সম্প্রতি শক্তিশালী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বহু মানুষ হতাহত হয়েছে।
ইস্তানবুলের বাসিন্দা আয়সেগুল রাহভানসির ভয়, শহরে পরবর্তী শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। তিনি বলেন, আমরা সংকটের মধ্যে রয়েছি। উদ্বেগের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন কাটছে।
আয়সেগুলের মতো ইস্তানবুলের অনেকের শঙ্কা, বড় কোনো ভূমিকম্প তাদের শহরে আঘাত হানতে পারে। গেল সোমবার ৭ দশমিক ৮ ও ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে রোববার পর্যন্ত তুরস্কে নিহতের সংখ্যা ২৪ হাজার ছাড়িয়ে যায়। কর্মকর্তারা জানান, নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই।
তুরস্কের অবস্থান ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। এখানে কয়েকটি টেকটোনিক প্লেট মিলিত হয়েছে। প্লেটগুলোর সীমানা বরাবর সাধারণত ভূমিকম্প হয়ে থাকে। উত্তর আনাতোলিয়ান ফল্ট ইউরেশিয়ান ও আনাতোলিয়ান প্লেটকে যেখানে বিভক্ত করেছে, তা ইস্তানবুল থেকে কাছেই।
ইস্তানবুলের ইলদিস টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুকরু এরসয় বলেন, বিগত সময়ে আঘাত হানা ভূমিকম্পের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন মডেল পর্যালোচনা করে আমরা বলতে পারি ভূমিকম্প ইস্তানবুলের ক্লাছে। অবাক হবো না যদি এটি আজই আঘাত হানে। এই দুর্যোগ কখন ঘটবে, তা জানা অসম্ভব।
ইস্তানবুলের মেয়র একরেম ইমামোগ্লু সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ২০ মিলিয়ন বাসিন্দার মহানগরে ৯০ হাজারের মতোই ভবন রয়েছে, যা ভূমিকম্পের জন্য বেশ দুর্বল।
তিনি বলেন, আরও এক লাখ ৭০ হাজার ভবন রয়েছে মাঝামাঝি ঝুঁকিতে। ইস্তানবুল পৌরসভা এই গবেষণা পরিচালনা করেছে।
সোমবারের ভূমিকম্পে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে ছয় হাজার ৪০০ ভবন ভেঙে পড়েছে। পরের সপ্তাহের রোববার পর্যন্তও অনেকে ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছেন। উদ্ধারকারীরা তাদের উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নতুন ভবনে বাস করা ব্যয়বহুল
ইস্তানবুলের বাসিন্দারা তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের খবর শুনে ব্যথিত হয়ে পড়েছেন। তারা জানতে পারছেন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইস্তানবুলে ভূমিকম্পের শঙ্কা বেশি।
আয়সেগুল রাহভানসি কাদিকয় জেলায় বাস করেন। সেখানে তিনি বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, একটি ভবনে আমি প্রায় ২৫ বছর ধরে বাস করছি। নতুন ভবনে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। কারণ ভাড়া অনেক বেশি।
বেয়োগ্লু জেলায় ৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো ভবনে বাস করেন জেয়নেপ উরস। তিনি বলেন, নতুন ভবনে যেতে চাই। সামর্থ্যের মধ্যে কোনো ভবনে যাওয়া এই মুহূর্তে বেশ কঠিন।
তিনি বলেন, আমি সাধারণত আমার ভবনের ওপরেই আস্থা রাখি। তবে শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্পে এটি টিকে থাকবে, সেই ক্ষেত্রে আমি ইতিবাচক নই। ভবনের বয়স নিয়ে আমি চিন্তিত।
১৯৯৯ সালে তুরস্কে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৭ হাজার ৫০০ লোক নিহত হওয়ার পর দেশটির সরকার ভবনবিধি বা বিল্ডিং কোড নির্ধারণ করে দেয়।
পরের বছরের শেষের দিকে তুরস্কের সিসমিক ডিজাইন কোড আধুনিক করা হয়। দেশটির সরকার বড় পরিসরে শহর রূপান্তর পরিকল্পনা হাতে নেয়, যাতে ভূমিকম্পের জন্য দুর্বল ভবনগুলোকে শক্তিশালী করা যায়।
আয়সেগুল রাহভানসি ও উরস- কারো ভবনেরই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল না, ছিল না তথাকথিত ভূমিকম্প প্রতিবেদনও। এসব ভবনের অবস্থান ছিল ভূমিকম্পের পর নতুন নিয়ম গ্রহণ করা মারমারা অঞ্চলে।
কাদিকয়ের আরেক বাসিন্দা উগুর কুমতাস বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে যে ভবনে বাস করেন, সেই ভবনের ওপর তার আংশিক আস্থা রয়েছে।
২০২০ সালে তার ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ৫৭ বছর বয়সী কুমতাস বলেন, নতুন নিয়ম মেনেই ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। এই বাসিন্দা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেই কাজ করেন।
তিনি বলেন, আমি যে ভবনে বাস করি তাতে আমি ৮০ ভাগ নিরাপদ বোধ করি। শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প হলে ভবনটি ভেঙে পড়তে পারে। তবে আমার বিশ্বাস এটি ভাঙবে না।
কুমতাস পরিবারের বাইরে যখন অন্য কোনো ভবনে থাকেন, তখন ভূমিকম্পে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলা তিন বাসিন্দারই ভূমিকম্পের কোনো প্রস্তুতি নেই শুধু একটি জরুরি ব্যাগ ছাড়া।
কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য বলছে, ইস্তানবুলে ২০০০ সালের আগে নির্মাণ করা আট লাখ ১৬ হাজার ভবন রয়েছে, যা শহরের সব ভবনের মধ্যে ৭০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে।
ভেঙে পড়ছে নতুন ভবনও
গেল সপ্তাহে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে ভূমিকম্পের আঘাতে বেশ কয়েকটি ভবন ভেঙে পড়েছে, যেগুলো ২০০০ সালের আগে নির্মিত। প্রতিবেদন বলছে, ভেঙে পড়া বেশিরভাগ ভবনই ২০০০ সালের আগের।
সুকরু এরসয় বলেন, তুরস্কে ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পর নির্মিত বেশিরভাগ ভবনই নতুন নিয়ম অনুযায়ী নির্মিত। এসব ভবনে উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তুরস্কে নির্মাণ খাতে অনেক দুর্নীতি রয়েছে। পাশাপাশি অপব্যবহারও রয়েছে। ভবন পরিদর্শনে গিয়ে তার এমন অভিজ্ঞতা হয়।
তিনি বলেন, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে ভূমিকম্পে কিছু নতুন ও বিলাসবহুল ভবনও ভেঙে পড়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৩
আরএইচ