সঙ্গে আরও কয়েক লাইন শুনিয়ে দিলেন আখাউড়া ইমিগ্রেশনে ট্রাভেল ট্যাক্স নেওয়ার দায়িত্বে থাকা আবুল কাশেম। পাশে বসা সুমন মিয়াও কাজে ফাঁকে ফাঁকে তার কথার সঙ্গে সুর মেলাচ্ছিলেন।
আবুল কাশেম বললেন, আপনাকে বাড়তি টাকা দিতে হবে। অন্যরা ঢাকা থেকে দিয়ে এসেছে, আপনি দিয়ে আসেননি কেন? আমরা আপনার জন্য এইযে ফরম পূরণ করে টাকা নিচ্ছি। এতে পরিশ্রম হচ্ছে এরই জন্য ১শ’ টাকা করে নিচ্ছি। হয় ১শ’ টাকা দিন, না হলে ঢাকায় গিয়ে দিয়ে আসতে হবে।
যারা নিয়মিত এ রুটে ভারত যাতায়াত করেন, তারা বিনা বাক্যব্যয়ে টাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ তারা জানেন এদের সঙ্গে বাক্যব্যয় করা বৃথা। তবে নতুন যারা এসেছেন তাদের দু’একজন আপত্তি জানালেও তাতে কোনো লাভ হচ্ছিলনা।
চোখের সামনে এমন বেশ কয়েক জনের কাজ থেকে বাড়তি টাকা তুললেন। মুক্তাদির নামের একজন এই টাকা দিতে অপারগতা জানালে কাস্টমস কর্মকর্তা তার পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে বললেন, আপনি তাহলে ব্যাংকে গিয়ে টাকা দিয়ে আসেন।
নাসির উদ্দিন নামের এক যাত্রীও এ বিষয়ে আপত্তি তুলে বললেন, আপনি রিসিট দিলে আমার টাকা দিতে আপত্তি নেই। আপনি রিসিট দিচ্ছেন ৫শ’ টাকার আর নিচ্ছেন ৬শ’ টাকা এটা অন্যায়।
নাছোড়বান্দা কাস্টমস কর্মকর্তা বললেন, তাহলে আপনার ট্যাক্স আমরা নিতে পারবো না। যাত্রীটি এবার উভয়সংকট দেখে খানিকটা অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্যহলেন। কারণ এদিন ছিলো শুক্রবার ব্যাংকে টাকা দেওয়া সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে ৫০ টাকা দেওয়ার অনুরোধ করলেও নিরাশ হতে হলো তাকে।
এ বিষয়ে ওই সময়েই কথা হয়, ট্রাভেল ট্যাক্স ও বাড়তি আদায়কারী আবুল কাশেমের সঙ্গে। তিনি এবারও একই বয়ান দিতে থাকেন। তার কাছে প্রশ্ন ছিলো, রাষ্ট্র কিংবা অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান যেখানেই থাকুক টাকা লেনদেন হবে রিসিটের মাধ্যমে। আপনারাতো রিসিট দিচ্ছেননা। তাহলে এই টাকা কোথায় জমা হচ্ছে।
এবার কিছুটা সুর নরম করে জানালেন, আসলে আমাদের টাকা নেওয়ার কথা না। আমরা যাত্রীদের উপকার করার জন্য টাকা নিচ্ছি। আর এই ১শ’ টাকা যেটা নিচ্ছি এটা বৈধ নয়। কিন্তু আমরা যে এই টাকা ব্যাংকে জমা দিতে যাবো!
বাংলাদেশ হয়তো অনেক অফিসার ভালো রয়েছেন। আবার অনেকে নানাভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। ঘুষ লেনদেনের খবর হর হামেশা শোনা যাচ্ছে। তবে কোথাও এমন প্রকাশ্যে ঘুষ আদায় করার ঘটনা সম্ভবত বিরল। অন্যত্র কর্মকর্তারা তার আচরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন ঘুষ না হলে তার কাজ হবে না। অথবা নানাভাবে তার বিলম্ব করা হয় বা হয়রানি করা হয়।
কিন্তু আখাউড়া সীমান্তে বেশ অবাকেই হতে হচ্ছে যাত্রীদের। প্রকাশ্যে টাকা আদায় করছে কাস্টমসের লোকজন।
এই সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন দেড় থেকে ২শ’ যাত্রী ভারত যাতায়াত করছে। শুধু বাঙালি নয় ভারতীয় এবং অন্যান্য দেশের অনেক ট্যুরিস্ট এই সীমান্ত ব্যবহার করছে। তাদের সামনেই এভাবে ঘুষ লেনদেনের ঘটনা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
অন্যদিকে কাস্টমস অফিসের যে রিসিটের মাধ্যমে ট্রাভেল ট্যাক্স আদায় করছে সেটির টাকা আসলে সরকারের কোষাগারে ঠিকমতো জমা হচ্ছে কি-না তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। কারণ তারা একটি সাদা কাগজে ছাপানো ফরমে নাম ও পাসপোর্ট নম্বর লিখে ৫শ’ টাকা হারে আদায় করছে। যার কোনো ফটোকপি যাত্রীদের কাছে থাকছে না।
এই ফটোকপি ফরমটির কোথাও সিরিয়াল নম্বর বা অন্য কিছু থাকছে না। তাহলে কোনো যাত্রীর টাকা জমা না দিয়ে যদি মেরে দেয় তাহলে ধরার কিছুই নেই বলে মন্তব্য করেছেন যাত্রী নাসির উদ্দিন।
দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) অনেকগুলো রাস্তা রয়েছে দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য। কিন্তু দিনের পর দিন এই অনৈতিক কার্যক্রম চললেও কোনো প্রতিকারই হচ্ছে না। যে কারণে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের লোকজন।
রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী সীমান্ত হচ্ছে আখাউড়া। ঢাকা থেকে মাত্র আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। আবার আরও একটি মজার বিষয় হচ্ছে এই সীমান্তের কোল ঘেঁষে ঐতিহাসিক আগরতলা শহর (ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী)। ইমিগ্রেশন পার হয়ে মেইন শহরে পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র ৫ মিনিট। আপনি চাইলে মাত্র ৩শ’ টাকা খরচ করে আগরতলা পৌঁছাতে পারবেন।
বাংলাদেশের আর কোনো সীমান্ত দিয়ে এতো কম সময় এবং সহজে ভারতের কোনো রাজ্যের রাজধানীতে পৌঁছা সম্ভব নয়। ছোট্ট পরিপাটি এই শহরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক ঐতিহাসিক নির্দশন রয়েছে। ইচ্ছে করলে সকালে এসে বিকেলে ঢাকায় ফিরে যাওয়া সম্ভব। অনেকেই এই পথ দিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪১ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১৭
এসআই/জিপি