ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

কলকাতায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৫ ঘণ্টা, জুলাই ৩, ২০১৭
কলকাতায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা কলকাতার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ছবি: ড. মাহফুজ পারভেজ

রথতলা-বেলঘড়িয়া (উত্তর কলকাতা) থেকে: গঙ্গা তীরের অনিন্দ্য সকাল দিয়ে শুরু হলো শনিবারের দিনটা (১ জুলাই)। গতরাতে প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় পথঘাট তখনো কিছুটা জলমগ্ন। জল ভেঙে টেক্সিতে পথে নেমেছি। ঢাকার উবারের মতো কলকাতায় ওলা (ওএলএ-অনলাইন এপ্লিকেশন) চমৎকার টেক্সি সার্ভিস দেয়। মোবাইল ফোনের অ্যাপ থেকে ডেকে পাঠালেই চলে আসে গাড়ি। পরে বেঙ্গালুরুতে দেখেছি এয়ারপোর্ট, মার্কেট ও নানা স্থানে ‘ওলা জোন’। ওখান থেকেও গাড়ি নেওয়া যায়। কোথায় যাচ্ছে, কত ভাড়া হচ্ছে, সবই মোবাইলে দেখা যাচ্ছে। পুরো বিষয়টাই কম্পিউটারাইজড। মহানগরগুলোর কুখ্যাত দালালের চক্কর, দর-দামের ঝামেলা বা ফেরেববাজির ঝুঁকির কোনও বালাই নেই।

ওলা করে ভোরের দিকে উত্তর কলকাতার জেটি ঘাটের দিকে আসতে দূরে বেলুড় মঠের কাঠামো দেখা গেল। ঘাটের দিকটায় তখনই লোকজনের ভিড়।

সেখানে একটা কাজ সেরে রিকশা করে আড়িয়াদহ যেতে যেতে বিহারি চালক হিন্দি মেশানো বাংলায় জানালো, ‘পাশেই দক্ষিণেশ্বর মন্দির। দুপুর এগারোটা পর্যন্ত পূজা চলবে। ’ মন্দিরের সামনেও দেখা গেল জনসমাগমের চিত্র। ফুল, প্রসাদ, পুজাসমাগ্রীর অনেক দোকান পুরো এলাকা জুড়েই রয়েছে। কিছু হোটেল আর খাবারের দোকান ছাড়াও পথে পড়ল হীরালাল মহিলা কলেজ।

তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে

আড়িয়াদহ চিত্রনায়ক উত্তমকুমারের জন্মস্থান বলে শুনেছিলাম। সাধারণ একটা পাড়ার মতো এলাকাটা। রাস্তা সামনে এগিয়ে শেষ হয়েছে রথতলার মোড়ে বি.টি. রোডে। উত্তরের ব্যারাকপুর থেকে কলকাতার কেন্দ্র ও দক্ষিণে যাতায়াতের প্রধান পথই হলো এই বি. টি. রোড বা ব্যারাকপুর ট্র্যাঙ্ক রোড। রাস্তার সর্বউত্তরে ব্যারাকপুর আর দক্ষিণে শ্যামবাজারের পাঁচ মাথা হয়ে কলেজ স্ট্রিট, চৌরঙ্গি থেকে দক্ষিণে চলে গেছে। আরো অনেক শাখা সড়ক ছড়িয়ে গেছে কলকাতার নানা দিকে।  

রথতলা মোড়টি চৌরাস্তা। মোড়ে নজরুল মঞ্চ সংলগ্ন  কামারহাটি পৌরসভা ভবন। পৌরসভার সামনে ছোট্ট উদ্যানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নেতাজি সুভাস বসুর পূর্ণদেহ ভাস্কর্য। বি.টি. রোড ধরে দক্ষিণ দিকে কিছুটা এগিয়ে ক্ষুদিরাম বসু হাসপাতাল। তার পাশেই স্পেনসার শপিং মল। সেখানে ঈষাণ আবাসিক এলাকায় শিক্ষয়েত্রী রূপালী রায়ের অ্যাপার্টমেন্টে তার আত্মীয়দের সঙ্গে আমার দেখা করার কথা। খুলনা অঞ্চল থেকে পিতামহের হাত ধরে এই পরিবার কলকাতায় এসেছিল পঞ্চাশের দশকে। বাবা, চাচারাও মারা গেছেন বহু আগে। তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে প্রৌঢ়ত্বের কাছাকাছি। স্মৃতি হাতড়ে কিছু পূর্বস্মৃতি পেলাম তাদের কাছ থেকে। স্মৃতিরা ক্রমেই ঝাপসা হচ্ছে বোঝা গেল।

