় ১ ডজন প্রকারের যানে চড়ে অবশেষে পরিবারের সঙ্গে।
কুয়ালালালামপুর থেকে পুত্রজায়া:
বুধবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকালে ঘুম ঘুম চোখে ঘুরে বেড়াই কুয়ালালামপুরে। মসজিদ ইন্ডিয়া থেকে ট্যাক্সিতেই পৌঁছাই মিডভেলি শপিং মলে। জমকালো শপিংমল পুরোটা ঘোরা সম্ভব নয় একদিনে। বিখ্যাত ব্র্যান্ডের দোকানগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে বোঝা যায় দুনিয়ার ফ্যাশন ট্রেন্ড। কুয়ালালামপুরের বেশ চওড়া দামের শপিংমল এটি।
কিউর বুটিক ব্যান্ডের ব্যাগের দোকানে প্রবেশ করলাম। ল্যাপটপ বহন করাসহ হালকা ট্রাভেলের একটি ট্রলি ব্যাগে হাত দিতেই মিষ্টি হাসি দিয়ে চায়নিজ বিক্রেতা এগিয়ে অাসলেন। তবে ১৯৫৯ রিঙ্গিত দাম লেখা দেখে, অামি যে ঘুরে বের হয়ে যাবো সেটা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। এবার অামার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিত বেচারা সুলভ হাসি।
মিডভ্যালি থেকে বেরিয়ে বিশেষ ট্রেন এলঅারটি ধরে পৌঁছালাম কেএল সেন্ট্রালে। এরপর কেটিএম ধরে দুপুর নাগাদ পৌঁছাই বাংসারে ক্যারাম এশিয়ার অাঞ্চলিক অফিসে। এখানকার রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ হারুন অাল রশিদ। ঢাকা থেকে যাওয়ার পরই বেশ ঠাণ্ডায় ভুগছিলেন তিনি। বললেন, দ্রুত বের হয়ে যাবেন। আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য পুত্রজায়ায় তার বাসা।
তবে তেনেগানিতার অফিস ঘুরে অার তিতিওয়াংসায় বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তা মিনহাজ ভাই আর শাওন ভাইকে গাড়িতে তুলে পুত্রজায়ায় রওনা করতে সন্ধ্যা হলো। এর মধ্যে সেরদাং থেকে রাস্তার পাশ থেকে গরুর মাথা কিনে নেওয়া হলো। অানোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে অাগের রাতে অর্ডার দেওয়া গরুর মাংস। সুপার স্টোর থেকে চাল, পেঁয়াজ, মরিচ, তেল প্রয়োজনীয় মশলা কেনা হলো। রাত পোহালেই হারি রায়া (মালয় ভাষায় ঈদকে বলা হয়- হারি রায়া)। অামাদের কোরবানির ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি চলে জোরেসোরে। সেরদাং স্টেশনে যোগ দেন রবিউল ভাই। অার রবিউল মানেই অাড্ডা জমে ওঠা। বিচিত্র সব ভাবনায় তিনি সবার নজর কাড়েন।
পুত্রজায়ায় হারুন ভাইয়ের বাসায় রান্নার মূল দায়িত্ব নিলেন জিবু অার শাওন। এর মধ্যেই পেঁয়াজ, মরিচ কাটা থেকে শুরু করে রুমও পরিষ্কার করে ফেলেন রবিউল। অামি ছাড়া অন্য সকলেই রান্নায় রাখলেন বিশেষ অবদান। তবে রাত ৩টায় খাবারের টেবিলে আমি অার পিছিয়ে থাকলাম না। সবার অাগেই নিজের পাতের মাংস খেতে খেতে শাওন ভাইয়ের রান্নার প্রশংসা করতে দ্বিধাবোধ করলাম না।
পুত্রজায়া থেকে কেএলআইএ-২ এয়ারপোর্ট:
বৃহস্পতিবার ঈদের দুপুর থেকেই অামার ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি। হারুন ভাই তার গাড়িতে অামার ভার বহন করলেন। একই সঙ্গে রবিউল অার মিনহাজ। পুত্রজায়া সেন্ট্রালে পৌঁছালে দেখা মিললো মোহিনের। এখানে স্টুডেন্ট ভিসায় ঘোরাফেরাই করছে সে। তামিল ছবিতে দুদিনের শুটিংয়ের ফল ইতোমধ্যেই শূন্য হয়েছে তার, মনে করিয়ে দিলাম অামরা।
