দিন ১৬
নাটোর-ঈশ্বরদী (পাবনা)= ৩৯.৫৯ কিমি.
সজল ভাইদের বাড়িটা নাটোর শহরের কেন্দ্র, মাদ্রাসা মোড়ের কাছেই। দক্ষিণ পটুয়াপাড়ার বাড়ি থেকে বেরুতেই ২-৪ ফোঁটা বৃষ্টি স্বাগত জানালো।
যুদ্ধের সময় কানের কাছেই বোমা ফেটেছিল বলে উনি এরপর থেকে কানে কিছুটা কম শোনেন। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাব আজকের যাত্রায় পড়বে, এটা ধরে নিয়েই বেরিয়েছি। মাদ্রাসা মোড় ছাড়িয়ে হাতের বামে ইনাটোরের বিখ্যাত ইসলামিয়া পচুর হোটেল। বেশ ক'বছর আগে এই হোটেলের বেগুন ভাজা খেয়ে দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই ভোরবেলা সেসব স্মৃতিচারণ করেই তুষ্ট থাকতে হলো। হরিশপুর বাসটার্মিনাল থেকে আরেকটু এগিয়ে নাটোর পৌরসভা শেষ। পৌরসভার পরপরই ব্যাপ্টিস্ট মিড মিশনস হাসপাতাল। সকালবেলাতেই হাসপাতাল চত্বরে দারুণ ভিড়। উঁকি দিতেই সাজানো-গোছানো বাগান চোখে পড়লো।
দত্তপাড়ার পরে আবার দেখা হলো নারোদ নদের সঙ্গে। নাটোর শহরে দেখা নারোদের চেয়ে কিছুটা প্রাণোচ্ছ্বল এখানে। পৌরসভার পর থেকেই প্রচুর ইটভাটা। তাকে তাকে সাজানো ইট আর উঁচু চিমনি দেখতে দেখতেই ঝেঁপে বৃষ্টি। এতক্ষণ এমনিতেই হাঁটলেও এবার আমার পঞ্চো তথা সবুজ আলখাল্লা গায়ে চাপাতেই হলো। এদিকে প্রচুর ফিলিং স্টেশন রাস্তার দু'পাশেই। হযরতপুর হয়ে সৈয়দ পাড়া মোড়ের কাছেই এই বৃষ্টিতে পলিথিন দিয়ে ইম্প্রোভাইজড রেইনকোট পরা এক বাইকারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। গতি তোলার সঙ্গে সঙ্গে পলিথিন রূপ নিল ডানায়। কোথায় ভেবেছিলাম রাস্তায় মাঝে মাঝে দু’একটা ডানাকাটা পরী দেখবো! তার বদলে কিনা ডানাওয়ালা বাইকার!
কালিমসাতুড়িয়া নামক একটা জায়গায় নদী পেরিয়েই বড়াইগ্রাম উপজেলার সীমানা শুরু। আহমেদপুর নামক বড় একটা বাজার পেরোলাম। এইদিকের রাস্তাটা বেশ নির্জন, নিরিবিলি। প্রবল বেগে পানি ছিটিয়ে যাওয়া যাত্রীবাহী বাসগুলো মাঝে মধ্যেই নীরবতা ভাঙছে৷ রাস্তার পাশের যে ছোট্ট অংশটা দিয়ে সাধারণত হাঁটি আমি, সেগুলো আজ পানিতে পূর্ণ। হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। বনপাড়া বাইপাস থেকে বামের রাস্তা এগিয়েছে সিরাজগঞ্জের দিকে। আমি সোজা রাস্তায় ঈশ্বরদীর পানে এগোচ্ছি। বৃষ্টি-বাদলার দিনে লোকে প্রশ্ন করছে না বলে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। তবে আজ লোকের প্রধান কৌতূহলের কারণ আমার সবুজ আলখাল্লার মতো দেখতে পঞ্চোটা। এই জিনিস পড়লে আমাকে যথেষ্ট কিম্ভুত লাগলেও এর মতো যুতসই জিনিস পাওয়া দুষ্কর।