খুব বেশিক্ষণ বসা গেলো না এখানে। তথ্য প্রযুক্তির যুগে কে কোথায় আছে, সেটা বিশেষ একটা লুকিয়ে রাখা যায় না। বাংলাদেশের নানা স্থানের, বিশেষত আমার কর্মস্থল চট্টগ্রামের অনেকেই উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতায় বসবাস করছে। ফেসবুক ইত্যাদির বরাতে সাবেক ছাত্র ও জুনিয়র সহকর্মীদের কাছ থেকে আমি কলকাতায় আছি খবর পেয়ে ফোন করলো কলকাতায় অধ্যয়নরত গাজি আবদুন নূর, ‘সামনেই সিঁথির মোড়ে বাংলাদেশের চায়ের দোকান বললেই সবাই দেখিয়ে দেবে। আপনি আসুন স্যার। আমরা অপেক্ষা করছি। ’দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সামনে ছবি: ড. মাহফুজ পারভেজ

কলকাতায় বৃত্তি বা ব্যক্তিগত উদোগে প্রায়-হাজার খানেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা উপলক্ষ্যে বসবাস করে। দক্ষিণের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাদে মধ্য ও উত্তর কলকাতার শিক্ষার্থীরা এদিকেই দলবদ্ধ হয়ে থাকে বাসা বা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে। বাংলাদেশের সীমান্তে ট্রেনে, বাসে যাওয়ারও সুবিধা বেশি এখান থেকে। এদিকের বাসিন্দাদের অধিকাংশের ব্যাকগ্রাউন্ড পূর্ববঙ্গের। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও উত্তর কলকাতার বি.টি. রোডেই। কলকাতার কেন্দ্রস্থলের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পুরোটাই যাদুঘর ও সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ও দাপ্তরিক কাজ উত্তর দিকেই সম্প্রসারিত হয়েছে। রথতলা থেকে সরাসরি সিঁথির মোড়ের দিকে যাওয়া সম্ভব হলো না। পাশেই স্বরসতী প্রেস কোয়ার্টারে আমার কাজ রয়েছে। ওখানে কাজল বাবু অপেক্ষা করছেন।

বাংলাদেশের ঢাকার তেজগাঁয়ের বিজি প্রেসের মতোই পশ্চিমবঙ্গের সরকারি মুদ্রণালয় স্বরসতী প্রেস। পাশেই বিশাল এলাকা নিয়ে আবাসিক কোয়ার্টার। ঢাকার আজিমপুর বা মতিঝিল কলোনির মতো ব্যাপার। ভেতরে চমৎকার একটি শান বাঁধানো পুকুর, খেলার মাঠ ও পূজার স্থান। কাজল বাবু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের মানুষ। অবসর নিয়ে বসবাস করেন কলকাতায়। তার স্ত্রী মমতা কর কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের মানুষ। সন্তানদের দিল্লি, বেঙ্গালুরুতে চাকরির জন্য পাঠিয়ে ঝাঁড়া হাত-পায়ে বেশ নির্ঝঞ্জাট আছেন। আমার আসার খবরে আরও কয়েকজন পরিচিতজনকেও ডেকে এনেছেন তিনি। বেশ অনেকক্ষণ আলাপ হল নানা প্রসঙ্গে। সাক্ষাতকারে উচ্ছ্বাস বা আবেগের বদলে ভদ্রলোক বেশ কিছু ইতিবাচক তথ্য দিলেন অতীত দিনের। মানুষ বুড়ো হলে বা দূরে গিয়ে বসবাস করলেও যে প্রীতি ও সুখানুভূতির দিকগুলোকে মনে রাখেন, কাজল বাবু তার উজ্জ্বল উদাহরণ। চমৎকার একটি কথা বললেন তিনি, ‘ভুলে যাওয়া নয়, মনে রাখাই জীবন। জীবনের ভালো ও আনন্দময় দিকগুলো যত মনে রাখা যাবে, জীবনও ততই সুন্দর আর আনন্দময়  হবে। ’

বেশ দার্শনিকোচিত উক্তিই বটে। জীবনের অভিজ্ঞতার ময়দান থেকে পাওয়া ভালো ও মন্দ থেকে ভালত্বকে গ্রহণ করাই তো ইতিবাচকতা, মানবিকতা ও উদারতার লক্ষ্যণ। মানুষ এ কথাটা যত মনে রাখে, ততই নিজেকে ও পারিপার্শ্বকে সৌন্দর্যময় করতে পারে।

