ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

মসজিদে ঘেরা এক শহর

মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩২ ঘণ্টা, মে ৬, ২০১৫
মসজিদে ঘেরা এক শহর

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অফুরান সম্পদে সমৃদ্ধ জেলা ঝিনাইদহ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের এই জনপদটি অনেক আগেই ছিল সমৃদ্ধ।

এককালে এ অঞ্চলটি সুন্দরবনের বর্ধিত অংশ হিসেবে গণ্য হতো। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এ অঞ্চলকে ‘সূর্যদ্বীপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সুলতানি আমলের অনেক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন এ জেলায় বিদ্যমান। এই ঐতিহ্যমণ্ডিত ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার এক ইউনিয়নের নাম ‘বারোবাজার’। প্রাচীন নাম ‘মোহাম্মদাবাদ’। এলাকাটি সুলতানী আমলের ধ্বংশপ্রাপ্ত ও প্রায় ধ্বংশপ্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষকরে এখানে সুলতানী আমলের প্রায় ধ্বংশপ্রাপ্ত অবস্থায় বেশ কিছু ঢিবি ও স্থাপত্যিক নিদর্শন এখনো বিদ্যমান।

প্রত্নস্থলটি যশোর জেলা শহর থেকে ১৬ কিমি উত্তরে এবং কালীগঞ্জ বাজার থেকে ১২ কিমি দক্ষিণে ভৈরব নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত। খুলনা-পার্বতীপুর রেল সড়ক এবং যশোর-ঝিনাইদহ প্রধান সড়ক সমান্তরালভাবে বারোবাজারের মধ্যে দিয়ে প্রসারিত।

১৯৯৩ সালে এখানকার মাটি খুড়ে সন্ধান মিলেছে পনেরটিরও বেশি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই প্রাচীন মসজিদ। এসব স্থাপনাগুলো ৭০০ বছরেরও বেশি পুরানো।

শহর মোহাম্মদাবাদের পুরানো ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, প্রাচীনকালে বারোবাজারের নাম ছিল ‘ছাপাইনগর’। এ নগর ছিল হিন্দু আর বৌদ্ধ শাসকদের রাজধানী। বারোজন সহচর নিয়ে খানজাহান আলী রহ. এখানে আসেন। সেখান থেকেই এর নাম বারোবাজার। যুদ্ধ কিংবা মহামারিতে ছাপাইনগর ধ্বংস হয়ে যায়। থেকে যায় প্রাচীন ইতিহাস।

বারোবাজারের মসজিদগুলোর সঙ্গে বাগেরহাটের কয়েকটি মসজিদের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বারোবাজার। মহাসড়ক ছেড়ে তাহেরপুর সড়ক ধরে পশ্চিম দিকে যেতে রেল লাইন পেরিয়ে হাতের ডানে শুরুতেই পাওয়া যাবে এক গম্বুজ বিশিষ্ট ‘পাঠাগার মসজিদ’। লাল ইটের তৈরি এই মসজিদ আকারে ছোট। দীর্ঘদিন মাটি চাপা পড়ে থাকার পর ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি সংস্কার করে। জনশ্রুতি আছে সুলতানী আমলে নির্মিত এই মসজিদ কেন্দ্রীক একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল।

আবারও তাহেরপুর সড়ক ধরে সামনে এগুতে হবে। দুটি বাঁক ঘুরলেই বিশাল দিঘি, নাম পীর পুকুর। পশ্চিম পাড়ের মাঝ বরাবর বেশ বড় আকৃতির মসজিদ ‘পীর পুকুর মসজিদ’। এই মসজিদও ছিল মাটির নিচে। ১৯৯৪ সালে খনন করে বের করা হয়েছে। এই মসজিদে ছাদ নেই, শুধু দেয়াল আছে। মসজিদটি লাল ইটের তৈরি।

