ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

কলকাতায় দিদি’র পাড়ায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৭
কলকাতায় দিদি’র পাড়ায় পুরো কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আইডল মমতা। ছবি: সংগৃহীত

কলকাতা থেকে ফিরে: ‘দিদি’ বললেই পুরো কলকাতায় বোঝা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলা হচ্ছে। পুরো নামটি আর বলতে হয় না। আদি কলকাতার এই নেত্রীর আবাস দক্ষিণের কালীঘাট এলাকায়।

কালীঘাটে এসে পৌঁছাই দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়া থেকে। টালিগঞ্জের কাছে ট্রামলাইন, রয়েছে ট্রাম ডিপোও।

রাস্তা দিয়ে ট্রাম আর অন্য যানগুলো চলেছে মধ্য কলকাতার ধর্মতলা, নিউমার্কেট হয়ে উত্তরের শ্যামবাজারের দিকে। নগরের কেন্দ্রস্থল ধর্মতলা থেকে আরেকটি লাইন চলে গেছে শিয়ালদা।

টালিগঞ্জের পর রাস্তা অনেক প্রশস্ত। ব্রিটিশ আমলের অনেক স্থাপনা ধর্মতলা পেরিয়ে আলিপুরের দিকে ছড়িয়ে আছে। ময়দানের আশেপাশে বিধান সভা, রাজভবন, হাইকোর্ট, জাদুঘর, পাবলিক হল, লাইব্রেরিসহ অনেক সরকারি দফতর।

কালীঘাটের বুক চিরে উত্তর-দক্ষিণ রাস্তা। আমি দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলেছি। কালিঘাট স্টপিজের বাম দিকে বিখ্যাত কালীঘাট মন্দির। উত্তরের দিকে খানিকটা এগিয়ে রাস্তার ডানে গলি। এ উপ-পথের নাম পটুয়া গলি।

বছরের পুরোটা সময়েই নানা পূজার প্রয়োজনে কুমার ও মৃৎশিল্পীদের কাজের বিরাম থাকে না কলকাতার পটুয়াদের পাড়াগুলোতে। খুবই নামকরা এলাকা কুমারটুলি ছাড়াও বিখ্যাত মন্দিরগুলোর আশেপাশে পটুয়াদের আবাস ও পেশাজীবন গড়ে উঠেছে।

পটুয়া গলি পার হয়ে খানিকটা উত্তরে এগিয়ে হাতের ডানে আরেকটি গলি। ‘এ গলির নাম হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। এখানেই দিদির বাড়ি’- জানালেন সহযাত্রী কাজল কর।

খুবই সাধারণ একটি উপ-পথ। বাড়িগুলোও মধ্যবিত্তের অবয়বে মুখোমুখি দাঁড়ানো।

‘এ সাধারণ বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর বসবাসে আপত্তি করেছিল নিরাপত্তা বিভাগ। টালির ছাদের অতি সাধারণ বাড়ি ছেড়ে তবুও তিনি অন্যত্র যাননি’- হাঁটতে হাঁটতে বললেন কাজল।

‘তবে বাড়িটি আগের মতো নেই। কিছু নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্কার করা হয়েছে’।

খুবই আটপৌড়ে ও সাধারণ পাড়ার পরিবেশে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তার সরল-সাধারণ জীবন-যাপন, পোশাকের সঙ্গে বাড়িটিও মানানসই।

এ গলির পেছনে উত্তর সীমান্তে আদিগঙ্গা এখন একটি সাধারণ খালের মতো পূর্ব-পশ্চিমে বইছে। খালের অন্য পাশ থেকে আলিপুর এলাকার শুরু।

ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে বুর্জোয়া বা ধনিক শ্রেণির রাজনীতির বিপরীতে আদর্শবাদিতা ও কৃচ্ছ্বতার রাজনীতির বড় বড় উদাহরণ রয়েছে। ত্যাগ ও সারল্যের রাজনৈতিক জীবন এখনো উধাও হয়ে যায়নি। তাদের মধ্যেও অনন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

