অমর্ত্য সেন বলেছেন, বিগত পাঁচবছরের শাসনপর্বে এনডিএ জোট অর্থাৎ বিজেপি সরকারের আশাহত পারফরম্যান্স নিয়ে কী আর করা যাবে! বলতে দ্বিধা নেই, এই পাঁচবছরে বিজেপির কার্যকলাপ মারাত্মক রকম খারাপ। তবে এর আগে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারও যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল, সে কথাও বলা যায় না।
সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি।
অমর্ত্য সেন বলেন, এরপরও কংগ্রেস জোট ইউপিএ সরকার কিছু ইতিবাচক কাজ করেছিল। যেমন- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক স্তরে রূপান্তর, যার মধ্যে পড়ছে তথ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও প্রাথমিক স্তরে স্বাস্থ্য পরিষেবা টুকু দেওয়ার কাজে মোটেও সফল হয়নি কংগ্রেস। তাছাড়া জাতপাতের বিনাশ করে ভারতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি তারা।
তিনি বলেন, বিজেপি জোট এনডিএ কীভাবে ব্যর্থ হলো, তা বুঝতে গেলে দুই সরকারের কর্মকাণ্ডের দিকেই সমান দৃষ্টিপাত করা দরকার। সমস্যাটা হলো- কংগ্রেস জমানার পরে যেসব শূন্যস্থান পূরণ করার দরকার ছিল বিজেপি এসে সে চেষ্টাটাই করেনি। উল্টো শূন্যস্থানগুলোকেই দিনকে দিন বাড়িয়ে দিল প্রবলভাবে।
‘জাতপাতের অশুভ থাবাকে আরও শ্বাসরোধী করে তুলেছে তারা। এছাড়া গত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যা বলেছিল, তার ঠিক উল্টো পথে হেঁটে বেকারত্ব বাড়িয়ে দিল। ফলে দেশের দারিদ্যের শিকার জনগোষ্ঠীর পক্ষে কর্মসংস্থান ঢের কঠিন হয়ে পড়লো। ’
নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সাম্প্রদায়িক স্তরে দেশটাকে আরও ভেঙেচুরে দিয়েছেন বিজেপি নেতারা। সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে মুসলিমদের জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ দশায় পৌঁছালো। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আমলাতন্ত্রের জালে কীভাবে কষে বেঁধে ফেলা যায়, সে কাজে বিষম তৎপর হয়ে উঠলো বিজেপির কেন্দ্রীয় শাসক সংগঠন। পাশাপাশি বাক-স্বাধীনতা খর্ব করা হল। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে দেশদ্রোহের তকমা এঁটে জনগণকে ভরে দেওয়া হচ্ছে জেলে।
‘আসল বিষয় ভারতকে সম্পূর্ণ ভুল একটি দিশায় এগোতে বাধ্য করলেন এই হিন্দুত্বপূজারী শাসকেরা। পাশাপাশি অর্থনীতিকে রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে হিন্দুত্ববাদী শাসকেরা ঠিক করলেন একেবারে জাদুবলে উন্নয়ন নিয়ে আসবেন। যেমন, ডিমানিটাইজেশন অর্থাৎ চালু কারেন্সির একটি অংশকে অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হলো। প্রতিশ্রুতি ভেঙে তারা ভাবলেন, দেশে সম্পদ সৃষ্টি করবেন। তারা দাবি করলেন- দেশের কালো অর্থের বিনাশ হবে! বাস্তবে তা তো হলই না, বরং দেশের অগণিত ছোট ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তার কাজকর্মে ধাক্কা খেল বিপুলভাবে। কৃষিক্ষেত্রেও তার ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে পারলো না। ’
নতুন সরকারের প্রতি প্রত্যাশার কথা জানিয়ে অমর্ত্য সেন বলেন, রূপকথার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বরং ভারতের এমন কিছু অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করা উচিত যাতে সুফল মেলে। অর্থাৎ যেসব নীতির ফলে দুনিয়াতে সুফল মিলছে। এই মুহূর্তে ভারতের যা যা প্রয়োজন, তার মধ্যে অন্যতম হলো- দক্ষ এবং নিরপেক্ষ সরকারি পরিষেবা, বিকাশ, ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং সুনির্বাচিত কিছু সরকারি উদ্যোগ। তাছাড়া সত্যিকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যা কার্যক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী হবে।
তার মতে, ইউরোপ এবং জাপান যে শিক্ষাটা উনিশ শতকে নিয়েছিল, বিশ শতকে নিয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন। ভারতেরও সেই একই শিক্ষাগ্রহণ জরুরি। আধুনিক অর্থনীতির জনক অ্যাডাম স্মিথকে যদি অনুসরণ করতে হয়, তাহলে যথাযথ উৎসাহ প্রদান এবং নিরপেক্ষতায় অবিচল থাকার কাজটা তখনই সম্ভব হবে। আবার তারই পাশে এটাও স্মরণে রাখা দরকার যে, চীনা অর্থনীতিকে বিপুল সাহায্য করেছে দেশজুড়ে শিক্ষিত এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শ্রমিককুল।
তিনি বলেন, কংগ্রেস সরকারের উপরে এই অবহেলার কিছু দায় বর্তায় ঠিকই, তবে বিজেপি সরকারের কার্যক্রম দেখে মনে হয়, ভারতের এই মুহূর্তে যা যা প্রয়োজন, সেসবের পাটই তুলে দেওয়া হয়েছে। এবার সে দিশাতেই ভারতে একটা গঠনমূলক পরিবর্তন প্রয়োজন।
‘তা সে স্বাস্থ্যখাতেই হোক বা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নীতির ক্ষেত্রেই হোক। এই কথাটা বুঝে নেওয়া জরুরি,’ যোগ করেন এই বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৯
ভিএস/এমএ