ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভারত

ভারতের রাজনীতিতে বাম দলগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক?

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৫৯ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৯
ভারতের রাজনীতিতে বাম দলগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক? পশ্চিমবঙ্গে বামেদের শোডাউন।

কলকাতা: ভারতজুড়ে চলছে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন। সাত দফার নির্বাচনের ফল জানা যাবে আগামী ২৩ মে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী না কংগ্রেস, নাকি আঞ্চলিক দলগুলোর জোটের কেউ ক্ষমতায় আসবেন। 

যদিও এই হিসেবের মধ্যে নেই এখনও বামদলগুলো। কিন্তু নির্বাচনের মধ্যে অর্থাৎ যতদিন ভোট চলবে, ততদিন ভারতের জ্বলন্ত ইস্যুগুলো নিয়ে ততটা চর্চা করেন না ভারতীয়রা।

 

একটা গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় নির্বাচনের সময় দেশের প্রধান সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার উল্টো পথেই হাটে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী সমর্থকেরা।  

লক্ষ্য করা যায়, বিরোধী নেতাদের নিয়ে ঠাট্টা, মস্করা, নিন্দায় মেতে থাকতে তারা বেশি আগ্রহী। বাদ নেই বামেরাও।  

অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রধান নেতার মুখ সামনে রেখেই গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি সেরে ফেলতে চায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মোদী-মমতা বা রাহুল। গঠনমূলক বিতর্কের রীতি আজও ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল। এই সমস্যা শুধু ভারতের রাজনীতিতেই নয় বরং বলা য়ায় এটি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির বড় সমস্যা। এ বিষয়ে বামেরা অকেটাই প্রাসঙ্গিক। কারণ তারা আজ ব্যক্তি থেকে দলতন্ত্রকেই গুরুত্ব দেয় বেশি।

ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার একটি দেশে ইস্যুর খামতি নেই। দেশটির বিশাল জনসংখ্যার মতই সমস্যার ইস্যুও নানা। কৃষকের ঋণের সমস্যা, সেচের পানির সমস্যা, দারিদ্র্যের সমস্যা, শিক্ষার  সমস্যা, ধর্মীয় সমস্যা, বেকারত্ব সমস্যা, জাতপাতের সমস্যা।  

এছাড়াও ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য বিভিন্ন অংশের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ধারার সমস্যা রয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় দলসহ আঞ্চলিক দলগুলোর হাতেও থাকে একাধিক ইস্যু।

এ কথা মেনে নেওয়া বেশ কষ্টেরও বটে। এত বড় জনসংখ্যার একটি দেশে নির্বাচনের সময়েও একচেটিয়া জাতীয়তাবাদ, সেনাবাহিনীর শৌর্য ইত্যাদি নিয়ে শোরগোলের মধ্যে বিরোধী ইস্যু করতে পারলেও পাল্টা কোনো অ্যাজেন্ডা তৈরি করতে পারেনি বামেরা।  

ইস্যু আছে কিন্তু তা নিয়ে কথা নেই বরং উল্টোপথে হেঁটে জনপ্রিয়তা লাভ করতে বিরোধীরা গিমিক বা চটকদারী কথাকেই হাতিয়ার করে নিয়েছে। ভারতের রাজনীতিতে যাকে বলা হয়, পপুলিস্ট পলিটিক্স।  

অপরদিকে বাম ভাবাদর্শে চিরকালই ‘আন্ডার কারেন্ট’ রয়েছে। সেই বাম ভাবাদর্শে জ্বলন্ত ইস্যুগুলোর সঙ্গে চটকদারী কথা মিশিয়ে উঠে আসছেন কানাইয়া কুমারের মতো জনপ্রিয় বামনেতারাও।

কানাইয়া কুমার দিল্লি জেএনইউ সাবেক ছাত্র তথা নিজে বিহারের প্রার্থী হলেও বাম সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে ছুটে চলেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।  

তার জনসভায় যথেষ্ট ভিড়ও হচ্ছে। সম্প্রতি পশ্চিমবাংলায় এসেছিলেন কানাইয়া। সেখানে জনসভায় বলেছেন, ‘দিদি (মমতা) মুসলমানের বন্ধু হতে চাইছেন৷ মোদী হিন্দুদের বন্ধু হতে চাইছেন৷ কেউ বলছে হিন্দু বিপন্ন৷ কেউ বলছে মুসলমান বিপন্ন৷ আসলে আজ দেশের সংবিধানই বিপন্ন। ’ 