পুরো কলকাতা মহানগরে মমতার বিরাট, বিরাট পোস্টার ও ব্যানার। ‘১৯ জুলাই শহীদদের স্মরণে ধর্মতলায় চলুন’ আহ্বানে জানিয়ে নগর ছেড়েছিল প্রচারণা। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে মমতার তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রাধান্যের চিত্রটিও প্রচারণার দাপটে স্পষ্ট। মধ্য, উত্তর, দক্ষিণ- সর্বত্রই মমতাময় কলকাতা।

উত্তরের আড়িয়াদহ, দক্ষিণের গড়িয়া, মধ্যাঞ্চলের পার্ক সার্কাস কিংবা তালতলা, মেটিয়াবুরুজ, তিলজলা, এন্টালি, মৌলালি, পিকনিক গার্ডেন এলাকায় মমতার আহ্বান উচ্চকিত। মমতার দলের সংসদ সদস্যরা বাসস্টপে ছাউনি, জলাধারসহ নানা জনহিতকর কাজের ফিরিস্তিও সচিত্র প্রদর্শন করছেন।

কেবলমাত্র উত্তরাঞ্চলের উত্তর দমদমে বিজেপির প্রয়াত নেতা তপন সিকদারের পক্ষে কিছু ব্যানার। আর কমিউনিস্টদের দোকান সাইজের অফিসে মূলত তাদের পত্র-পত্রিকা, বই ইত্যাদি বিক্রির সামান্য কয়েকটি উদ্যোগ দৃশ্যমান।

বামেরা ঘুরে দাঁড়াতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছেন। ঐতিহ্যবাহী কংগ্রেস ক্রমেই নামসর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে দলভারির চেষ্টা করছে বিজেপি। রাজনীতি সচেতন নাগরিকরা তাই মনে করেন, মমতাই এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির শেষ ভরসা।        

রাজনৈতিক সমীকরণে মমতা বন্দোপ্যাধায়ের উত্থান ও উপস্থিতি খুবই সরব। এক সময়কার কংগ্রেসের যুবনেত্রী মমতা একটি আঞ্চলিক দলের নেতৃত্ব থেকে একাধিক্রমে ক্ষমতায় অবস্থান করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কয়েক যুগ ক্ষমতায় থাকা বামপন্থীদের দূর্গ দখলের কৃতিত্বে সর্বভারতীয় মহলেও আলোচিত তিনি।

রাজনীতিতে পোড় খাওয়া ব্যক্তিগত জীবনে কুমারী এই নেত্রীর ধ্যান-জ্ঞানই হলো ‘মা-মাটি-মানুষ’। তার পক্ষে ‘ওয়ান ওম্যান আর্মি’ হয়ে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত একটি ক্যাডারভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সৃশৃঙ্খল দলকে ধরাশায়ী করা কি করে সম্ভব হয়েছে? শুধু ধরাশায়ীই নয়, কমিউনিস্টদের সোজা হয়ে দাঁড়াতেও দিচ্ছেন না মমতা। তুলনামূলকভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেই শাসনকার্য পরিচালনা করছেন। এ বিষয়টিও পর্যবেক্ষকদের গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করে।

মমতার রাজনৈতিক সম্মোহনী শক্তির প্রধান কারণ হিসাবে তার সক্রিয়তাকে তুলে ধরেন নানাজন। তিনি প্রো-অ্যাক্টিভ, কাজে বিশ্বাস করেন। যা অনুভব করেন, সেটি করতে বিলম্ব বা দ্বিধা করেন না। সাধারণ মানুষ তো বটেই, দলের নেতাকর্মীদের পাশেও দাঁড়াতে দেরি করেন না। ‘দিদি আছেন’- সবার মধ্যে এ আস্থাটা অর্জন করাই তার ক্যারিশম্যাটিক শক্তির স্তম্ভ।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র নোটিশের জবাব দিতে সল্ট লেকে সিজিও কমপ্লেক্সে তাদের দফতরে গিয়েছিলেন তৃণমূলের সংসদ সদস্য সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। চট করে তাকে গ্রেফতার করে সিবিআই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দিদি ক্ষমতার আসল জায়গা থেকে রাস্তায় নেমে পড়েন দলবল নিয়ে।

