মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইরানে ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের বিষয়ে বিবেচনা করছেন, যার মধ্যে ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানতে ‘বাংকার ধ্বংসকারী বোমা’ ব্যবহারের চিন্তাও রয়েছে—তখন হোয়াইট হাউসে শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে কীভাবে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে না জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেই হামলা চালাতে পারে।
সূত্র জানায়, ট্রাম্প এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী না করার বিষয়ে, যা গত বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছিল।
সপ্তাহান্তে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মিত্র দেশ জানতে পেরেছে, ট্রাম্প প্রশাসন ঠিক করেছে, ইসরায়েল তাদের প্রথম সপ্তাহের অভিযান থেকে কী অর্জন করে তা দেখার পরেই যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সম্পদ ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এমন তথ্য দিয়েছেন ইউরোপের দুই কূটনীতিক।
সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়সীমার একদিন আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। বুধবার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে বলেননি তারা কোন পথে এগোবেন।
একটি সূত্র জানায়, ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে সরে আসার সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। ট্রাম্প বলেন, “আমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক সেকেন্ড আগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করি। বিশেষ করে যুদ্ধের বিষয়ে, কারণ যুদ্ধ খুব দ্রুত এক চরম অবস্থা থেকে আরেক চরম অবস্থায় চলে যেতে পারে। ”
সূত্র বলছে, ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালেও তা মানেই যুদ্ধে জড়িত হওয়া নয়। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠরা যুক্তি দিচ্ছেন, নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে নির্দিষ্ট, সীমিত আঘাত ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধ’ নয়।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রিডম্যান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “আমেরিকা হয়তো ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় কয়েকটি MOAB (মাদার অব অল বম্বস) ফেলে দেবে, সবশেষ পারমাণবিক সুবিধা ধ্বংস করে সেখান থেকেই সরে আসবে। ”
তিনি আরও বলেন, “আকাশপথ তো আগে থেকেই খালি। এটাকে যুদ্ধ টেনে নেওয়া বলা যাবে না। ”
যুদ্ধবিরোধী সতর্কতা ও হরমুজ প্রণালির ঝুঁকি
যখন ট্রাম্প সম্ভাব্য পদক্ষেপ বিবেচনা করছেন, তখন তার প্রশাসন মিত্র দেশগুলোর কাছ থেকে বারবার আহ্বান পাচ্ছে—মার্কিন হামলা যেন না হয়। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে, মার্কিন হামলা হলে ইরান হয়তো আরও দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার পথে এগিয়ে যাবে। ইরান ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যদি মার্কিন বাহিনী ইসরায়েলের সঙ্গে হামলায় অংশ নেয়, তাহলে তারা প্রতিশোধ নেবে।
ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মাজিদ তাকত-রাভানচি সিএনএনকে বলেন, “যদি আমেরিকা সামরিকভাবে জড়ায়, তাহলে আমরা যেখানে প্রয়োজন মনে করব, সেখানেই জবাব দেব। এটা একেবারে স্পষ্ট ও সরল, আমরা আত্মরক্ষায় কাজ করব। ”
সোলাইমানি মডেল ও সেনা প্রস্তুতি
ট্রাম্পের উপদেষ্টারা ২০২০ সালে কাসেম সোলাইমানিকে বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে MQ-9 ড্রোন দিয়ে হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করছেন, যেটা ছিল একটি বড় পদক্ষেপ, কিন্তু পূর্ণ যুদ্ধ শুরু হয়নি।
সেই হামলার প্রসঙ্গ তুলে তারা বলছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের হামলা মানেই সবসময় যুদ্ধ নয়”।
তবে ট্রাম্প সরাসরি জানিয়েছেন, তিনি আপাতত ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করছেন না।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেন, “আমার এবং চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব হচ্ছে সবসময় প্রেসিডেন্টকে বিকল্প ব্যবস্থা ও সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত রাখা”।
সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফ ট্রাম্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা হয়ে উঠেছেন। ৮ জুন ক্যাম্প ডেভিডে এক অবহিতকরণ সভায় তিনি ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম ও ইসরায়েলের সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বাহিনীর প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলাও ট্রাম্পের ওপর প্রভাব রাখছেন। তিনি ও আরও কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ইসরায়েলের সহায়তায় আরও সামরিক সম্পদ চাইছেন, বিশেষ করে হুথি বিদ্রোহীসহ ইরানের মিত্রদের প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়ে যুদ্ধ এড়াতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক
ওয়াশিংটনের কোয়িন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী সহ-সভাপতি ত্রিতা পারসি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের হামলা মানেই ইরান যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ঘাঁটিগুলোর ওপর পাল্টা আঘাত হানবে এবং এতে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বেঁধে যাবে। যুদ্ধটি দীর্ঘ হতে পারে না ইরানের জন্য, তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ হবে না। ”
ট্রাম্পের অনেক ঘনিষ্ঠ সমর্থকও এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির চেয়ারম্যান, আইডাহোর সিনেটর জিম রিশ বলেন, “এই যুদ্ধ আমাদের নয়, এটা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে। আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট অনেক জটিল পরিস্থিতিতে চমৎকারভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ”
আরেক রিপাবলিকান সিনেটর, জোশ হাওলি বলেন, “আমি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হামলা চাচ্ছি না। আমরা আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ চাই না। আমি সাম্প্রতিক সামরিক শক্তি বৃদ্ধি নিয়েও কিছুটা উদ্বিগ্ন। ”
ট্রাম্প চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই মার্কিন বাহিনী ইরানের সম্ভাব্য পাল্টা আঘাত মোকাবিলায় জরুরি প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানায় একটি সূত্র।
নেতানিয়াহুর সঙ্গে বারবার আলোচনায় ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেলে ইসরায়েলের লক্ষ্য বাস্তবায়ন সহজ হবে। তিনি বলেন, “শুধু আমরাই সেটা করতে পারি, তবে তার মানে এই নয় যে, আমরা করব”।
তবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রত্যাহারের বিষয়ে ট্রাম্প তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, “আমি শুধু একটা জিনিস চাই, ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র না পায়। এটাই সব। আমি দীর্ঘমেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি কিছু দেখতে চাই না। আমি ২০ বছর ধরেই এটা বলছি। ”
সূত্র: সিএনএনের প্রতিবেদন বাংলা ভাষ্যে উপস্থাপন
এমজেএফ