ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৫

গালিবের সন্ধানে

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৫
গালিবের সন্ধানে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

দিল্লি থেকে ফিরে: উর্দু-ফারসি সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি তিনি। মৃত্যুর দু’শ বছর গত হওয়ার পরও যেনো তিনি এখনো বর্তমান।

তার রচিত গজল, কবিতা, কাসিদা, চিঠি ছড়িয়ে যাচ্ছে যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
 
মুঘলরা ভারতকে কি দিয়েছে? ইতিহাস তার হিসাব করুক। কিন্তু যদি বলি, মুঘলরা ভারত তথা বিশ্বকে দিয়েছে তিন উপহার- তাজমহল, উর্দু ও গালিব-তবে কি তা ইতিহাসের ভ্রান্তিবিলাস? হয়তো নয়। তাইতো সূর্য ডুবে যাওয়ার দু’শ বছর পরও সে আলোতেই খুঁজে ফেরে কবি তার কবিতাকে, প্রেমিক তার প্রেমিকাকে।

দিল্লি গিয়ে গালিবের সন্ধান করবো না তা কি হয়? তাইতো যতোবার দিল্লি ততোবারই গালিব।

হয়তো শত বছর আগের গালিব নিজেও তা জানতেন। কেউ একজন জানতে চেয়েছিলেন দিল্লিতে তার পোস্টকোড ও ঠিকানা। গালিবের জবাব, ‘মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব, দিল্লি’। সবাই কবি নন, কেউ কেউ কবি। কবিরা মহাকালকে দেখতে পান সমকালেই। তাইতো, শতবর্ষ পরেও গালিবের সন্ধান করি দিল্লিতে। অন্ধ চোখে খুঁজে ফিরি মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া গালিবকে। খুঁজে পাই উদ্ভাসিত কালজয়ী এক গালিবকে।

গালিব নামটিও তিনি ছদ্মনাম হিসেবে নিজেই দিয়েছেন। যার অর্থ জয় করে নেয় সবকিছু, সবচেয়ে উত্তম, ভালোর চেয়ে ভালো, যার থেকে ভালো আর হয় না। কি করে জানতেন কবি, দু’শ বছর পরেও তিনি ‘গালিব’ হয়েই থাকবেন।

কিন্তু কবির শুরুটা এরকম ছিল না। নিজের লেখা চিঠিতেই কবি বয়ান করেছেন, “আমার দাদাজান সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালে তুর্কিস্থান থেকে ভারতে চলে আসেন। সে এক টালমাটাল সময়। তবু এখানে এসেই তার ভাগ্যে জুটে গেল সর্বাধিনায়কের চাকরি, যার অধীনে পঞ্চাশটি ঘোড়া। সে চাকরি বেশিদিন টেকেনি। রাজনীতির উত্থান পতনে এ চাকরি যেতে সময় লাগেনি। আমার পিতা মির্জা আবদুল্লাহ বেগ চাকরি করতেন লখনৌর নবাব আসাদুল্লাহর অধীনে। এর পর তিনি কাজ পান দাক্ষিণাত্যের নিজামের অধীনে তিনশ’ ঘোড়া নায়কের। অন্তর্বিপ্লব সেখানেও আঘাত হানে, খুইয়ে বসেন চাকরি। বিভ্রান্ত হয়ে আলোয়ারের রাও রাজা বখতুয়ার সিংয়ের অধীনে চাকরি দেন। সংঘর্ষে তার মৃত্যু হয়। ’’

খুব অল্প বয়সে পিতৃহীন হন গালিব। আশ্রয় নেন চাচা নসরুল্লাহ বেগের কাছে। ১৮০৩ সালে চাচাও হাতি থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। আর চাচার জায়গীরটিও ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।

অর্থাৎ শৈশব থেকেই কবি অনাথ। এ অনাথ জীবনের জন্যই হয়তো গালিব ছিলেন জীবন সম্পর্কে এক উদাসীন ব্রহ্মচারী। নিজের স্ত্রী, পরিবার এমনকি নিজের জীবন সম্পর্কেও ছিল না তার কোনো নিত্য আয়োজন।

মুঘল রাজদরবারের এক আমীরের মেয়েকে বিয়ে করেন গালিব। তারপর জীবনের তাগিদে আগ্রা থেকে দিল্লি। মুঘলরাও তাই। আগ্রা থেকে দিল্লি আবার আগ্রা। গালিব মুঘল পুরুষ ছিলেন না, কিন্তু নানাভাবেই গালিবের জীবন মুঘল-নিয়তিতেই গাঁথা।   

