ঢাকা, বুধবার, ১১ চৈত্র ১৪৩১, ২৬ মার্চ ২০২৫, ২৫ রমজান ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

সব হারানো ফিলিস্তিনিরা কীভাবে ইফতার করছেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০২৫
সব হারানো ফিলিস্তিনিরা কীভাবে ইফতার করছেন?

ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের শহর রামাল্লাহর মাঝারি মানের হোটেলগুলোয় ইফতারের সময় গেলে দেখা মিলবে শত শত বাস্তুচ্যুত মানুষের। প্রাণ বাঁচাতে গাজা থেকে সরে আসা আশ্রয়হীন মানুষগুলোর বেশিরভাগই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হোটেলগুলোয় লম্বা টেবিলের চারপাশে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে তারা ইফতারের জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করেন।

নীরব থাকলেও এসব ফিলিস্তিনির বুকে বাঁধা সব হারানোর গল্প। তাদের কেউ কেউ ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটেন, ইসরায়েলের আগ্রাসনে তারা হাত-পা হারিয়েছেন। অসুস্থ শিশুদের দেখাশোনা করছেন তাদের বাবা-মা। তাদের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। তাদের কেউ কেউ সন্তানের চিকিৎসার জন্য যুদ্ধের আগে জীবনসঙ্গীকে ছাড়া এসেছিলেন। কারও কারও সন্তান বেঁচে নেই। ফের যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তারা নিজের ভূমিতে আর ফিরে যেতে পারেননি। পশ্চিম তীরে তাদের আশ্রয় আছে, দয়ালু মানুষেরা সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছেন। ঘরহারা মানুষগুলো গাজার পরিস্থিতি চিন্তা করেই বেঁচে আছেন।  

২০০২ সাল থেকে আবু আল-আম প্রতি রমজানে ইফতার পরিবেশন করেন। তিনি সিদি শায়বান কমিউনিটি কিচেনের পরিচালক। বর্তমান অস্থির সময়ে তিনি ও তার স্বেচ্ছাসেবকরা দ্রুত ইফতার বিলি করেন। রান্না হওয়ার ১৫-২০ মিনিটের মাঝেই খাবারের ট্রে আর বাক্স বিলি-বণ্টন শুরু করেন তারা। যখন পর্যাপ্ত খাবার থাকে না, তখন দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া খাবার বিলি করেই তাদেরকে থামতে হয়।

ইফতার শুরু হলেই বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় ও দোয়া পড়তে পড়তে ইফতার করেন। আবু আল-আম আর তার স্বেচ্ছাসেবক দল সবার ইফতার নিশ্চিত করে নিজেরা সবার শেষে রোজা ভাঙেন।

৪৩ বছর বয়সী আবু আল-আম নিজের বাসাকেই আপাতত রান্নাঘর বানিয়ে ফেলেছেন। সোফা ও কার্পেট সরিয়ে বড় চুলা বসিয়েছেন। সেখানে বিশাল বিশাল কড়াইয়ে ইফতার রান্না চলে। তার স্বেচ্ছাসেবকেরা তাকে কুটা-বাছায় সাহায্য করেন। মাগরিবের আযানের আগেই সব আয়োজন শেষ করার টার্গেট থাকে তাদের। তার আগেই মেহমানেরা আসতে থাকেন। কেউ সেখানে বসে ইফতার খান। কেউ বা খাবার নিয়ে যার যার আশ্রয়ে চলে যান।

আবু আল-আম জানান, রান্নাঘরের ধারণাটি তিনি দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় পেয়েছেন। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অবরোধের ফলে অনেক পরিবার বিপদে পড়েছিল। তাদের সাহায্য করার জন্য এমন উদ্যোগের প্রয়োজন পড়ে। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শেষ হওয়ার পর ফিলিস্তিনি জনগণের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে উদ্যোগটি আরও বড় হয়েছে।

২০১৫ সালে ধারণাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা পায়। তখন আবু আল-আমের রান্নাঘরটি বর্তমান নাম পায়। এরপর থেকে মহামারি, দখলদারিত্ব ও অর্থনৈতিক দুর্দশা এসেছে, গেছে। কয়েক বছর ধরে ফিলিস্তিনি স্বেচ্ছাসেবকরা পূর্ব জেরুজালেম থেকে শুরু করে গাজাতেও ইফতার আয়োজন করছেন। অন্য সময়েও তারা খাবার বিতরণ করেন।

‘রহমতের টেবিল’ নামে পরিচিত গণইফতার রমজান মাসে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের শত বছরের পুরনো ঐতিহ্য। এর মাধ্যমে তারা এক হন, পবিত্র মাসের চেতনায় নিজেদের উদারতা ও সংহতি বৃদ্ধি করেন।

আবু আল-আম একজন সরকারি চাকরিজীবী। তার দুটি সন্তান আছে। তিনি আবু জানান, চ্যালেঞ্জ যত বড়ই হোক না কেন তার রান্নাঘরের লক্ষ্য, যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানো। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে তিনি বলেন, অনেক গভর্নরেট, এমনকি গাজাতেও তিনি সহায়তা পাঠিয়েছেন। তার পুরো কার্যক্রম অনুদান নিয়ে চলে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নিজের বাড়িটিকে দাতব্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। আর নিজে থাকছেন অন্য জায়গায়। দাতাদের কাছ থেকে কী পরিমাণ অনুদান পাচ্ছেন, সেটির ওপর তার এই কার্যক্রমের সক্ষমতা নির্ভর করে।

গাজায় মহামারির পর থেকে চাহিদা বেড়েছে বলে জানান আবু আল-আম। তারপর উপত্যকায় শুরু হয় ইসরায়েলি আগ্রাসন। পশ্চিম তীরে বিধিনিষেধ কঠোর করা হয়। ফলে আরও বেশি পরিবার দুর্দশায় পড়ে। যাদের আয়-রোজগার স্থিতিশীল ছিল, ২০২৩ সালের অক্টোবরের যুদ্ধের পর তারাও সব হারিয়ে ফেলেন। ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের চাকরিতে বাধা তৈরি করে। তাদের পরিবারগুলোর ঠিকে থাকা অনিশ্চিত হয়ে যায়।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিম তীরজুড়ে ৯০০টিরও বেশি স্থানে ইসরায়েল রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে অঞ্চলটি এলোমেলো হয়ে পড়েছে। অনেক ফিলিস্তিনির জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আবু আল-আমেরও রান্নাঘর চালাতে সমস্যা হচ্ছে। তিনি আর তার টিম বিভিন্ন গভর্নরেটের স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেছেন।

আবুর স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন শিরিন। খাবারের কষ্টে পড়েই তিনি প্রথম এই রান্নাঘরের খোঁজ পেয়েছিলেন। জীবনের কঠিন সময়ে এখান থেকে তিনি আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন। নিজের ও সন্তানদের থাকার ঘরের খরচ বহন করতে অনুদান থেকে তাকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়েছিল। এই রান্নাঘরের জন্যই তিনি তার সন্তানদের পড়ালেখা করাতে পারছেন। কৃতজ্ঞতার জায়গা থেকে তিনি এখন আবু আল-আমের কিচেনে স্বেচ্ছাসেবক। খাবার তৈরি ও রান্নাঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে সাহায্য করেন। তার সন্তানরা আবু আল-আমের সঙ্গে খাবার বিতরণ করে।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০২৫
এমএইচডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।