ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

জ্যান্ত ইলিশের খোঁজে তেতুলিয়া নদীতে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৭
জ্যান্ত ইলিশের খোঁজে তেতুলিয়া নদীতে জ্যান্ত ইলিশের খোঁজে তেতুলিয়া নদীতে

বুড়িগঙ্গার কালো জলে সন্ধ্যার ঢাকা সবে তার আলোকিত ছায়া ফেলতে শুরু করেছে। সদরঘাটে তখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা। বিশালাকার জলযানের পেটে চেপে কেউ বাড়ি যাবেন সপরিবারে, সেখানে হয়তো অপেক্ষায় তাদের প্রিয়জন।  আবার কেউ সবে আসতে শুরু করেছে, তাদেরও লক্ষ্য জলযানের পেটের ভেতর ঢুকে পড়া। প্রতীক্ষায় তাদের হাসি-আনন্দের একটি দিন।

ভোলাগামী ক্রিস্টাল ক্রজ লঞ্চের সামনের ডেকে মুহিত ভাইয়ের উদ্বিগ্ন চাহনি।  একেকজন আসছেন আর তার মুখের হাসি চওড়া হচ্ছে।

সপ্তাহের শেষ দিনের ভিড়ের চাপে থেমে থাকা জন ও যানের জট ঠেলে শেষ মেশ অবশ্য সদরঘাটে পৌছতে পারলাম।  ভরা পূর্নিমার চাঁদ তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।  মেঘনার মুখে আমাদের আজ তার পৃথিবী ভোলাবার কথা।  দলের শেষ মানুষটি দৌড়ে লঞ্চে উঠে পরার মিনিট দুই তিনের মধ্যেই ভো সাইরেন তুলে পল্টুন ছাড়লেন তিনি।  দোতলার সামনের ডেকে আমরা করছি পাখির মতো কিচির মিচির।  

কারও কথা বুঝবার উপায় নেই, শহর ছাড়তে পারার আনন্দেই যত কোলাহল আমাদের। আমরা মানে বিএমটিসি পরিবার। বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান পর্বতারোহন ক্লাব। নেতৃত্বে আবার দু’বারের এভারেস্ট আরোহী প্রথম বাংলাদেশি এম এ মুহিত। পাহাড়বাসীদের শখ হয়েছে একটা দিন নদীতে ভেসে ভেসে আনন্দ মন্থনের। আরও অনেক কিছুর-ই আছে শখ।  

একে একে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে আমরা যাচ্ছি চাঁদপুরের মোহনার দিকে। মাঝে পড়লো খাওয়ার ডাক। এলাহী আয়োজন। ইলিশের দেশে পৌঁছানোর আগে উদরপূর্তি হলো প্রমাণ সাইজের ইলিশ ভাজা, মুরগির মাংস, ভুনা ডাল দিয়ে।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুখে লেগে রইলো পেঁয়াজ সহযোগে মরিচ ভর্তাটি।  

খাওয়া শেষে লঞ্চের ছাদে এসে দাঁড়ালাম সবাই।  ততক্ষণে আমরা পার হচ্ছি মেঘনা ডাকাতিয়ার মোহনা। নদী এখানে পারপারহীন অতল। নদীর বাতাসে হিম শীতের আমেজ। ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতেই জোৎস্না দেখা। লঞ্চের বিশাল খোলা ছাদ আমাদের স্বর্গরাজ্য, কিছুক্ষণের জন্য শহুরে ব্যস্ততা থেকে মুক্তির আনন্দে আমরাও বাঁধনহারা। খোলা মেঘনার মুখে মাতাল জোৎস্নার রূপ দেখে পারি তো নদীতে ঝাঁপ দেই। দলের কেউ কেউ বোধহয় তা করতো, সময় জানালো ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘর পার হয়েছে। ঘুমাতে হবে। কাল যে আসল আয়োজন।

জ্যান্ত ইলিশের খোঁজে তেতুলিয়া নদীতেভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। লঞ্চ পল্টুনে ভিড়েছে ঘুমের মাঝেই টের পেলাম। চারপাশে বাক্স-পেটরা গোছানো, মানুষের ব্যস্ততার আওয়াজ জানিয়ে দিলো নতুন একটা দিনের শুরু হতে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্য এতো তাড়া নেই।  আমরা তো আজ রাজা, বিলাসের সমস্ত উপকরণ চাওয়ার আগেই হাজির হয়ে যাবে।  
সাতটার দিকে আমাদের নামার ডাক এলো। ভোলার লঞ্চঘাটটি ভোলা খালের উপর। একে আবার ঢাকার খাল ভেবে বসবেন না। রীতিমতো জোয়ারের জলে সকাল বিকেল এর রূপ বদলায়। সমুদ্র কাছেই। খালের এপার কোলাহলময় শহুরে হলেও ওপারে কিন্তু স্নিগ্ধ গ্রাম। ফসলের ক্ষেত, নদীতে বৈঠা হাতে মাঝি।  

