ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সিঙ্গাপুরের চিঠি-২

ভারতীয় খালা বলেই খাবারের দাম দিলেন

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৭
ভারতীয় খালা বলেই খাবারের দাম দিলেন সিঙ্গাপুরের চিঠি

সিঙ্গাপুর থেকে: ট্যাক্সি চালকের নাম তিন পিউ। পঞ্চাশোর্ধ্ব পিউ জিপিএসে ঠিকানা বসাতেই ম্যাপ চলে এলো। এখানে ট্যাক্সিগুলোতে মোবাইল নয় বরং জিপিএস মেশিনই বসানো হয় বলে জানান তিনি। 

পর্যটকপ্রিয় যেকোনো শহরের প্রাথমিক তথ্য নেওয়ার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সোর্স অবশ্যই ট্যাক্সি চালক। সিঙ্গাপুর যেনো অামার কাছে এবারই প্রথম, এমন ভঙ্গি নিয়ে জানতে চাইলাম, বাইরে বেশ গরম, তাই না? 

নিজের দেশ আর শহরকে পরিচয় করিয়ে দিতে কার না ভালো লাগে।

পিউও তাই করলেন। বললেন, সবসময় গরম এখানে। ৩২ ডিগ্রির মতো তাপমাত্রা। আর নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকেই কিছুটা বৃষ্টি হয়। তবে অনেক গরম যে সেটাও বলা যাবে না। হাসতে ভালবাসেন এই চালক। কথার অাগে পরে একবার করে হাসি দেন।  

বিদেশে অাপনাকে বেশ কয়েকবার ভারত থেকে এসেছেন কিনা, সেই উত্তর দিতে হবে। কারণ, শরীরের অাকৃতি ও বর্ণ। বাংলাদেশ বলতেই জানালেন, তার অনেক বাংলাদেশি বন্ধু রয়েছে।  

সিঙ্গাপুরের চিঠি

পিউ এক সময় নির্মাণ শিল্পে একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করতেন। তখন অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচয় হয়। 'বৃষ্টি নেই গরম লাগছে', 'পানি খাবো'— এ ধরনের অারও কিছু কিছু বাংলা বাক্য শোনাতে পেরে বেশ খুশি তিনি। তবে ভাষা হিসেবে বাংলাকে চায়নিজের মতোই কঠিন হিসেবে অাখ্যা দিলেন।  

চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর যে হাইওয়েটি চোখে পড়ে সেটি মন জুড়ানো। অনেক ফুল চিনি না বলে অাফসোস হলো। এতো রঙিন রাস্তা আর কোথাও আমার চোখে পড়েনি। লাল-নীল-বেগুনি রঙকে মুড়ে রেখেছে সবুজ। এখানে শুধু পথের এক দিকেই ছয় লেনের রাস্তা। আর সেখানে বলা অাছে, কোথায় গেলে কোন লেনে থাকতে হবে। প্রায় ৪৫ মিনিটের পথ পেরিয়ে ১২১ ক্লেমেন্তি রোডের কেন্ট ভেলিতে যখন প্রবেশ করি, ঘুম তখন চোখের দুই পাপড়ির ঠিক মাঝখানটায় ঝুলছে।  

২৫ ডলার ভাড়া দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের অফিসের দিকে এগোলাম। এটা যে একটা বনেদি জায়গা সেটা নামার পরেই বোঝা যায়। পিনপতন নীরবতা। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে অাসা বিদেশি অতিথিদের রাখা হয় এখানে।  

সিঙ্গাপুরের চিঠি

সামনেই ঝিরির মতো পানির স্রোত। এখানকার ৩২ বা ৩৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা হাওয়া বইয়ে দেয়। অ্যাপার্টমেন্টের অফিসে ঢুকে বললাম, অামি এজেএফ'এর ফেলো। পাশের চায়নিজ মেয়েটি লাফ দিয়ে উঠলো। 'ওহ তুমি এজেএফ এর! অামি চিন চিয়াং, ফেলো ফ্রম চায়না’। দেখতে সুন্দরী বলা যায়, তবে যেকোনো সুন্দরীকেই বাচ্চাসহ দেখতে ভালো লাগে না। আর চিন তার বাচ্চাকে নিয়েই এখানে এসেছে। ক্লান্তি নিয়ে কথা বলতে মন চাইলো না।  

এদিকে, কাউন্টারের নারীও জানিয়ে দিয়েছেন, ২টার অাগে চেক-ইন হবে না। অগত্যা আরও এক ঘণ্টা অপেক্ষার জন্য সোফায় বসলাম। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কাউন্টার থেকে বললেন, তুমি রুমে যেতে পারো। তবে রেজিস্ট্রেশন ফর্মে সময় উল্লেখ করতে মানা করলেন।

