‘লোকে বলে, ও বলে রে/ঘর-বাড়ি ভালা না আমার/কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার...’ নিজের ঘর নিয়ে হাছন রাজা এমন কালজয়ী গান লিখে ঘরের প্রতি ‘অনীহা’র কথা জানান দিলেও তার খোঁজে জন্মভূমি সুনামগঞ্জে ছুটে যান হাজারো পর্যটক।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় ঘেঁষা তিন মরমী কবি-রাধারমন দত্ত, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিমের স্মৃতিবিজড়িত হাওর-বাঁওড়ের দেশ সুনামগঞ্জ।
এর উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে সিলেট জেলা এবং পশ্চিমে নেত্রকোনা জেলা।
রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে সিলেট বিভাগের এ জেলাটির দূরত্ব ৩৪৬ কিলোমিটার। জলাশয় প্রধান নদীগুলোর মধ্যে পুরো জেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে- সুরমা, কুশিয়ারা, ধামালিয়া, যাদুকাটা, বাগড়া, ডাহুকা, সোমেশ্বরী ও বাউলী।
এ জেলায় দেখতে পাবেন-
টাঙ্গুয়ার হাওর
ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার ১০টি মৌজা জুড়ে বিস্তৃত দেশের বৃহত্তম জলমহাল টাঙ্গুয়ার হাওর। মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইটও।
![](files/October2015/October14/2t_742760805.jpg)
মেঘালয়ের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম।
বর্তমানে মোট জলমহাল সংখ্যা ৫১টি এবং মোট আয়তন ৬ হাজার ৯১২ দশমিক ২০ একর। তবে নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একরে।
প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারি।
হিজল করচের দৃষ্টি নন্দন সারি এ হাওরকে করেছে মোহনীয়। এ ছাড়া নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি সহ দু’শ প্রজাতিরও বেশি গাছ রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে।
![](files/October2015/October14/3t_146206114.jpg)
এখানে রয়েছে ছোট বড় ১৪১ প্রজাতির ২০৮ প্রজাতির পাখি, এক প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ।
শীত মৌসুমে রেকর্ড ভেঙে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হয় টাঙ্গুয়ার হাওরে। বিলুপ্ত প্রায় প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে-কিংর্স্টক, শকুন এবং বিপুল সংখ্যক অতিথি পাখিও টাঙ্গুয়ার হাওরের অবিস্মরণীয় দৃশ্য।
স্থানীয় জাতের পাখি পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক নানা প্রকার বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সারস প্রভৃতির সমাহারও বিস্ময়কর।
সংশ্লিষ্টদের ধারণা, শীত মৌসুমের হাওরের প্রতিস্থানে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ অতিথি পাখির আগমন ঘটে। টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ-পাখি এবং উদ্ভিদের পরস্পর নির্ভরশীল এক অনন্য ইকোসিস্টেম। মাছের অভয়াশ্রম হিসাবে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
মরমী কবি হাছন রাজা জাদুঘর
সুনামগঞ্জ পৌরসভার তেঘরিয়ায় সুরমা নদীর পড়ে দাঁড়িয়ে আছে মরমী কবি হাছন রাজার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি। যা বর্তমানে মরমী কবি হাছন রাজা জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
জীবনে অসংখ্য গান রচনা করে আজ অবধি লোকপ্রিয়তার শীর্ষে আছেন ১৮৫৪ সালে জন্ম নেওয়া হাছন রাজা।
জাদুঘরে এ সাধকের ব্যবহৃত কুর্তা, খড়ম, তরবারি, পাগড়ি, ঢাল, থালা, বই ও নিজের হাতের লেখা কবিতা ও গানের পাণ্ডুলিপি আজও বহু দর্শনার্থীদের আবেগ আপ্লুত করে।
১৯২১ সালে মৃত্যু বরণ করেন এই সম্ভ্রান্ত জমিদার। পৌরশহরের গাজীর দরগা পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মরমী কবি হাছন রাজা। প্রতি বছর এ জাদুঘরে পর্যটকদের ব্যাপক সমাগম হয়।
চুনাপাথরের ‘বাড়ি’ টেকেরঘাটে
![](files/October2015/October14/4_522815951.jpg)
চুনাপাথরের প্রাকৃতিক ভাণ্ডার টেকেরঘাট। স্থানীয়দের বিচিত্র উপায়ে চুনাপাথর সংগ্রহের পদ্ধতি পর্যটকদের বেশ মুগ্ধ করে।
সিমেন্ট শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এই চুনাপাথরকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে গ্রামীণ আবহে পাহাড়ি খনি অঞ্চল। একদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মধ্য থেকে চুনাপাথর সংগ্রহ প্রক্রিয়ার আধুনিক আয়োজন। অন্যদিকে বিস্তৃত হাওর।
চুনাপাথর সংগ্রহকে কেন্দ্র করে টেকেরঘাটে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন ধর্মী এক জীবন প্রণালী। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলে চুনাপাথর সংগ্রহের কাজ।
পাগলা জামে মসজিদ
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাগলায় মহাসিং নদীর তীরে এ মসজিদের অবস্থান। মূলত নির্মাণশৈলী ও অপূর্ব কারুকাজের জন্য এ বিখ্যাত মসজিদটি। ১৯৩১ সালে শুরু হওয়া এ মসজিদের নির্মাণ কাজ চলে টানা দশ বছর। দোতলা এ মসজিদের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৫০মিটার।
![](files/October2015/October14/5t_325860329.jpg)
এছাড়া দেখতে পারেন সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের ভারত সীমান্তে প্রতিষ্ঠিত ডলুরা শহীদ সমাধি সৌধ, গৌরারং জমিদার বাড়ি, ছাতকে লাফার্জ-সুরমা সিমেন্ট কারখানা, জগন্নাথপুরে হযরত আছিম শাহ (র.) ও হজরত শাহ শামছুদ্দিন (র.) শাহের মাজার, রাধারমন দত্তের সমাধি ও নলুয়ার হাওর।
![](files/October2015/October14/3A_991293181.jpg)
হাতছানি দিচ্ছে দিরাইয়ের রাজানগরে নারকেল বাগানও। দিরাইয়ের পীর অকিল শাহের মাজার, ধল গ্রামের উজানধল পাড়ায় বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাড়ি এবং দোয়ারাবাজারে টেংরাটিলা গ্যাস ফিল্ডও দেখতে ভিড় করেন উৎসুখ মানুষ।
কীভাবে যাবেন?
বর্ষাকালে সুনামগঞ্জের সাহেববাড়ি নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা স্পিড বোটে সরাসরি টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়া যায়। সেখান থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ৫ ঘণ্টা এবং স্পিড বোটে ২ ঘণ্টা সময় লাগে।
এক্ষেত্রে খরচ পড়বে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আর স্পিড বোটে খরচ হয় ৮ থেকে ৯হাজার টাকা।
থাকার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাওরের তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউজ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে মোটর সাইকেল ও নৌকায় যাওয়া যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে।
![](files/October2015/October14/Hason_519149217.jpg)
তবে স্থানীয়ভাবে কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে সেখানে কোনো আবাসিক ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি।
সুনামগঞ্জ যেতে ঢাকা থেকে বিভিন্ন ধরনের বাস সার্ভিস রয়েছে। এছাড়া কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ হয়েও যেতে পারেন হাওর-বাঁওড়ের এই দেশে।
প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক।
আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।
![](files/October2015/October14/travelers_notebook__730868580.jpg)
বাংলাদেশ সময়: ০০২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৫
এমএ