হাতে সময় ছিল না বলে আমাকে উঠতে হলো। মহৎ আলোচনায় আরও সময় দিতে পারলে বেশ লাগতো। সেটা আর হলো না। তবে কাজল দম্পতিও কথা বাড়ালেন না। আবার আমাকে সহজে ছাড়লেনও না। মধ্যাহ্নভোজ করেই তবে নিস্তার পাওয়া গেলো।    

বি.টি. রোড ধরে কলকাতা শহরের দিকে যেতে ডানলপ একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। বিভিন্ন দিকে যাওয়ার রাস্থা বের হয়েছে এখান থেকে। ফ্লাইওভার, ট্রেন লাইন সবই আছে। এলাকাটায় শিখ সম্প্রদায়ের ভালো একটি বসতি আছে, সেটা টের পাওয়া যায় ‘খালসা স্কুল’-এর অবস্থান দেখে। ‘ড্রাইভিং ও অন্যান্য কাজে নিয়োজিত পাঞ্জাববাসী শিখ জনগোষ্ঠী এদিকটায় বেশি বাস করে’, জানালেন আমাকে বহনকারী  ওলা টেক্সির ড্রাইভার মহেন্দ্র। পাঞ্জাবিরা যে দূরপাল্লার হেভি ভেহিক্যালের ড্রাইভিং-এ যথেষ্ট পারদর্শী, এ কথা কে না জানে!

বি.টি. রোডের উপরই বনহুগলি নামের জায়গায় ভারতখ্যাত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের দপ্তর। ইন্ডিয়ান  স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের বৃক্ষ শোভিত চমৎকার কম্পাউন্ড দেখে প্রশান্ত কুমার মহালনবিশের কথা মনে পড়ল, যিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। ভারতের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক বহু অবদান রয়েছে। নেহেরুর পছন্দের প্রশান্ত কুমারের নানা কৃতিত্বের কথা সে আমলের অনেক গুণিজনই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। রথতলার মোড়ে নেতাজি ও  রবীন্দ্রনাথে ভাস্কর্য ছবি: ড. মাহফুজ পারভেজ

সিঁথির মোড়ে যথারীতি আবদুন নূরকে পাওয়া গেল। যশোরের এই ছেলেটি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করছে। এক প্রকার জোর করেই সে আমাকে কাছেই একটি চমৎকার বহুতল ভবনের নান্দনিক অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে এলো। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে আরও কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। দুপুরে খেয়ে এসেছি জেনে তারা সত্যিই মর্মাহত হলো। আমার জন্য না খেয়ে বসে আছে জেনে স্বাভাবিকভাবে আমারও খুব খারাপ লাগলো। চেনা-জানা-পরিচিত মানুষ, স্বজন, স্বদেশবাসীর জন্য মানুষের মমত্ত এক শাশ্বত অনুভূতি। বিদেশে সেটা আরও তীব্র হতে দেখলাম।

অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি রুমে তিনজন করে থাকে। আবদুন নূর বললো, ‘আশপাশে বহু অ্যাপার্টমেন্টে ছেলে এবং মেয়েরা আলাদাভাবে থাকে। ’ আমি এসেছি জেনে কিছুক্ষণ পরেই এলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী আরজুমান্দ আরা বকুল, সঙ্গে তার মেয়ে আরিয়া ফারি। ‘আমার মেয়ে এখানে ড্যান্স নিয়ে পড়ছে। আমি প্রতি মাসে একবার মেয়ের কাছে আসি’, জানালেন তিনি। কৌশিক রায় নামের একজন শিক্ষকও এলেন। হুগলির আরামবাগ অঞ্চলের বাসিন্দা রায় বাবু বললেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা খুবই মেধাবী ও পরিশ্রমী। অনেকেই এখানে পড়াশোনায় উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের ছাপ রাখছে, ভালো রেজাল্ট করছে। ’ তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা বৃত্তির সংখ্যা বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক বিকাশে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলেও তিনি মনে করেন।      

আলাপে আলাপে কখন যে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে টের পেলাম না। সম্বিৎ ফিরে পেলাম ট্র্যাভেল এজেন্সির ফোন পেয়ে। আগামীকাল (রোববার ২ জুলাই) আমার বেঙ্গালুরু ফ্লাইটের বুকিং রয়েছে। এজেন্সি জানালো, বিশেষ কারণে আজ (শনিবার ১ জুলাই) রাতেই আমাকে ফ্লাইট ধরতে হবে। অতএব আর বসা হলো না। আবার ওলা কোম্পানি টেক্সিওয়ালে ফোন করে অল্পক্ষণেই গাড়ি পেয়ে গেলাম। চট জলদি বি. টি. রোডে নেমে টালা হয়ে শ্যামবাজারের পাঁচ মাথা পেরিয়ে মধ্য কলকাতার দিকে ছুটে চলে গাড়ি। হোটেলের সামনে গাড়ি অপেক্ষায় রেখে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ছুট লাগালাম দমদমের দিকে নেতাজি সুভাস বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পথে। কলকাতার মধ্য, উত্তর, পূর্বাঞ্চলের বেশ অনেকটাই ছুঁয়ে যাওয়া হলো আসা-যাওয়ার সুবাদে।    

