ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

‘বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই!’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪২ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৭
‘বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই!’ চিকিৎসা প্রার্থীদের জনারণ্যে সিংহভাগই বাংলাদেশি। ছবি: ড. মাহফুজ পারভেজ

বেঙ্গালুরু (কর্ণাটক) থেকে: শনিবার (১ জুলাই) রাতে কর্ণাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরু এসে হোটেলের আশেপাশে ছাড়া বাইরের দিকে যাওয়ার সুযোগ হয় নি। বিমানবন্দর থেকে আসার পথে যতটুকু সম্ভব দেখেছিলাম গতি আর বাগানের শহরটিকে।

পরদিন ছুটির দিন (রবিবার ২ জুলাই) ভোরে ভোরে বের হয়ে মন-প্রাণ উৎফুল্ল হয়ে গেল। চারদিকে ঝকঝকে পরিবেশ।

পুষ্পময় চারপাশ। শরৎ-হেমন্তের শরীর প্রশান্ত করা বাতাস। ঢাকা বা কলকাতার গরমের বদলে হিম হিম বাতাসে সকালের মনোরম পরিবেশে প্রাতঃভ্রমণটা অতুলনীয় হলো। এমন মনোলোভা পরিবেশ ছেড়ে সহজেই ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হয় না। ভাবলাম বেশ বড় একটা হাঁটাহাঁটি করে স্বাস্থ্য-উদ্ধার ও নতুন শহরটি দেখে নাস্তা করেই ফিরবো।

বাগান ও গতির শহর বেঙ্গালুরু

ছুটির দিন হলেও মানুষের চলাচলের বিরাম নেই। দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত পোশাক হাফহাতা শার্ট আর শাড়ির মতো লুঙ্গিতে স্থানীয় মানুষ কাজে-কর্মে নেমে গেছেন। লুঙ্গিও অনেকগুলোই আবার শাড়ির মতো রঙ-বেরঙের পাড় দেওয়া। মোটর সাইকেলে যুৎসইভাবে হাট-বাজার করেও ফিরছে অনেকেই। মেয়েদের ভেসপা ধরনের মোটর সাইকেলে চলাচল করতে দেখা গেল।

আরেকটি বিষয় খুবই চমৎকার। পথে হৈ-হট্টগোল, অতিরিক্ত হর্ন বা শব্দ দুষণের মাত্রা নেই।

কাজের বাইরে অলস ও অকেজো লোকজনের জটলা বা আড্ডাবাজিরও দেখা পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে আমি বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট ছোট আবাসিক এলাকা অতিক্রমকালে দেখি মোড়ে মোড়ে তাজা শাক-সবজির ভ্যান। স্বাস্থ্যবান, সতেজ ও সবুজ সবজির বাহারে চোখ ও মনের আরাম হলো। মোড়ে মোড়ে পেলাম তাজা ফলের দোকান। বিভিন্ন ধরনের ফলের পিস দিয়ে চমৎকারভাবে প্লেট সাজানো। হাতে গ্লাভস লাগিয়ে নারী ও পুরুষ ফল বিক্রেতার লোভনীয় ফলের আয়োজন সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সাত-আট ধরনের ফলের পিস রয়েছে একেকটি প্লেটে। কুড়ি রুপি দিয়ে এক প্লেট খেয়ে অতুলনীয় তৃপ্তি পেলাম।   ডাব খেলাম একটি। আহ! অনেক দিন স্বাদ মনে থাকবে।

খাবার-দাবার ছাড়াও সাধারণ পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান নাগরিকদের মধ্যে খুবই বেশি। পৌর সংস্থাগুলোও মনে হচ্ছে যথেষ্ট তৎপর, সচেতন ও কর্মিষ্ঠ। পথে-ঘাটে ময়লার স্তূপ নেই। বাসা বা দোকানের সামনের দিকটা পরিচ্ছন্ন। আমি যে অঞ্চলে হাঁটছি সেটা অনেকগুলো হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য স্থানীয়-অস্থানীয় মানুষের সমাগমে জনবহুল। ফলে নানা ধরনের ময়লা, প্যাকেট ইত্যাদি বেশি হওয়ারই কথা। কিন্ত সে রকম কিছু চোখে পড়েনি।

