কলকাতা (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত):
রমজান মানেই রকমারি খাবারে সেজে ওঠে সাহ্রি এবং ইফতারের থালা। গ্রাম থেকে শহর যেখানেই হোক ইফতারের খাবারের স্বাদ একটু অন্য।
তবে কলকাতায় শিরমল এবং বাকরখানি সাধারণ সাহ্রিতে ব্যবহার হয়। অন্য মাসে এই দুই খাবারের কদাচিৎ দেখা মিললেও রোজার মাসে চাহিদা থাকে তুঙ্গে। এই সময় কলকাতায় ঐতিহ্যবাহী শিরমল এবং বাকরখানির চাহিদা থাকে ব্যাপক। শহরের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ফুলবাগান, রাজাবাজার, তোপসিয়া এলাকার কারখানা থেকে বিভিন্ন জায়গায় প্যাকেট করে সরবরাহ করা হয় শিরমল এবং বাকরখানি।
রমজানের শেষ পর্যায়ে এসেও কলকাতার বিভিন্ন বেকারির কর্মীরা সুস্বাদু এই খাবার তৈরিতে ব্যস্ত আছেন। তারা জানান, প্রথমে ময়দা নিয়ে তার সঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় উপকরণ মেশিনের মাধ্যমে মেশাতে হয়। এরপর গোলা কেটে সেকার মেশিনে পাঠানো হয়। । ২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হিট দিলেই প্রস্তুত হয়ে যায় বাখরখানি। প্রায় একই পদ্ধতিতে তৈরি হয় শিরমল।
তবে রমজান শেষে বাকরখানি আর শিরমলের চাহিদা তেমন থাকে না, তাই এসব অঞ্চলের বেকারিগুলো ফের কেক তৈরিতে ফিরে যায়।
বাকরখানি ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। আবার ইসলামী ঘরনার শিরমল মুঘলদের হাত ধরে কাশ্মীর, লক্ষ্ণৌ, হায়দ্রাবাদ, ঢাকার মতো শহরে এর অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়তা এবং খাবার হিসেবে প্রচলন পায়। মুঘল শাসনকাল থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এই খাবারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। রমজান মৌসুমে কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিট, রাজাবাজার, তোপসিয়া, মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুরে পাওয়া যায় শিরমল এবং বাকরখানি। শিরমল শব্দটি এসেছে ফরাসি ভাষায় ‘শির’ শব্দ থেকে। শির শব্দের অর্থ দুধ। আর ‘মাল’ শব্দের অর্থ মাখানো বা দলা করা।
অথচ বাংলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বাকরখানি নাম। অতি প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক এই বাকরখানি। ইতিহাসের তথ্য মতে, জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকির খাঁর নাম অনুসারে বাখরখানির নামকরণ করা হয়েছে। বাকরখানির সঙ্গে রয়েছে এক প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর দত্তক ছেলে ছিলেন আগা বাকের। প্রখর মেধার অধিকারী আগা বাকের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। মুর্শিদাবাদের নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের পরস্পরের প্রেমে পড়েন। উজরিপুত্র নগরের কোতোয়াল জয়নাল খান, খনি বেগমকে প্রেম নিবেদন করলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি নামের পেছনে রয়েছে বাকের-খনির প্রেমের ইতিহাস। প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন রেখে যেতে আগা বাকের নতুন ধরনের শুকনো রুটি তৈরি করিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন বাকেরখনি। সাধারণ মানুষের উচ্চারণে আজ যা হয়ে গেছে বাখরখানি। আর এই বাকরখানি তৈরি হয়েছিল শিরমলের আদলে।
তবে কলকাতায় মোঘল আমলের মতো হাতে তৈরি শিরমলের চাহিদাও ব্যাপক। যদিও শহরের দুয়েক স্থানে হাতে তৈরি হয় শিরমল। বাকি আসে দিল্লি থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কলকাতার চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে অবস্থিত টিরিটি বাজার অর্থাৎ বড়বাজার অঞ্চলের একটি স্থানে তৈরি হয় হাতে বানানো শিরমল। তাও তারা দিল্লির কারিগর। গুঁড়ো দুধ, ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে ভালো করে মেখে তার গোলা বানিয়ে প্রথমে রুটির মতো বেলে নিতে হয়। তারমধ্যে পানি স্প্রে করে বিভিন্ন ধরনের ড্রাই ফ্রুটস আঠার মতো আটকে দেয়। এরপর তন্দুরি চুলায়, তন্দুরি রুটির মত সেঁকে নিয়ে ডুবন্ত ঘিয়ের পাতিলে চুবিয়ে দিলেই তৈরি হয় শিরমল। হাতে তৈরি শিরমলের দাম প্রতিপিস ৭০ থেকে ২০০ রুপি। ড্রাই ফ্রুটের ভ্যারাইটি বাড়লে দামও বাড়ে।
যদিও বেকারির তৈরি শিরমলে ড্রাই ফ্রুটস থাকে না। দেখতে বান রুটির মতো এবং আকার অনেকটা থালার মতো। তৈরি হয় দুভাবে; মিষ্টি ও সাধারণ। বিক্রেতাদের কথায়, রমজানে বিক্রি-বাট্টা ভালই হচ্ছে শিরমল এবং বাখরখানির। এসব বাকরখানির মূল্য প্রতি পিস ২০-৩০ রুপি এবং শিরমল সাধারণ ৪০ এবং মিঠা ৬০ রুপি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, ১২ এপ্রিল, ২০২৩
ভিএস/এমএমজেড