বিমানবন্দরের পথে মানুষ আর গাড়ির চাপে থেমে থেমে পথ চলতে মনে পড়ল ভারতের চতুর্থ সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য এই পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। আয়তন ৩৪,২৬৭ বর্গমাইল বা ৮৮,৭৫০ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গমাইলে ২৭০০ জন। পরিসংখ্যানটি অবশ্য ২০১১ সালের এবং অবশ্যই শহরাঞ্চলের জন-ঘনত্ব আরও বেশি। রাজধানী কলকাতার পর বৃহৎ নগর ধরা হয় শিলিগুড়িকে। ভারতের আদি রাজ্যগুলোর একটি এই পশ্চিমবঙ্গ, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার দিনই রাজ্যটি বৃহৎ বাংলা ভেঙে  প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৫০ সালে দেশীয় রাজ্য কোচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ ভারত সরকরের সঙ্গে চুক্তি করে নিজের রাজ্যকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত করেন। ১৯৫৫ সালে ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। বিহার-ঊড়িষ্যার কিছু অঞ্চলও বাংলায় এসে যুক্ত হয়। পুরুলিয়া জেলাটি এমনই একটি যোগদানকারী এলাকার সমষ্টি।   বাংলা ভাষায় ‘পশ্চিমবঙ্গ’ উচ্চারিত হলেও ইংরেজিতে প্রদেশটির সরকারি নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’।   বর্তমান রাজ্যপাল বা সাংবিধানিক প্রধান হলেন কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। সরকার প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মত পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। রাজ্যের সকল নাগরিকের জন্য সার্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত। পশ্চিমবঙ্গের আইনসভা ‘বিধানসভা’ নামে পরিচিত। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এই বিধানসভা গঠিত। বিধানসভার সদস্যরা একজন অধ্যক্ষ ও একজন উপাধ্যক্ষ নির্বাচিত করেন। অধ্যক্ষ অথবা উপাধ্যক্ষ (অধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে) বিধানসভা অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন। কলকাতা হাইকোর্ট ও অন্যান্য নিম্ন আদালত নিয়ে রাজ্যের বিচারবিভাগ গঠিত। শাসনবিভাগের কর্তৃত্ব ন্যস্ত রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার উপর। রাজ্যপাল রাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রধান হলেও প্রকৃত ক্ষমতা সরকার প্রধান মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত। রাজপাল নিয়োগ করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি, অবশ্যই সেটা ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে। বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করেন। মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজ্যপালই অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন। মন্ত্রিসভা আইনসভা তথা বিধানসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকে।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা এককক্ষীয়। এই সভার সদস্য সংখ্যা ২৯৫ জন, এদের মধ্যে ২৯৪ জন নির্বাচিত এবং একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় থেকে মনোনীত। বিধানসভার সদস্যদের বিধায়ক বলা হয়। বিধানসভার স্বাভাবিক মেয়াদ পাঁচ বছর। তবে মেয়াদ শেষ হবার আগেও বিধানসভা ভেঙে দেওয়া যায়। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলো যথাক্রমে পঞ্চায়েত এবং পুরসভা নামে পরিচিত। এই সকল সংস্থাও নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতের দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা/সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিম্নরূপ: নিম্নকক্ষ লোকসভায় ৪২ জন এবং উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ১৬ জন। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলার শাসনভার একজন জেলাশাসক বা জেলা কালেক্টরের হাতে ন্যস্ত। তিনি ‘ইন্ডিয়ান এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস বা ‘আইএএস’ কিংবা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস’ বা ডব্লিউবিসিএস’-এর নিযুক্ত কর্মকর্তা। প্রতিটি জেলা একাধিক মহকুমায় বিভক্ত। মহকুমার শাসনভার ‘মহকুমা-শাসক’-এর হাতে অর্পিত। মহকুমাগুলো আবার ব্লকে বিভক্ত। ব্লকগুলো গঠিত হয় পঞ্চায়েত ও পুরসভা নিয়ে।  