গ্রামের গাছপালার ফাঁকে হালকা কুয়াশার চাদরের উপর রোদের আঁচ লেগে তৈরি এমন এক আবহ যা আজকাল খুঁজি বইপত্রে, জীবনানন্দের কবিতায়।  আমাদের ট্রলার হাজির। অবশ্য এর লোহার শরীর দেখে যে হতাশ হইনি তা নয়, আশা করেছিলাম কাঠের মাছ ধরা ট্রলার হবে। আমরা হইহই করতে উঠে পড়লাম। সারাদিনের খাবারের আয়োজন নিয়ে হাজির টুটুল ভাই। তিনিই আমাদের আজকের এ অভিযানের ম্যানেজার। ট্রলার ছেড়ে দিলো।  

সকালের শীতের হালকা উপস্থিতি। একেবারে নিখাদ গ্রাম বাংলা যাকে বলে।  বর্ণনা দিতে গেলে বিভূতিভূষণ অথবা জীবনানন্দের সাহায্য প্রয়োজন।  

জোয়ারের অনুকূলে দ্রুতগতিতে ভেসে চলেছে আমাদের জলযান। নদীবক্ষ ও তার দুই কূলে জীবনের আয়োজন শুরু হয়েছে। কৃষক হাল জুড়েছে মহিষের কাঁধে। বহুদিন পর এমন দৃশ্য দেখলাম। নদীতে মাছ ধরতে নেমে পরেছে পুরো জেলে পরিবার। এরা সারাবছর নদীতেই ভেসে বেড়ায়। সকালের নাস্তা সারতে আমদের ট্রলার থামানো হলো বিরাট এক মাঠের ধারে তাল গাছের নীচে। মাঠজুড়ে সরিষা ফুলের হলদে রাজত্ব। মনে হলো অলৌকিক এক জগতের দ্বারপ্রান্তে আমরা।  

নাস্তার স্বাদটিও ভুবন ভোলানো। চালের আটার রুটি সঙ্গে হাঁসের মাংস।  খেলাম অবিশ্বাস্য তৃপ্তি নিয়ে, অবশ্য এতটা পেটুক কিন্তু আমি নই। এরপর ক্ষানিকক্ষণ সরিষার রঙে পাগলপারা হয়ে এলোমেলো দৌড়াদৌড়ি, ফটোসেশনের পর আবার ভেসে পরা নদীর বুকে। মাঝখানে আবার থামানো হলো নদীর ধারে চাষের শসার লোভে। অবশ্য হানাদারির মাঝখানেই চাষির আবির্ভাব, অনেক দরাদরি করে কেনা হলো শসা।  

এবার আর কোনো থামাথামি নয়। আমরা চলেছি তেতুলিয়া নদীতে। যে ইলিশের কথায় ফুরোয় না রসনা, সেই মাছটি শিকারের দৃশ্য চাক্ষুষ করতে।  দক্ষিণবঙ্গের সাগর ঘেঁষা নদী তেতুলিয়া। এখাকার সবকিছুই চলে জোয়ার-ভাটার নিয়মে। ইলিশের ঠিক ভরা মৌসুম না। কিন্তু চারপাশে অসংখ্য জেলে নৌকার উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলো আমরা ইলিশের মৃগয়াতে চলে এসেছি।

উত্তেজনার তর আর সয় না। ট্রলার ভেড়ানো হলো এক জেলে নৌকার পাশে।  তীব্র রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে চারপাশ। এমন গরমে ইয়া বড় জাল টেনে তুলছে জনাকয়েক জেলে। খুব বেশি মাছ মেলেনি। কিন্তু সেই নৌকায় পা দিতেই বুঝলাম ভাগ্য আজ সুপ্রসন্ন। বেশ কয়েকটি সদ্য ধরা ইলিশ পড়ে আছে নৌকার খোলে। মুহূর্তেই তীব্র উচ্ছ্বাস, শুরু হলো ইলিশ হাতে ফোটোসেশনের পালা।  

রোদের ঝিলিক মারছে ইলিশের রুপালি আশে। জেলেরা আমাদের কাছে ইলিশগুলো বেচতে রাজি নয়। বহু কণ্ঠের কাকুতি শুনে শেষমেষ রাজি হলেন জেলে সর্দার। সঙ্গে আবার বোনাস হিসেবে নদীর গলদা চিংড়ি।  তৎক্ষণাত মাছগুলো ফ্রাই করা হলো। সেই মাছের স্বাদ যদি ওপার বাংলার দিদি-দাদারা একবার চেখে দেখবার সুযোগ পেতেন, বাজি ধরে বলতে পারি ইলিশের জন্য......!!

বাংলাদেশ সময়:০৩৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।