বেঙ্গালুরুর আরেকটি বৈশিষ্ট্য নজর কাড়ে। বিভিন্ন শহরে যেমন খানিক পর পরই চা বা পান-সিগারেটের দোকান থাকে, এখানে তেমনটি নেই। প্রকাশ্যে ধূমপানের প্রবণতাও দেখা গেল না। স্বাস্থ্য সচেতনতায় শহরের মানুষগুলো অগ্রণী। দুপুরের দিকে সে প্রমাণও পেয়েছিলাম। কয়েকটি হাসপাতাল দেখতে গিয়ে জনারণ্যের যে ভিড় পেয়েছি তার সিংহভাগই বাংলাদেশি। স্থানীয় রোগির সংখ্যা অতি সামান্য। স্বাস্থ্য সচেতনতা, বিশেষত খাবারের মধ্যে তেল বা চর্বির ব্যবহার কম বা নেই বলেই মানুষগুলো অনেক বেশি কর্মঠ ও স্বাস্থ্যবান। পথের পাশে বিক্রি হচ্ছে তাজা শাক-সবজি।  ছবি: ড. মাহফুজ পারভেজ

হাঁটতে হাঁটতে আমারও সকালের খাবারের সময় হলো। সামনেই ‘ইট অ্যান্ড মিট’ রেস্তরাঁয় ঢুকে গেলাম। সবই দক্ষিণাত্যের খাবার। পরিবেশক কিছুটা হিন্দি বলতে-বুঝতে পারে। আমার কথা যতটকু সম্ভব অনুধাবণ করে কলা পাতায় স্থানীয় ডিস নিয়ে এলো। অল্প অল্প করে দশ রকমের খাবার। ভাত, লুচি, পাঁপড়, ভাজি, সবজি, ডাল, ঝোল, ফিরনি, দই, আচার ইত্যাদি নানা ব্যাঞ্জনের সমাহার। আমি ভেজ বলে আমিষের কোন পদ দেয় নি। বলল, ‘হেলদি ফুড স্যার, খা লিয়ে, আচ্ছা হ্যায়। ’

স্বাদের কথা না ভেবে বিসমিল্লাহ বলে খেলাম। বেশ লাগল। উপাদানগুলো যে ফরমালিনমুক্ত ও তাজা টের পাওয়া গেল। পরে অন্যান্য সময়ে আরও অনেক জাতের খাবার খেয়েও ভালো লেগেছে। পেটের পীড়া বা অন্যবিধ সমস্যা হয় নি। পেটেও গুরুপাক খাবারের চাপ পড়ে নি। দক্ষিণের নাগরিকদের সুস্বাস্থ্যের অনেকটুকুই যে খাবারের মধ্যে নিহিত, তা বলাই বাহুল্য।

অনাবিল পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম হোটেলে। সেই শরীর ভেজানো বাতাস। হাল্কা রোদ। ঝরঝরে আবহাওয়া। শব্দহীন পরিবেশ। মানুষ কথা বলছেন মৃদ্যু কণ্ঠে। কথা সারছেন স্বল্প বাক্য ব্যয়ে। আমাদের মতো পথে-ঘাটে-মাঠে-কাজের স্থানে চিৎকার করে ফোনে বা এমনিতে কথা বলার কোনও লক্ষ্যণই এখানে নেই। পাশ দিয়ে নগর পরিবহনের একটি বাস চলে গেল নিঃশব্দে। হর্ন নেই। কনডাকটরের চেঁচামেচি তো নেই-ই।

হোটেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে সামনেরই সাইবাবা ট্র্যাভেলস-এ এলাম নগর ভ্রমণের আদ্যোপান্ত জানতে। নগরের দ্রষ্টব্য স্থান এবং বিশেষত অদূরবর্তী মহিশুরের ভ্রমণ সম্পর্কে জানলাম। একদা টিপু সুলতানের রাজ্য মহিশুরই আজকের কর্ণাটক। এরা অবশ্য স্থানীয় কন্নড় ভাষার প্রয়োগ বাড়াতে কিছু জায়গা ও নামের বদল ঘটাচ্ছে। বেঙ্গালোর হয়েছে বেঙ্গালুরু। মহিশুরও এখন মহিশুরু। মহিশুরের বীর ও স্বাধীনতা সংগ্রামী টিপু সুলতান অনেক দিন ইংরেজ উপনিবেশবাদীদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। বাংলায় সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করার অনেক বছর পর উপমহাদেশে নিজস্ব শক্তি সঞ্চয় করে ইংরেজরা টিপু সুলতানকে হারাতে সমর্থ হয়। পলাশীর মতোই বিয়োগান্ত কাহিনি লিপিবদ্ধ রয়েছে টিপু সুলতানকে ঘিরে। কলাপাতায় দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্যবাহী খাবার।  ছবি: অনিন্দিতা রায়

