কলকাতা: ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখনও একটা প্রবাদ চলে- ‘যার আইতে সাল, যাইতে সাল তার নাম বরিশাল’। কস্মিনকালে বরিশাল যেতে কত সাল লাগত তা বাংলার প্রজন্ম না জানলেও তিনটি ‘সাল’ যে মমতার সরকারের কাছে শালগাছে পরিণত হয়েছে তা সবাই বুঝতে পারছে।
যদিও গতকাল ‘চাকরির আশ্বাস দিয়েছে মমতার সরকার’। তবে ঘোষণা ২০০৯ সালে প্রাথমিকে নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করেছিলেন, তাদের জন্য। তারা ৩৭ দিন ধরে অবস্থান বিক্ষোভ করছিলেন গান্ধীমূর্তির পাদদেশে। তারাই এখন পর্য়ন্ত সরকারি আশ্বাস পেয়েছে। বাকী দুই সাল এখনও অধরা। তবে অচিরেই সমস্যা মিটবে এই আশাতেই রয়েছেন তারা। সহজ ভাষায় বলতে ২০০৯ এবং ২০১৪ সাল সরকারি প্রাইমারি স্কুলে নিয়োগ ২১০৭ সাল নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগ।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘টিচার এলিজিবেলিটি টেস্ট (টেট ‘ তখনও চালু হয়নি। ক্ষমতায় তখন বামেরা। ২০০৯ সালে রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এরপর যথারীতি নিয়োগের পরীক্ষাও (টেট) হয় ২০১০ সালের জুলাই মাসে। কিন্তু ততদিনে ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ঢাকি কাঠি পড়েছে গিয়েছে। রাজ্যজুড়ে তখন পরিবর্তনের হাওয়া। মমতার হাওয়া সবকিছু ওলট-পালট করে দিচ্ছে।
২০০৯ সালের চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, ১৪ জেলায় নিয়োগ হলেও বঞ্চিত থেকে যায় ৫ জেলা। প্রসঙ্গত, রাজ্যে তখন ১৯টি জেলা। দুই ২৪ পরগনা, মালদহ, হাওড়া ও পূর্ব মেদিনীপুর -এই জেলাগুলি প্রার্থীরা বাদ পড়ে চাকরি থেকে। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবাদল ঘটে। প্রাথমিকে যে পাঁচ জেলায় নিয়োগ বাকি ছিল, সেই ৫ জেলায় ফের পরীক্ষা হয় তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায়। এমনকি, চাকরিও পেয়ে যান উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, মালদহ ও পূর্ব মেদিনীপুরের পরীক্ষার্থীরা। বাদ পড়ে গেল দক্ষিণ ২৪ পরগনা। কেন বাদ পড়ল? চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, পর্ষদকে বারবার জানিয়েও সমস্যার সমাধান হয়নি। তৎকালীন রাজনৈতিক মহলের ব্যখ্যা বামঘাটি হিসেবেই পরিচিত ছিল সংশ্লিষ্ট জেলাটি।
দীর্ঘ ক্ষোভ-বিক্ষোভের পর চলতি বছর ২০০৯ সালের চাকরিপ্রার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভে বসার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশের অনুমতি না পেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তারা। পূজার মধ্যেও চাকরিপ্রার্থীদের রাস্তায় বসে বিক্ষোভে অনুমতি দেয় আদালত। হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা বলেছিলেন, ‘যোগ্য প্রার্থীরা রাস্তায় বসে চাকরি ভিক্ষা করবে, আর পূজা আছে বলে পুলিশ তাদের আন্দোলন করতে দেবে না। এটা হয় না। এটা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ’ সেই ৩৭ দিনের মাথায় বুধবার (৯ নভেম্বর) আন্দোলনে ইতি টানলেন চাকরিপ্রার্থীরা। আশ্বাস দিলেন মমতা সরকার। সংক্ষেপে এই ছিল ২০০৯ সালের প্রাইমারি স্কুলের চাকরিপ্রত্যাশীদের ঘটনা।
এবার আসা যাক ২০১৪ সাল। টেট নিয়ে গোটা বাংলাজুড়ে এক পরিস্থিতি। ছাই চাপা আগুনের মত জ্বলতে থাকেন তারা। তারই মধ্যে আবার নির্বাচনের হাওয়া। ২০১৬ ফের ক্ষমতায় আসেন মমতা। ওই বছর শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ২১ সাল অবদি শিক্ষার দায়িত্ব ছিল পার্থর। তবে শিক্ষামন্ত্রী যে মমতা জন্য মোটেও সুখকর নয় তা টের পেয়ে নেত্রী সম্ভবত, ২১ সালের নির্বাচনে পার্থকে আর শিক্ষা দফতর থেকে শিল্প দফতরে স্থানান্তর করেন। তবে শিল্প না শিক্ষা কোনোটা নেত্রীর কাছে গুরুত্ব তা অবশ্য তিনিই জানেন। তবে পার্থ ভবিষ্যত সুখকর হলো না। কলকাতা হাইকোর্টর নির্দেশে আর ইডি জেরায় বর্তমানে তিনি জেলে।