একে একে পার হলাম টলটলি পাড়া, মানিকপুর। গোধড়া বাজার থেকে শুরু লালপুর উপজেলা। সাধারণ জ্ঞানের বইতে পড়েছিলাম নাটোরের লালপুর হলো দেশের সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান। ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা ঝাপটা দিয়ে সেই লালপুর আজ আমায় স্বাগত জানালো। দাইড়পাড়া বাজার হয়ে কদিমচিলান৷ এখান থেকেই একটা রাস্তা মহাসড়ক ছেড়ে এগিয়েছে ঈশ্বরদীর দিকে।
সেইরাস্তা ধরেই এবার পথচলা। এই রাস্তায় শত শত খেজুর গাছ। শীতের আগমনী বার্তার ঘোষণাস্বরূপ অনেক বাড়ির সামনেই দেখা গেলো রসের হাঁড়ি। আর রস সংগ্রহের নমুনা হিসেবে দেখলাম গাছের আগার দিকে চাঁছা অংশ। চাঁদপুর বাজার নামক জায়গা পেরিয়ে প্রচুর ইক্ষুক্ষেত। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার আগেই এদিকের বেশকিছু ধানক্ষেত বাতাসে নুইয়ে গেছে। এই রাস্তাটা খুব বেশি মানুষ ব্যবহার করে বলে মনে হলো না। মাঝে মধ্যে একটা-দুটো টমটম ছাড়া অন্য বাহনের দেখা মেলা ভার।
ডাঙার মোড় হয়ে হাপানিয়া। ওখান থেকে আরশাদ মোড় হয়ে আবেদ মোড় যেতেই রাজশাহীর বাঘা থেকে এসে সঙ্গী হলেন সৌমিক ভাই। ঈশ্বরদী তখন আর বড়জোর ৫-৬ কিমি। অসুখ-বিসুখ, আম, সাইকেল ইত্যাদি নিয়ে গল্প গল্প করতে বেনারসি পল্লী। ডানে মোড় নিয়ে ফতে মোহাম্মদপুরের দিকে এগোচ্ছি। এর মধ্যেই খানিকবাদে বাদে ফোন করে আমার বর্তমান অবস্থান জেনে পথের হদিস দিচ্ছিলেন তসলিম ভাই। আজ ভাইয়ের বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা। ফতে মোহাম্মদপুর এসে মনে হলো কোনো উৎসবে এসে পড়েছি। চারপাশে রয়-বেরঙের কাগজ দিয়ে সাজানো সব বাড়ি, মাঠ-ঘাট। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে এখানের বিহারি পাড়ায় বিশাল আয়োজন। এই অংশে বাস বিশাল এক বিহারি জনগোষ্ঠীর। কান পাততেই বেশ ক'টা দোকানে হিন্দি/উর্দুতে বাত-চিৎ শুনলাম। লোকো মাঠ পেরিয়ে হাসপাতাল মোড়ে থামার কথা থাকলেও গল্পে গল্পে আরো খানিকটা সামনে চলে গিয়েছিলাম ভুলে।
তসলিম ভাইকে ফোন করে পথের দিশা নিতেই হাজির ওনার ভাইপো আলিশা। সে আমাদের খুঁজে নিতেই তার পিছুপিছু হাঁটা। রাস্তার পাশেই বেশ পুরনো ধাঁচের তসলিম ভাইদের বাড়িটায় যখন ঢুকছি তখনো সারাদিন ধরে চলা টিপটিপ বৃষ্টি থামেনি। বাড়িতে ঢুকেই যে জিনিসটা ভালো লাগলো, ওনাদের এখনো যৌথ পরিবার। বিশাল বাড়িতে প্রচুর লোকজন।
বিহারিপল্লী লাগোয়া বাড়িটায় ঢুকে ফ্রেশ হতে হতে আলিশা জানাল, মাইকের তাণ্ডবে আজ রাতে ঘুমাতে খবরই আছে৷ এখানের বিহারিরা দুই ঈদের চেয়েও অধিক গুরুত্ব সহকারে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করে৷ তসলিম ভাইয়ের ভাবির সৌজন্যে বাড়ি থেকে এত দূরে বসেও মৌসুমের প্রথম গুড়ে তৈরি ভাপা পিঠা খাওয়া হয়ে গেলো। বিকেলে লালপুরের খেজুরের রস দেখে যে লোভটা হয়েছিল, তা ততক্ষণে অনেকাংশেই প্রশমিত।
চলবে...
আরও পড়ুন>>>
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২০
এএ