বামেরা বলছেন, মোদী-মমতা দেশে বিভাজনের ইতিহাস তৈরি করছেন৷ পুজো, ঈদ, মহরম করতে সরকারি সাহায্যের কী প্রয়োজন আছে? মন থেকেই এই উৎসব পালন করা যায়৷ বিজেপির রথযাত্রা একটা বড় ষড়যন্ত্র৷ রামায়ণে রয়েছে, রাম চলেন পাঁয়ে হেঁটে৷ রাবণ আসেন রথে৷ বিজেপি ওই রথেই, রাম রথযাত্রা করবে৷ বুঝে দেখুন মোদী রাম না রাবণ৷
এছাড়া ভারতের মতো আধা সামন্ত্রতান্ত্রিক ও আধা পুঁজিবাদী দেশে, গত বছরের ১২ মার্চ মহারাষ্ট্রে বামেদের নেতৃত্বে কৃষকদের ‘লং মার্চ’ মোদী-মমতা-রাহুলের যথেষ্ট চক্ষুশুল হয়েছে। যে সুশৃঙ্খলভাবে ভারতের নাসিক থেকে মুম্বাই পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার কৃষক, সিপিআইএম-এর নেতৃত্বে লং মার্চ করেছিল তা ভারতের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

একই সঙ্গে কলকাতার যাদবপুর কেন্দ্র এবং দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রের প্রার্থী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য ও নন্দিনী মুখার্জীর সমর্থনে, মমতার গড়ে অর্থাৎ তার বাড়ির ঢিল ছোড়া দুরত্বে যে পদযাত্রায় বিশাল জমায়েত করেছিল তা রাজ্য শাসক দলের ভ্রু কুঞ্চনের কারণ হতেই পারে। বলা যায়, ভারতের সামাজিক পরিস্থিতিতে পায়ের তলার মাটি শক্ত হচ্ছে বামেদেরে।

উপযুক্ত পরিস্থিতি থাকলেও এখনও বাম ভাবাদর্শের প্রতি আগ্রহ সেভাবে লক্ষ্যণীয় নয়। কেন তারা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ছে? বর্তমান ভারতের বাম রাজনীতিতে যেটা অভাব তা হল সদিচ্ছা এবং নতুন ভাবনার।  

১৮৪৮ সালে রচিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর বাইরে ভারতীয় বামেরা তাত্ত্বিক ভাবে এগোতে পারেনি। কিন্তু এর মাঝে চলে গেছে প্রায় ১৭১টি বছর। ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বামদের এই অচলাবস্তার ব্যাপারটি সবচেয়ে বেশি নিরাশজনক।  

দুনিয়াজুড়ে রাজনৈতিক ভাবাদর্শের নীরিখে সমাজতন্ত্র বিপন্ন হলেও বামপন্থার কোনো দার্শনিক বিকল্প এখনও সামনে আসেনি। বরং ইউরোপের কিছু পুঁজিবাদি দেশেও নতুন করে চিন্তাভাবনা নিয়ে বামপন্থার  বিকাশ ঘটছে।  

এ প্রসঙ্গে স্পেনের সাম্প্রতিক নির্বাচনে বামেদের উত্থানের দিকে নজর দেওয়া যায়। যদিও স্পেনের সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতির পার্থক্য আকাশ-পাতালের। কিন্তু তবুও একথা অস্বীকার করা যায় না গোটা বিশ্বের মানুষের কাছেই মূল সমস্যাগুলোও প্রায় এক।

ভারতের মতো দেশে যেখানে এখনও বাঁচার ন্যূনতম জিনিষগুলো পেতে অবিরাম লড়াই করতে হয় বেশি অংশের মানুষকে, সেখানে বামপন্থার সম্ভাবনা যথেষ্ট। সেকথা বলার জন্য রাজনীতির বোদ্ধা হতে লাগে না।  

ভারতের রাজনীতি এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় বর্তমানে যে বইটির কথা প্রায় সব জায়গায় উঠে আসে সেটি হলো নোবেলজয়ী অর্থনিতিবিদ অমর্ত্য সেনের লেখা ‘দ্য আর্গুমেন্টিভ ইন্ডিয়ান’।

কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। একদল বাম আছেন যারা জন গণতান্ত্রিক বিল্পবের স্বপ্নে আর একদল আছেন ক্ষমতার সিঁড়িভাঙা অঙ্কে। আর এ কারণেই বর্তমান পরিস্থিতিতে জনবিচ্ছিন্নতায় আছে বামেরা। তাই ভারতের কেরেলা ছাড়া আর কোনো রাজ্যেই আজ বামেরা ক্ষমতায় নেই। কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতা দখল ছাড়া বামপন্থীরা কিছুই করে উঠতে পারেনি? তারা যেমন দাগ কাটতে পারেনি নির্বাচনের নীরিখে তেমনি তারা মধ্যবিত্ত অথবা গরিব ভারতীয়দের নিজেদের দল হয়ে উঠতেও পারেনি।  

অন্যদিকে গরিবদের না হলেও অন্তত মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের দল হয়ে উঠতে পেরেছে কংগ্রেস ও বিজেপি। এই ব্যর্থতার প্রধান কয়েকটি কারণ। ভোটের রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে বামেরা হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের পথই।  

শুধুমাত্র নির্বাচনে লড়ে ক্ষমতার অলিন্দে ঘুরতে থাকা বামপন্থাকেও অবক্ষয়ের ঘুণপোকায় গ্রাস করেছে। পশ্চিমবঙ্গে বামেরা ভূমি সংস্কারের মতো পদক্ষেপ নিতে পেরেছিল কারণ তখনও তাদের মধ্যে সাম্য গঠনের আন্দোলনের আদর্শ ভরপুর ছিল।

কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অভ্যাসের ফলে খাতা কলমে আদর্শ, দর্শন থাকলেও সেই আদর্শ থেকে বামেরা বিচ্যুত হয়েছিল; পাশাপাশি মাটির সঙ্গে যোগাযোগটাও তাদের হারিয়ে যায়। সেই যোগাযোগ আজও জুড়তে পারেনি বামেরা।

অপর কারণ বামেদের নিজেদের মধ্যে অব্যাহত ভাঙন। ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) তৈরি হয়। আরএসএস বর্তমানে বিজেপির চালিকা শক্তি। আজকের ভারতে বামদের মূল  বিরোধী আরএসএস। ১৯২৫ সালে তৈরি হয়ে একবারও ভাঙনের মুখে পড়েনি দলটি।

কিন্তু ১৯৬৪ সালে সিপিআই ভেঙে তৈরি হয় সিপিআইএম। এই একবারই শুধু দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া নয় বামেদের মধ্যে মতাদর্শ গত কারণে অসংখ্যবার ভাঙন এসেছে। ১৯৬৪ এরপর ১৯৬৯ সালে সিপিআইএম ভেঙে তৈরি হয় সিপিআই-এমএল।  

১৯৭২ সালের পর সিপিআই (এমএল) অনেকগুলো টুকরোয় ভেঙে আরও বেশ কয়েকটি দল তৈরি হয়। ভাঙনের এই পরম্পরার ধরেই সিপিআই(এমএল) থেকে তৈরি হয় সিপিআই -পিপিলস ওয়ার গ্রুপ।

২০০৪ সালে সিপিআই পিপিলস ওয়ার গ্রুপ আর ভারতের মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার মিলে তৈরি হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) বা সিপিআই (মাওবাদী)। যারা ভারতে ‘মাওবাদী’ বলেই বেশি পরিচিত।

এত ভাঙনের পরেও ভারতের জনগণের বড় অংশের ভিতরে বামেরা তাদের ভিত মজবুত করতে পারেনি বরং ক্রমশ দূরে সরে গেছে। যার সমাধান করতে হবে বামেদেরই। তাদের ভাবতে হবে মঞ্চ তৈরি থাকলেও কেন তারা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

তবে ইতিহাস বলে, ঘূর্ণিঝড়ের মতো বারবার টুকরো হয়েই আবার একত্রিত হয় তারা। অন্য কোনো নামে আবার অন্য কোনো পতাকার তলায়। বামেদের অস্তিত্ব খর্ব হয় কিন্তু মুছে যায় না। তাই এবারের নির্বাচনে কি ফল হয় তা বিষয় নয়। ভারতের জ্বলন্ত ইস্যুগুলোকে কিভাবে হাতিয়ার করবে তা উপরেই নির্ভর করবে ভারতের বাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৯
ভিএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।