হোটেল অার বাসা থেকে বের হওয়ার একটা পার্থক্য রয়েছে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় থেকেই প্রিয় মুখগুলোর জন্য চাপা হাহাকার কাজ করতে শুরু করে। কয়েকবার করে জড়িয়ে ধরেও বিদায় নেওয়াটা কষ্টেরই থেকে যায়। অার হোটেল থেকে বের হতে পারলেই যেন বাঁচি।
কেএলঅাইএ এক্সপ্রেসে ১৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম এয়াপোর্টে। এর মধ্যেই বড় ভাই ফোন দিয়ে জানালো, বাসার চাবি দারোয়ানের কাছে রেখে যাওয়া হবে। অগত্যা খালি বাসাতেই উঠতে হচ্ছে অামাকে। আর বাংলানিউজে দেশের মহাসড়কের যানজটের খবরগুলো বুকের মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছিল। ২ বছর পরে এবারো যদি বাড়ি যেয়ে ঈদ করতে না পারি, অাফসোস থেকে যাবে।
মা ফোন দিলেও কথা দিলাম বাড়ি যাচ্ছি।
কেএলআইএ ২:
এয়ার এশিয়ার কতগুলো কাউন্টার রয়েছে এ কেএলআইএ২ এয়ারপোর্টে এটা গোনা মনে হয় না সম্ভব। যাই হোক খুঁজে বের করলাম ঢাকা ফ্লাইটের চেক-ইন কাউন্টার। সেখানে আমার হাতে ছোট একটি ৩ কেজি ওজনের ব্যাগ দেখে এগিয়ে অাসছেন অনেক দেশি ভাইয়েরা। শুক্রবার দেশে ঈদ। বোঝা গেলো ঈদের অাগের দিন ফ্লাইটটি পুরো লোড নিয়েই যাবে। তবে বেশি ওজনের মালামাল বহন করা ভাইদের হতাশ করে প্রত্যেকবারই অামি না সূচক মাথা নাড়িয়েছি। কয়েকজন অামাকে হয়তো মনে মনে গালিও দিচ্ছিল। তবে অহেতুক কারো মালামাল বহন করে অাবার কি বিপদে পড়ি! সে ভয় অামার কাজ করে।
৯টা ৫৫ এর ফ্লাইট উড়লো রাত ১০ টা ২০ মিনিটে। কারণ শুধু কাউন্টারে ব্যাগ ড্রপ করেই ক্ষান্ত হননি দেশি ভাইয়েরা। কেবিনের ভেতরেও যেসব সাইজের ব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করেছেন, বেশ জটিল হলো সেগুলো ম্যানেজ করা এয়ার এশিয়ার কেবিন কর্মীদের পক্ষে।
প্লেন ওড়ার অাগ পর্যন্ত দেশের পরিজনকে 'ছাড়বে এখনই' এই অাপডেটটি জানানো হতে থাকে।
আমার পাশের সিটে বসা কুমিল্লার কামরান ভাই ২০০৬ সাল থেকেই রয়েছেন মালয়েশিয়াতে। দ্বিতীয়বারের মতো দেশে ফিরছেন তিনি। শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমেই সোজা সায়েদাবাদ, সেখান থেকে কুমিল্লার বাস। বাড়িতে ১২ বছরের ছেলে এবং ৩ বছরের মেয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর:
বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা ১০ মিনিটে ল্যান্ড করে রানওয়েতে। কিন্তু পার্কিংতো দূরে থাক, থামার আগেই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে থাকেন যাত্রীরা। তবে দেশি কেবিন কর্মীদের মতো বকা দিচ্ছে না এয়ার এশিয়ার ভিনদেশিরা। তারা হয়তো বুঝতে পারছিলেন প্রিয়জনকে দেখার জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে রয়েছেন এ মানুষগুলো।
কোনো রকমে পার্কিং হতেই দৌড়। শাহজালাল অার্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের প্রতিটি ধাপেই হয়রানির অভিযোগ অামাদের ঈদ অানন্দকে মাটি করে দিতে যথেষ্ট। অামার জন্য অপেক্ষা করছিলেন বাংলানিউজের সহকর্মী অাব্দুল জাব্বার খান এবং জিএম মুজিবুর। অফিসের সিএনজিতেই পৌঁছাই বাসায়। কারণ গত জুলাইতে দেশে ফিরে সিএনজি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অনেক কষ্টের।
ঢাকার ঈদ:
শুক্রবার সকাল, আজ দেশে ঈদ। অনেকদিন পর প্রিয় মোটরসাইকেল খানা মুছে পরিষ্কার করলাম। তখন বাসার গ্যারেজে জবাই হওয়া ২টি গরুর মাংস কাটছেন মৌসুমী কসাইরা। অাহ অনেকদিন পর প্রিয় মোটর সাইকেল।
বাংলানিউজের অফিসে প্রবেশ করলে বোঝা দুষ্কর দেশে ঈদের ছুটি। অল্প সংখ্যক সহকর্মী থাকলেও খবর যে গরম ছড়াচ্ছে তাদের ব্যাস্ততা দেখেই বোঝা গেলো।
এডিটর-ইন-চিফ আলমগীর হোসেন হাসি দিয়ে বললেন, পুরা ট্যুরিস্ট হয়ে ঘুরতেছো। অাসলে ২ দিনের জন্য বাড়ি যাওয়ায় কোনো অতিরিক্ত কাপড় ছাড়াই রওনা দিয়েছি। শুনে বললেন, তাহলে দ্রুত রওনা দাও।
মোটরসাইকেল রেখে অফিস থেকে বেরিয়ে এবার রিক্সা। অাসলে মোটরসাইকেলের বাধায় ঢাকায় থাকলেও রিকশায় চড়া হয় না। অনেকদিন পর বেশ ফুরফুরে মেজাজে রিক্সায় হাওয়া খেতে চাইলাম। কিন্তু রোদের তেজ ভয়ংকর।
অনেক বছর পরই চড়লাম ঢাকার ২৭ নং বাসে। নোংরা সিট অার ভাঙাচোড়া গাড়ির ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দে ঢাকার রাস্তায় দুর্দান্ত গতিতে ঘুরে চাকা। ফাঁকা শহরে ২০ মিনিটেই পৌঁছে যাই শুক্রাবাদ, বড় ভাইয়ের শ্বশুরালয়ে। সেখানে অামাকে অবাক করে দিয়ে বসে অাছে জাইয়ান মাহমুদুল হক। প্রায় ৬ মাস বয়স তার। ১৪ দিন অাগেও দেশ ছাড়ার সময় দেখেছিলাম, বসতে চেয়ে বারবার ব্যার্থ হচ্ছিল অামার ভাতিজা।
ভুড়িভোজ শেষ করে গন্তব্য সদরঘাট। ব্যাটারিচালিত রিক্সা সিএনজি খরচ কমিয়ে দিলো। মাত্র ১০০ টাকাতেই সদরঘাট।
ঢাকা থেকে চাদঁপুর:
প্রায় সাড়ে ৩ বছর পর লঞ্চ ভ্রমণ। ময়ূর নামক লঞ্চে কেবিন ছাড়া সিট খালি নেই। স্ট্যান্ডিং যাত্রীও হয়েছে অনেক। কেবিন নিয়ে দীর্ঘ যাত্রার শরীরটাকে দু ঘণ্টার ঘুম উপহার দিলাম। এর অাগে অবশ্যই ফেসবুকে চেক-ইন।
যখন চোখ মেললাম, ততক্ষণে বুড়িগঙ্গা ছাড়িয়ে মেঘনায় লঞ্চ। লঞ্চ অার প্লেনের একটি মিল রয়েছে। মেঘের ওপরে উঠে অাধ ঘণ্টা পরই মেঘ দর্শন যেমন বেশি সুখকর নয়, তেমনি লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই বোঝা যায় নদীর পাড় উপভোগ করতে ধৈর্য লাগে। কারণ অাপাতদৃশ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। তবে শেষ বিকেলের সূর্য অামাকে ফটোগ্রাফি না জানার দুঃখটা ভুলিয়ে দিলো। ত্রিমোহরীতে এসে ফটাফট মোবাইলের ক্যামেরাকে ব্যাস্ত করে তুললাম। এখানে এসে মিলিত হয়েছে পদ্মা, মেঘনা অার ডাকাতিয়া নদীর মোহনা।
চাদঁপুর ঘাটে নেমে সে এক মৌমাছির চাকে এসে পড়ার মতো অবস্থা। কয়েকশত সিএনজি চালক একই সঙ্গে ভন ভন করে গন্তব্যস্থলের কথা বলে যাত্রীদের ডাকছে। শুনলাম, রামগঞ্জ রামগঞ্জ ডাকও।
ফতেপুরে:
একটু ক্লান্ত শরীরটায় ঘুম ঘুম চোখ। কিছুক্ষণের মধ্যেই চালক নিজেও জানালেন, তার ঘুম আসছে! এ কেমন চালকরে বাবা! কিছুক্ষণ পর জানালেন, তার ব্রেক কাজ করছে কম। তবে গরুর গাড়ি দিয়ে সিএনজি টেনে হলেও আমাদের রামগঞ্জ পৌঁছে দেবেন। ঘুম উধাও হয়ে গেলো। কথা বলে চালককে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করতে থাকলাম অামরা ৫ যাত্রী। তবে গত রাতে এক ফকিরের দরগায় গাঁজা টানার কথাও নিজেই জানালেন চালক!
দেড় ঘণ্টার সিএনজির পথ যেন সাড়ে ৪ ঘণ্টা লাগলো। রামগঞ্জ এসে দ্রুত সিএনজি পাল্টে নিলাম।
২০ মিনিট, এরপর আমার ফতেপুর গ্রাম। আমার বাবা-মা, ভাই, অামার স্বজনেরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৫
এমএন/আইএ