কথা বলতে বলতে ট্র্যাভেলসের মালিক এমন একটি কথা বললেন যে আমি থমকে যাই। তামিল অঞ্চলের অধিবাসী সজ্জ্বন ভদ্রলোক অনেক বছর বেঙ্গালুরুতে আছেন। সব কিছুর স্বচ্ছ খোঁজ-খবর রাখেন তিনি। আচমকা বললেন, ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা নেই!’ কথাটা ঠিক প্রশ্নের সুরে করা হয় নি। আবার নিশ্চিত স্বরেও বলেন নি। তার গলায় সংশয় মেশানো জিজ্ঞাসা।

আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘কেন আপনি এ প্রশ্ন করছেন?’ ভদ্রলোক সরল গলায় বললেন, ‘এতো মানুষ কেন আসে চিকিৎসা নিতে, আমি ভেবে পাই না!’ তিনি আরও বললেন, ‘এখানে খুবই স্পেশালাইজড চিকিৎসা হয়। অনেককে সাধারণ কারণেও আসতে দেখি। ’ আমি কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ থাকি। ভদ্রলোকের কথায় জানা যায়, অনেকেই খোঁজ-খবর না নিয়ে বা ডাক্তারের অ্যাপয়নমেন্ট না নিয়েই চলে আসেন এবং বহু দিন বসে বসে অপেক্ষা করেন। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট-ইমেলে যোগাযোগ করে এলে এমন সমস্যা হওয়া কথা নয়।

আমাদের চোখে সমস্যাগুলো ধরা না পড়লেও বিদেশের ব্যবসায়ীর কড়া চোখে ঠিকই ধরা পড়েছে। হোটেলে ফিরে লবিতে বসে সেদিনের পত্রিকাগুলো পড়তে পড়তে পাশের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি। কেউ বাইপাস, কেউ বাল্ব বদলাতে বা কেউ হার্টে রিং সংযোগ করতে এসেছেন। ‘এসব কি বাংলাদেশে হয় না?’ আমার প্রশ্নে কুমিল্লার ব্যবসায়ী আবদুল মতিন উত্তর দেন, ‘হয়, তবে ভরসা পাই না। ’

পাশে বসা নরসিংদীর খালেদ সাইফুল্লাহ আলোচনায় অংশ নিয়ে বললেন, ‘তিনি ঠিকই বলেছেন। ভরসা পায় না বলেই মানুষ এখানে আসে। এমনও হয়েছে যে, একটি রিং লাগিয়ে তিনটি রিং-এর দাম নিয়েছে। একটি ব্লক হলে বলেছে তিনটি ব্লক হয়েছে। ’

আরেকটি সমস্যার কথা বললেন ময়মনসিংহের তোজাম্মেল সাহেব, তিনি একজন চাকরিজীবী। ‘রোগ নির্ণয়েও নানা ভুল হওয়ায় মানুষ নিশ্চিত হতে দেশের বাইরে আসে। দেশে ক্যানসার রোগ শনাক্ত হওয়া রোগি এখানে এসে জেনেছে যে, তার তেমন কিছু হয় নি। ল্যাবরেটরির টেস্টের ব্যাপারে আস্থা স্থাপন করা যায় না। প্রায়শই ভুল রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। মানুষ একান্ত বাধ্য না হয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের জন্য আসে না। চরম অবস্থায় আসতে বাধ্য হয়। ’

কথাগুলো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলা। নানা ধরনের তিক্ত পরিস্থিতি পেরিয়েই এসব কথা মানুষ বলেন। দেশ ছেড়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য চলে আসেন। আবার এটাও ঠিক, অনেকেই না জেনে শখের বসে বা এমনিতেই বিশেষায়িত চিকিৎসকের কাছে আসছেন। এসব কারণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা ক্ষেত্রের ইমেজ হানি হচ্ছে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা চলে গিয়ে বড় রকমের আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। জানি না, কবে সংশ্লিষ্টরা মানুষের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে পূর্ণ আস্থা এনে বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা অর্জন করতে পারবেন। কবে ফেরাতে পারবেন চিকিৎসার্থে বিদেশমুখী মানুষের এই প্রবল স্রোতে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা, জুল্‍াাই ৪, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।