পর পর সাত সন্তানের মৃত্যু গালিবকে দুঃখের সাগরে নিক্ষেপ করে চিরদিনের জন্য। কবি মদ খান বলে বিবি উমরাও বেগম তার হাতের ছোঁয়াও খান না। কিন্তু গালিব তো জয় করে নেয় সবকিছু। তাই শত বেদনার মাঝেও কবি সন্ধান করেন জীবনের। গালিব হৃদয় যেন বেদনার নীল সাগর। গালিব একইসঙ্গে দুঃখের কবি অন্যদিকে হাসি, কৌতুক আর রসবোধ তার জীবনেরই অনুসঙ্গ।

একদিনের কথা। রমজান মাস। দিনের বেলা ঘরে বসে পাশা খেলছেন কবি। বন্ধু গালিবকে দেখে প্রশ্ন করলো, মির্জা, রমজান মাসে শয়তানকেও আটকে রাখা হয়, আর তুমি পাশা খেলছো? গালিবের জবাব, শয়তানকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে, এটাই সেই ঘর।

উত্থান আর পতনের মাঝেই কবির জীবন। গালিব জীবন উত্থান পতনের শ্রেয়তর উদাহরণ। যেমন আমাদের নজরুল।

মুঘল সাম্রাজের শেষ ও ব্রিটিশ রাজত্বের রাজসাক্ষী গালিব। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আওয়াজ শুনেছেন, দেখেছেন। শুনেছেন ব্রিটিশ বিজয় নিশান ওড়ানোর পদধ্বনিও।  

গালিব ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারের কবি। পেয়েছেন দাবির উল মুলক উপাধি এমন কি নজম উদ দৌলা (কবিতার অধিশ্বর)। বাহাদুর শাহ গ্রহণ করেছেন তাকে বন্ধু হিসেবে। বাহাদুর গালিবকে মানতেন ‘মুরশিদ’— মানে দর্শনগুরু হিসেবে।  

বাহাদুর শাহও যে এক কবি। একজন হারিয়েছেন সাড়ে তিনশ’ বছর রাজত্বের উত্তরাধিকার। আরেকজন হারিয়েছেন রাজদরবারের পদবি।

বাহাদুর যেমন ছিলেন ব্রিটিশের হাতে পর্যুদস্ত হওয়া এক ট্র্যাজিক নায়ক, আর গালিব তেমনি এক ট্র্যাজিক কবি। দুজনেই বেদনার নায়ক ও কবি।

বাহাদুর শাহ আজ নেই। হারিয়ে গেছেন মুঘলদের ইতিহাসের মাঝে। কিন্তু আরেকজন মুঘল কবি গালিব আজও বেঁচে আছেন। দুশ’ বছর পরে। মুঘল রাজত্ব হারিয়ে গেছে। কিন্তু গালিব রাজত্ব আজও বহাল। যেন গালিবই শেষ মুঘল সম্রাট। শাসন করছেন দুশ’ বছর পরেও। হয়তো করবেন আরো হাজার বছর।

মুঘল সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর গালিবকে হাত পাততে হয়েছিল ব্রিটিশ রাজের কাছে। এমনকি ছোট ছোট নবাব ও বন্ধুদের কাছেও। নবাব আলী খান তাকে সাহায্য করতেন কখনো কখনো। একদিন বেরিরি যাওয়ার সময় নবাব বললেন, “মির্জা সাব, খোদা কো সোপা...তোমাকে খোদার ওপর সপর্দ করে গেলাম”। মির্জা বললেন, “বলেন কি হুজুর। খোদা নে মুঝে আপকে সপর্দ কিয়া, আপ ফির খোদা কে সপর্দ দেতে হ্যায়”।

দুশ’ বছরের পুরনো সেই গালিবকে খুঁজতে গিয়েছি দিল্লিতে। হেঁটেছি দিল্লির পথে পথে। খুঁজে ফিরেছি নিজামুদ্দিন এমনকি গালিব বিধৌত ইতিমদ্দৌলার বাগানেও। গালিব একাডেমিতেও খুঁজেছি সেই বেদনার কবিকে। কথা বলেছি নিজামুদ্দিনের গালিব একাডেমির সেক্রিটারি ড. আকিল আহমেদের সঙ্গে। খুঁজে পাইনি বেদনার এই মহানায়ক-কবিকে।

গালিব বেঁচে আছেন তাঁর গজলে, কবিতায়, কাসিদায় ও চিঠিতে। যে চিঠি হাজার বছর পরেও পৌঁছে যাবে অনাগতের হাতে।

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৫
এএ

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪: নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।