‘দিদি আছেন’ আস্থাটা অর্জন করাই মমতার শক্তির স্তম্ভ।  ছবি: সংগৃহীতসুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতারের কিছু আগেই গ্রেফতার হন আরেক সংসদ সদস্য তাপস পাল। দিদি তখনো মাঠে।

আঞ্চলিক দলের নেত্রী হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একা লড়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রে জাতীয় সরকার গঠনের দাবিকে জোরদার করে তুলেছেন অন্য বিরোধী দলগুলোকে ডেকে নিয়ে। বিজেপিবিরোধী জোট দানা বাঁধি-বাঁধি করেও আকার পাচ্ছে না। কিন্তু প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন মমতা। তিনি শুধু রাজ্যেই নয়, কেন্দ্রের রাজনীতিরও অন্যতম অ্যাক্টর।
 
নাম প্রকাশ না করে কলকাতার একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, ‘অতি সম্প্রতি সাধারণ মানুষের চোখে ‘ভিলেন’ হয়ে ওঠার ভয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিমুদ্রাকরণ সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় কোনো দলই গলা তুলতে পারেনি, ব্যতিক্রম মমতা। তিনি এ নিয়ে পথে নেমেছেন, দিল্লিতে গেছেন, এমনকি মোদীকে বাদ দিয়ে বিজেপির অন্য কোনো নেতাকে সামনে রেখে জাতীয় সরকার গঠনেরও দাবি জানিয়েছেন।

এ ধরনের ক্যারিশমা এখন মমতা ছাড়া খুব কম নেতাই সর্বভারতীয় পর্যায়ে দেখাতে পারছেন।

অনেকেই জানিয়েছেন, মমতার আরেক হাতিয়ার হলো মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার কার্যকর প্রচেষ্টা। ছাত্র হোক, শিক্ষক হোক সংখ্যালঘু হোক, তিনি কারো সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে নারাজ। প্রায়ই যে কথাটি তিনি বলেন, তা বহুল প্রচারও পাচ্ছে- ‘ভুল হলে বলবেন, রাগ করবেন, গালাগাল দেবেন। কিন্তু অভিমান করে সংঘাতে যাবেন না। অভিমান করে আমাকে ভুলে যাবেন না’।

বক্তব্যের এ আবেগ ও আন্তরিকতাও মমতাকে মানুষের বিশ্বাসের জায়গায় অধিষ্ঠিত করেছে।

বার বার দেখা গেছে, যখনই কোনো কারণ বা ইস্যুতে তার সরকারকে ঘিরে জনমনে অসন্তোষ ঘনিয়ে এসেছে, তিনি চিরাচরিত জনমোহিনী (ক্যারিশমেটিক) নীতিকে কাজে লাগিয়েছেন। কখনো বা প্রতিশ্রুতির দাওয়াই দিয়ে অসন্তোষকে ঢেকে রেখেছেন। চট করে চলে গেছেন পাড়ার পূজায়, ঈদের সমাবেশে, গ্রামের অচেনা জায়গায়। ব্যক্তিগত সততা আর নিষ্ঠার জায়গা থেকে মমতা নিজের জন্য মজবুত পাটাতন তৈরি করেছেন, যেখানে রাজনৈতিক বিশ্বাসের তুলাদণ্ডে এখনো মানুষের আস্থার প্রতীক তিনি।

‘মণ্ডপে মৃন্ময়ী মা আর কালীঘাটে চিন্ময়ী মা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’- বলে রাজনীতিবিদ মদন মিত্রের প্রকাশ্য উচ্চ স্তবকতার মতো না বললেও মানুষের কাছে মমতা মানেই অনেক কিছু। তিনি তাই শুধু কালীঘাট নন, পুরো কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে আইডল।

তার জন্যই ‘দেবির পাড়া’ কালীঘাট এখন ‘দিদির পাড়া’ও।

রাজনৈতিক নেতা ব্রাত্য বসুর প্রকাশ্য বক্তব্যই এখন পুরো পশ্চিমবঙ্গে জনশ্রুতি হয়ে গেছে- ‘কোনো ব্যক্তিকে পূজা করতে হলে তার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।