কিন্তু ২০১৪ প্রার্থীদের কি হবে? তাই তারাও ঠিক করলেন একইভাবে ২০০৯ সালের চাকরিপ্রত্যাশিদের মত বিক্ষোভ অবস্থানে যাবেন। কিন্তু ২০০৯ থেমেছিল একটি জেলায়। ২১০৪ -র প্রার্থীরা তো রাজ্যজুড়ে। তাই তাদের তাদের লোক সংখ্যা বেশি আন্দোলেনের ঝাঁঝও বেশি। সম্প্রতি সল্টলেকের করুণাময়ীর সড়কে বসে টানা চারদিন বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। আদলতের ১৪৪ ধারা নির্দেশ দেখিয়ে বিক্ষুদ্ধদের তুলেও দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু, সেদিনে পুলিশি নির্যাতন দেখে আদালত ভর্ৎসনা করে পুলিশকে বলেছিলেন- ‘১৪৪ ধারা জারি মানে নির্যাতন নয়। ’
সেদিনও রক্ত ঝড়েছিল রাজপথে, যা নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। প্রসঙ্গত, রাজ্যের পুলিশমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ফলে বুধবার( ৯ নভেম্বর) কিছুটা কৌশলেই কলকাতার রাজপথে নিজেদের দাবি দাওয়া নিয়ে পথে নেমেছিল তারা। গতকাল ২০১৪ সালের হাজার হাজার প্রার্থী নিয়োগের দাবি জানাতে কলকাতার রাজপথে নামেন। স্তব্ধ হয় কলকাতা। শুরুতেই চাকরিপ্রত্যাশীদের পুলিশ বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। রক্ত ঝরে রাজপথে। রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে কলকাতার রবীন্দ্রসদন সংলগ্ন এক্সাইড মোড় এবং ক্যামাক স্ট্রীট।
তাদের কি আর ধরনায় বসতে দেওয়া হবে? এই নিয়ে যখন সরকার - আদালতে বাদানুবাদ। তখন বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা জানিয়েদিলেন, আপাতত ৪০ দিনের জন্য একই স্থানে ধরনা দিতে পারবেন ২০১৪ সালের টেট চাকরিপ্রার্থীরা। তবে এখানেই শেষ নয়। প্রাইমারি স্কুলের চাকরিপ্রত্যাশীদের যখন এই পরিস্থিতি তখন যুক্ত হলো, আরও এক আন্দোলন। স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)। তারা হলেন, রাজ্যের নবম থেকে দ্বাদশের চাকরপ্রার্থী। তারাও যুক্ত হলেন গান্ধী মুর্তির পাদদেশ। তাদের ধরনা এদিন ৬০৬ দিন পার করেলো।
এরা সবাই ২০১৭ সালে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। মেধা তালিকায় নাম আছে। তবু চাকরি পেলো না। যারা শুধু উত্তীর্ণ হলো অথচ মেধা তালিকায় নাম নেই। অভিযোগ, অর্থের বিনিময় তারাই চাকরি পেতে শুরু করে। এনাদেরও মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টে। আর এনাদের মামলা থেকেই সিস্টেমে পরিস্থিতিটা জন সাধারণের প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ তল্লাশি শুরু হতেই ধরা পড়েন সাবেক মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তার বন্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক তথা শিক্ষা পর্ষদের মানিক ভট্টাচার্য্য, কল্যাণময় বন্দোপাধ্যায়-সহ অনেকেই।
২০১৮ সালে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশচন্দ্র অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারী অন্যের চাকরি পেয়ে শিক্ষিকা হয়েছিলেন। তাও জানা গেল চলতি বছর। মামলাকারী ববিতা বিশ্বাস অর্থাৎ যার নাম বাদ দিয়ে অঙ্কিতা চাকরি হয়েছিল, সেই ববিতার দাবি, তিনি ৭৭ নম্বর পেয়েও চাকরির জন্য যোগ্য বলে রাজ্য সরকারের কাছে বিবেচিত হননি। অথচ অঙ্কিতা ৬১ নম্বর পেয়েই চাকরি পেয়েছেন। এরকম অনেক অঙ্কিতাদের চাকরি হয়েছে ববিতাদের না জানিয়ে।
তারই মধ্যে বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) ফের প্রাথমিক পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করছে না প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ। তাই প্রাথমিক টেটের আসন্ন নিয়োগপ্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারেন তিনি। আগে এমনই মন্তব্য করেছিলেন বিচারপতি। এদিন আবারও তিনি জানালেন, সোমবার (১৪ নভেম্বর) পর্যন্ত দেখা হবে। নির্দেশ কার্যকরী না হলে পরীক্ষা বন্ধ করে দেব। মূলত, ৮২ পেলেও পাশ করানো হচ্ছে না বলে দাবি করে মামলাকারীদের।
অন্যদিকে, গত কয়েক দিন ধরে চাকরির দাবিতে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন টেট এবং এসএসসি চাকরিপ্রার্থীরা। এতে সাধারণ মানুষের অসুবিধা হচ্ছে বলে পাল্টা জনস্বার্থ মামলা হয় হাইকোর্টে। সেই মামলার রায়দান স্থগিত রেখেছে কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু সরকার বাহাদুর কি করবেন তার অপেক্ষা পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার শিক্ষিত বেকাররা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, ১০ নভেম্বর, ২০২২
ভিএস/এসএ