ঢাকা: ভারতীয় বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও ‘হাংরি জেনারেশন’র মূল রূপকার মলয় রায়চৌধুরী আর নেই। বুধবার সকালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার একটি হাসপাতালে তার জীবনাবসান ঘটেছে।
কলকাতার ঐহিক সাহিত্যগোষ্ঠীর কর্ণধার, কবি, গদ্যকার ও সংগঠক তমাল রায়কে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মলয় রায়চৌধুরীর পরিবার।
মলয় রায়চৌধুরীর ফেসবুক আইডিতে তার পরিবারের পক্ষে এ সংক্রান্ত একটি বার্তা দিয়েছেন মেয়ে অনুশ্রী প্রশান্ত। এতে বলা হয়েছে, ‘অত্যন্ত ব্যথিতচিত্তে ও গভীর শোকের সঙ্গে জানানো হচ্ছে যে, মলয় রায়চৌধুরী আজ সকালে মারা গেছেন। তার স্মৃতি আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে থাকুক এবং তার আত্মার শান্তি হোক। ’
কলকাতার ‘আদম’ প্রকাশনার কর্ণধার কবি গৌতম মন্ডল তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন: “চলে গেলেন হাংরি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি মলয় রায়চৌধুরী। তাঁর লেখা কবিতা যে আমাকে খুব আলোড়িত করে, তা হয়ত নয়। তাহলে?
তিনি মূল ধারার বাংলা কবিতার যে অনুশাসন তাকে শুরু থেকেই ভাঙচুর করতে চেয়েছেন। এবং তিনি নিজের অবস্থানে আমৃত্যু অটল ছিলেন, কখনো সেখান থেকে বিচ্যুত হননি। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। লিখেছেন উপন্যাস ও ছোটগল্পও। পোস্ট মডার্নিজমসহ বিভিন্ন ইজম নিয়েও তিনি বিস্তর লেখালেখি করেছেন। পড়েছেন বিশ্বসাহিত্য। শুধু পড়া নয়, বিশ্বসাহিত্যের অনেক উজ্জ্বল অধ্যায় তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার জন্য অশ্লীলতার দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন মামলা চলে। তিনিই হচ্ছেন গুটিকয়েক কবিদের মধ্যে একজন, যিনি কবিতা লেখার জন্য কারাবরণ করেন। ”
মলয় রায়চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর, সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলিকাতা খ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারে। তার বাবা গৌচপ্রম রায়চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী-ফটোগ্রাফার। মা অমিতা ছিলেন পাণিহাটিস্থিত নীলামবাটির কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (রোনাল্ড রস-এর সহায়ক) জ্যেষ্ঠ কন্যা। কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিষদের সংরক্ষিত সংগ্রহশালার (মিউজিয়াম) তথ্য অনুযায়ী মলয় রায়চৌধুরীর ঠাকুরদা লক্ষীনারায়ণ ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার-আর্টিস্ট। তার দাদা সমীর রায়চৌধুরীও একজন লেখক।
১৯৬১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করেন মলয় রায়চৌধুরী, তার বন্ধু দেবী রায়, বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী ও কবি শক্তি চট্টোপ্যাধ্যায়। পরবর্তীকালে উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, সুবিমল বসাক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র এবং তার বান্ধবী আলো মিত্র, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরীসহ আরও অনেকে এ আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৬৪ সালের হাংরি বুলেটিনে মলয় রায় চৌধুরী’র ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা প্রকাশিত হয় এবং ‘হাংরি বুলেটিন ১৯৬৪’ প্রকাশের পরে ভারতীয় আদালতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
১৯৬৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাংরি আন্দোলনকারীদের ১১ জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ড বিধির ১২০বি (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ), ২৯২ (সাহিত্যে অশ্লীলতা) ও ২৯৪ (তরুণদের বিপথগামী করা) ধারায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়; এদের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৫ সালের মে মাসে অন্য সবাইকে রেহাই দিয়ে কেবল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৯২ ধারায় চার্জশিট দেওয়া হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। প্রদীপ চৌধুরী বিশ্বভারতী থেকে বহিষ্কৃত হন। সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতা থেকে মফঃস্বলে বদলি করে দেওয়া হয়।
গ্রেপ্তারের সময় মলয় রায়চৌধুরীকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে দুই কিলোমিটার হাঁটিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে ব্যাংকশাল কোর্ট মলয় রায়চৌধুরীকে দু’শো টাকা জরিমানা, অনাদায়ে একমাসের কারাদণ্ড দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে মলয় রায়চৌধুরী কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দেন।
মলয় রায়চৌধুরীর প্রকাশিত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই শতাধিক। তার ১০টি কবিতাগ্রন্থ, ১০টি উপন্যাস, দুটি ডিটেকটিভ উপন্যাস, একটি ইরোটিক নভেলা, ১২টি সমালোচনা গ্রন্থ, চারটি জীবনী এবং বহু অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০২৩
এমকে/এইচএ/