সারাদিন ধরে ইসরায়েলি বিমান হামলার খবর সংগ্রহের পর গত রোববার রাতে খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের সামনে একটি তাঁবুতে সহকর্মীদের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আবেদ শাত। ৩৩ বছর বয়সী এই ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই গাজায় মাঠে ছিলেন, দিনরাত সংগ্রহ করছিলেন ছবি ও তথ্য।
হঠাৎ এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে চারপাশ। ঘুম ভেঙে যায় শাত ও অন্যান্য সাংবাদিকদের। তারা ভীত ও বিভ্রান্ত হয়ে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। শাত মোবাইল হাতে তুলে ধরেন—অভ্যস্তভাবে ভিডিও ধারণের জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু তখনই তিনি বুঝতে পারেন, এই বিস্ফোরণ কেবল আরেকটি হামলা নয়—এটি সরাসরি তাদের লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে। সাংবাদিকদের তাঁবুতে এই হামলার বাস্তবতা তাকে হতবাক করে।
এই হামলা চালানো হয় টিভি চ্যানেল ‘প্যালেস্টাইন টুডে’-র সাংবাদিকদের তাঁবুতে। দূর থেকে শাত ছবি তুলছিলেন, কিন্তু জ্বলন্ত তাঁবুর কাছাকাছি গিয়েই তিনি দেখেন, তার এক সহকর্মী আগুনের মধ্যে পুড়ছেন। ক্যামেরা নামিয়ে রেখে ছুটে যান তাকে বাঁচাতে। শাত বলেন, আগুন ভয়াবহ ছিল। একটি গ্যাস ক্যানিস্টার বিস্ফোরিত হয়েছিল, অন্যটি তখনো জ্বলছিল। আমি তার পা ধরে টান দিতে চেষ্টা করি, কিন্তু প্যান্ট ছিঁড়ে যায়। এরপর অন্যভাবে চেষ্টা করি, কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। আগুন এতই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল যে, শেষমেশ আমাকে সরে যেতে হয়।
এরপর কিছু মানুষ পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। শাত বলেন, আমি হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়ি, তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।
হামলায় প্যালেস্টাইন টুডের সাংবাদিক হিলমি আল-ফাকাওয়ি ও ইউসুফ আল-খাজিন্দার নিহত হন। আরও আহত হন হাসান ইসলাইহ, আহমেদ আল-আগা, মুহাম্মদ ফায়েক, আবদুল্লাহ আল-আত্তার, ইহাব আল-বারদিনি এবং মাহমুদ আওয়াদ।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক্স-এ (সাবেক টুইটার) দাবি করেছে, তারা এই হামলা চালিয়েছে হাসান আবদেল ফাত্তাহ মুহাম্মদ ইসলাইহকে লক্ষ্য করে। ইসরায়েলের অভিযোগ, তিনি হামাসের সদস্য, সাংবাদিকের ছদ্মবেশে ছিলেন। কিন্তু সেই দাবি প্রমাণে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
সাংবাদিক ইসলাইহর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুল অনুসারী রয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে দক্ষিণ ইসরায়েলের ওপর চালানো হামলার সময় তিনি ঘটনাস্থল থেকে রিপোর্ট করেছিলেন, যার জেরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে বারবার হুমকি দিয়েছিল।
ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা বেসামরিক প্রাণহানির ঝুঁকি কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু একটি ঘুমন্ত সাংবাদিকদের তাঁবুতে বোমা হামলা চালিয়ে একজনকে ধরার সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তির ব্যাখ্যা দেয়নি।
প্যালেস্টাইন জার্নালিস্ট সিন্ডিকেট বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ২০০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। গাজায় চলমান যুদ্ধকে তারা সাংবাদিকদের জন্য আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই সাংবাদিকরা হাসপাতাল চত্বরে আশ্রয় নিচ্ছেন, যেখানে অপেক্ষাকৃত ভালো ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তা থাকে। আবেদ শাত বলেন, আমরা এখানেই থাকি, এখানেই ঘুমাই, এখানেই কাজ করি। পরিবারকে এতটা দেখি না, যতটা একে-অপরকে দেখি। আমাদের বন্ধন এখন শুধু কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা তার চেয়েও গভীর।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গাজায় সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্নতা নয়। বৈরুতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা পর্যবেক্ষক সংস্থা সামির কাসির ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র জাদ শাহরৌর বলেন, ইসরায়েল একাধিকবার গাজা ও লেবাননে সাংবাদিকদের অবস্থানগুলো সরাসরি টার্গেট করেছে। এটি যুদ্ধাপরাধ—আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে এটি কোনোভাবেই বৈধ নয়।
গাজায় নিহত অন্য সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন আল জাজিরার সাংবাদিক হোসাম শাবাত এবং রিপোর্টার হামজা দাহদুহ, যিনি আল জাজিরার গাজা ব্যুরো প্রধান ওয়ায়েল দাহদুহের ছেলে। দুজনকেই তাদের গাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। ইসরায়েল দাবি করে, তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন—কিন্তু প্রমাণ দেয়নি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫০ হাজার ৭০০ জন। এর বড় অংশই নারী ও শিশু। যাদেরকে ইসরায়েল কখনো ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দেয়নি। অনেক বেসামরিক পুরুষও নিহত হয়েছেন, যারা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সুরক্ষিত ছিলেন।
এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে—কে হবে পরবর্তী শিকার? শাহরৌর বলেন, ইসরায়েল চায় না কেউ সত্যটা জানুক, সেকারণেই তারা সাংবাদিকদের হত্যা করে। যুদ্ধাপরাধের তথ্য যেন বাইরে না যায়, সেটাই তাদের লক্ষ্য।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ইউনিয়ন গাজায় সাংবাদিকদের ওপর হামলার আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা দাবি করে।
হিলমি আল-ফাকাওয়ির জানাজা থেকে ফিরে আবেদ শাত আল জাজিরাকে বলেন, আমি যা দেখেছি, তা এখনো ভুলতে পারছি না। কখনো কল্পনাও করিনি, আগুনে পুড়তে থাকা একজনকে আমি নিজে টেনে বের করতে যাবো। উদ্ধার চেষ্টায় তার দুই হাত সামান্য পুড়ে গেছে, এখন ক্যামেরাও ধরতে পারেন না। আমি একেবারে ভেঙে পড়েছি। আমরা কাদের জন্য কাজ করছি? কেউ কি এসব ভাবছে? এ দৃশ্যের চেয়ে ভয়াবহ কিছু আর কী থাকতে পারে?
শেষে শাত বলেন, এই প্রথম কেউ আগুনে পুড়ে মারা গেল এমন নয়। সাংবাদিকদের এভাবে টার্গেট করাও নতুন কিছু নয়। আমরা জানি না, এরপর কার পালা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০২৫
এমএইচডি/এমজে