১০ তলায় ১০০৬ নম্বর ফ্ল্যাটটি বিশাল বলা যাবে। এ যেনো ছোটখাটো ফুটবল মাঠ। পুরো ফ্ল্যাট দ্রুত হাঁটলেও এক মিনিটের বেশি সময় লাগবে। এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে, অামার ফ্ল্যাটমেটদের একজন ভারতীয় এবং ইন্দোনেশিয়ান।  ভারতের মুম্বাইয়ের ছেলে চৈতন্য সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন মুম্বাই মিররে এবং ইন্দোনেশিয়ার দামার হারসানতো জাকার্তা পোস্টের অনলাইন ও অান্তর্জাতিক বিভাগের সম্পাদক। আমি দু’জনকেই ইমেইল করে জানিয়ে দিলাম যে, ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেছি এবং তাদের জন্য অপেক্ষা করছি। চৈতন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই অাসবে বলে ফিরতি মেইলে জানালো। আর দামার অাসবে পরদিন।  

অনুপমা ও রবিশংকর পিসুপাতি।

এই ফ্ল্যাটে কী কী অাছে তা বলার চাইতে সহজে বললে, কিছুই বাকি নেই। পুরোটা ঘুরে দেখার অাগেই ঘুমিয়ে গেলাম সোফায়, ৫৪ ইঞ্চি টেলিভিশন ছেড়ে দিয়ে। গভীর ঘুম ভাঙলো দরজা খোলার শব্দে। চৈতন্য রুমে ঢুকলো। সঙ্গে তার খালা এবং খালু। দু’জনই এখানে এসটিই সফটওয়্যার কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। গত ২৮ বছর ধরেই এখানে চাকরি করছে অনুপমা ও রবিশংকর পিসুপাতি।  

জিজ্ঞাসা করলেন, দুপুরে খেয়েছি কিনা? না বলতেই তাদের সঙ্গে খেতে যেতে বললেন। সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। কারণ, এই ক্ষুধা পেটে একা একা খাবারের দোকান সন্ধান করা কঠিন।

ওয়েস্ট ভিলেজ মার্কেট এখান থেকে কাছেই। তবে নতুন পথ চিনে কেন্ট ভেলের পেছনের পকেট পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লেগে গেলো। পকেট গেটেই ক্লেমেন্তি উড পার্ক উঁচু-নিচু টিলায় সাজানো। এখানে রাস্তা পার হতে সিগন্যাল লাগে। অন্য দেশেও এমন নিয়ম দেখেছি, তবে মানা হয় না। রাস্তা খালি থাকলেও মানুষ পার হয় না। সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করেন।

অনুপমা খালা একটু অবাক হলেন অামি হিন্দি বলতে পারি না জেনে। এটা অামার বলিউড সিনেমা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণ বলে জানালাম। আমার ও চৈতন্যর কী করণীয় সে সম্পর্কে ধারণা দিতে থাকলেন। বাজারের ফুড কোর্টে বেশিরভাগ দোকান চায়নিজদের। নিরামিষভোজী চৈতন্যর জন্য মাংস হারামের মতো। সে জীবনেও মাংস খায়নি। খালা অামার জন্য মুরগির সিদ্ধ মাংস আর ভাত অর্ডার করলেন। নিজেরা বসলেন অাখের শরবত নিয়ে। ভারতীয় খালা বলেই আমাকে বিল দিতে হলো না। তবে চায়নিজ বা সিঙ্গাপুরের খালা হলে নিজেকেই যে বিল দিতে হতো, সেটা অামার জানা।

চৈতন্য অাজ রাতেও তার খালার বাসায় থাকবে। রুমে ফিরে একা আমি টিভি দেখার চেষ্টা করলাম। তবে টিভির প্রোগ্রাম অপারেট করা সহজ নয়। সন্ধ্যা হয়ে এলো, এমন সময় মেসেঞ্জারে শানিকার টোকা। শ্রীলংকার সাংবাদিক শানিকা ফ্রি-ল্যান্স কাজ করে। পরে শুনেছি, তামিলদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকান সেনাবাহিনীর যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে রিপোর্ট সংগ্রহ করেছেন তিনি। আমি শানিকাকে কফি খাওয়ার দাওয়াত দিলাম। তবে তার বয়স সম্পর্কে ধারণা থাকলে যে নিমন্ত্রণ করতাম না, সেটা দেখা হওয়ার পর বুঝতে পারলাম।

তার ডাকে কেন্ট ভেলের লবিতে গেলাম। সেখা গিয়ে নারী-ঘেরা হয়ে পড়লাম। মালয়েশিয়া স্টার পত্রিকার চিফ রিপোর্টার শর্মিলা, চায়নিজ একটি পত্রিকার রিপোর্টার ও টিভি চ্যানলের উপস্থাপিকা অাকি, চিন চিয়াং এবং শানিকা বসা। তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলাম অতিমাত্রায় 'ওয়াও' বা 'অাহা' ধরনের শব্দের উচ্চারণে। সময় যাওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। তারা বের হয়ে গেলে রওনা দিলাম ওয়েস্ট ভিলেজের পথে। অাজ রাতে বার্গার কিংয়ের বার্গারই ভরসা। আর এখানে সিগারেট টানতে হলে হাঁটতে হয় প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৭
এমএন/এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।