ভারতের নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে কৃষিপ্রধান পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ষষ্ঠ। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয়, ধর্মঘট ও সহিংস মাকর্সবাদী-নকশালবাদী আন্দোলনের ফলে রাজ্যের শিল্প পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। শুরু হয় অর্থনৈতিক স্থবিরতার যুগ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয দেয় এবং অর্থনৈতিক চাপে পড়ে। সে সময় সশস্ত্র নকশাল আন্দোলনও তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৭৪ সালে রাজ্যে বসন্ত মহামারীতে কয়েক সহস্র মানুষ মারা যায়। এ সময় রাজ্যের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে এবং দক্ষিণপন্থি তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত (২০১১ সাল) একটানা শাসন চালায়।

১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে ভারত সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ২০০০ সালে সংস্কারপন্থি নতুন বামপন্থি মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শাসনামনে রাজ্যের অর্থনৈতিক চাকা সচল হয়। ২০০৬ সালে হুগলির সিঙ্গুরে টাটা-ন্যানো কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে তীব্র গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। বির্তক ও সংঘাতের মুখে টাটা গোষ্ঠী পরিকল্পনা প্রত্যাহার করলে রাজ্য রাজনীতিতে গভীর প্রভাব পড়ে। ২০০৭ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে অশান্তির জেরে পুলিশের গুলিতে ১৪ জন মারা গেলে রাজ্য রাজনীতি ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০১০ সালের পৌরনির্বাচনে শাসক বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অবশেষে ২০১১ সালে ক্ষমতার পূর্ণ পালাবদল হয়। বামফ্রন্টকে হটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসে, যাদের শাসন এখনো অব্যাহত। ভারতের অন্যান্য অংশের মতো ব্যাপক হারে না হলেও রাজ্যে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি’র ক্ষমতা ও সমর্থন বাড়ছে।  

রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হলেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। দার্জিলিং হিমালয়ান রেল এবং সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান পশ্চিমবঙ্গের দুটি ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য। সুন্দরবন অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ অরণ্য গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের একটি গুরত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। রাজ্যের সর্ব-উত্তরে অবস্থিত দার্জিলিং পূর্ব-হিমালয়ের একটি অংশ। রাজ্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘সান্দাকফু’ এই অঞ্চলে অবস্থিত, যার উচ্চতা ৩,৬৩৬ মিটার বা ১১,৯২৯ ফুট। এই পার্বত্য অঞ্চলকে দক্ষিণে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে সংকীর্ণ তরাই অঞ্চল। অন্যদিকে রাঢ় অঞ্চল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপকে বিচ্ছিন্ন করেছে পশ্চিমের মালভূমি ও উচ্চভূমি অঞ্চল থেকে। রাজ্যের সর্বদক্ষিণে একটি নাতিদীর্ঘ উপকূলীয় সমভূমিও বিদ্যমান।  

মূলত পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী হলেও কলকাতা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর প্রধানকেন্দ্র। যেমনভাবে উত্তরাঞ্চলের প্রধানকেন্দ্র দিল্লি, পশ্চিমাঞ্চলের জন্য মুম্বাই আর দক্ষিণাঞ্চলের জন্য চেন্নাই। এর বাইরেও ভারতের অনেকগুলো শহর শ্রেষ্ঠত্বে ক্রমে ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে। বিশেষায়িত পারঙ্গমতায় অন্ধের হায়দারাবাদ আর কর্নাটকের বেঙ্গালুরু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে যথেষ্ট এগিয়ে গেছে। হায়দারাবাদকে বলা হয় সাইবারাবাদ। ভারতের আইটি ও তথ্য প্রযুক্তির এই শহর বৈশ্বিক গুরুত্ব লাভ করেছে। বেঙ্গালুরু শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রযুক্তির দিক থেকে দ্রুতবেগে এগুচ্ছে। বেঙ্গালুরুকে বলা হয় পৃথিবীর দ্রুতগতির শহরগুলোর অন্যতম। গার্ডেন সিটিও বলা হয় ফুলের সমারোহের জন্য। কেউ কেউ আবার বলেন হেলথ সিটি বা সাইবার সিটি। ডা. দেবি শেঠির নারায়ণা হাসপাতালের জন্য বেঙ্গালুরু বিশ্বের চিকিৎসা মানচিত্রে বড় একটি জায়গা করে নিয়েছে। নারায়ণা হৃদয়ালয় নিজেকে দাবি করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হৃদরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র হিসাবে।

ক’দিন বেঙ্গালুরুতে কাটিয়ে আবার কলকাতায় আসার ইচ্ছা নিয়ে প্রবেশ করলাম বিমানবন্দরে।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, জুলাই ৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।