তাহেরপুর সড়ক ধরে সামান্য পশ্চিম দিকে এগুলে হাতের বাঁয়ে একটু ভেতরের দিকে আরেকটি মসজিদের দেখা মিলবে। এর নাম ‘গোড়ার মসজিদ’। এই মসজিদ চার গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদের মেহরাব ও দেয়ালে পোড়ামাটির ফুল, লতাপাতা ফলের নকশাসহ নানান কারুকার্য মণ্ডিত। বাইরের দেয়ালও লাল ইটে মোড়ানো।

১৯৮৩ সালে এই মসজিদের সন্ধান পায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এর পূর্ব পাশেও বড় আকৃতির একটি দিঘি আছে। মসজিদটি খননের সময় একটি কবরের সন্ধান মেলে। জনশ্রুতি আছে কবরটি গোড়াই নামে কোন এক দরবেশের। এ থেকেই এর নাম ‘গোড়ার মসজিদ’।

গোড়ার মসজিদ থেকে তাহেরপুর সড়কের উত্তর পাশে আরও একটি মসজিদ। ‘গলাকাটা মসজিদ’। প্রায় ২১ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া এই মসজিদ খনন করা হয় তোলা হয় ১৯৯৪ সালে। ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব আছে। এর দেয়ালগুলো প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া। মাঝখানে আছে লম্বা দুটি কালো পাথর। জনশ্রুতি আছে, বারোবাজারে এক অত্যাচারী রাজা ছিল। প্রজাদের বলি দিয়ে ওই দিঘির মধ্যে ফেলে দিত। এ কারণেই এর নাম হয় গলাকাটা।

গলাকাটা মসজিদ থেকে সামান্য পশ্চিম পাশে, সড়কের বিপরীত দিকে আরেকটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। নাম ‘জোড় বাংলা মসজিদ’। মসজিদটি খনন করা হয় ১৯৯৩ সালে। খননের সময় এখানে একটি ইট পাওয়া যায়, তাতে আরবী অক্ষরে লেখা ছিল, ‘শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইন, ৮০০ হিজরি। ’ এ শিলালিপিটি এখানকার প্রত্নতত্ত্বের অন্যতম দলিল। এ থেকেই বোঝা যায়, নিদর্শনগুলো প্রায় ৭০০ বছরের প্রাচীন। জনশ্রুতি আছে মসজিদের পাশে জোড়া কুড়েঘর ছিল বলেই এর নাম জোড় বাংলা মসজিদ।

এবার পাশের সড়ক ধরে আরও কিছু দূরে এগুলে ‘সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ’-এর সাইন বোর্ড চোখে পড়বে। পাকা সড়ক ছেড়ে হাতের ডানে মেঠোপথে সামান্য সামনের দিকে চলতে হবে। এখানেও বড় একটি পুকুরের দক্ষিণ পাশে সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। এটির শুধু দেয়াল আর নিচের অংশই অবশিষ্ট আছে। জানা জায় সর্বপ্রথম গ্রামের লোকজনই মাটিচাপা পড়ে থাকা এই মসজিদ উদ্ধার করে। আকারে এ এলাকার সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি। প্রায় ৭৭ ফুট লম্বা ও ৫৫ ফুট চওড়া মসজিদের ভেতরে আছে ৪৮টি পিলার। পশ্চিম দেয়ালে লতা-পাতার নকশা সমৃদ্ধ তিনটি মেহরাব আছে।

বারোবাজার রেল লাইনের পশ্চিম দিকে বিশাল এক দিঘির পশ্চিম পাড় ধরে একটি সড়ক চলে গেছে হাসিলবাগ গ্রামে। এখানেও একটি বড় দিঘির পশ্চিম পাশে রয়েছে এক গম্বুজ বিশিষ্ট ‘নুনগোলা মসজিদ। ’ বর্গাকৃতির এ মসজিদে তিনটি অর্ধ বৃত্তকার মেহরাব আছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এটি। স্থানীয়রা একে ‘লবণগোলা মসজিদ’ও বলে থাকেন।

নুনগোলা মসজিদের সামান্য পশ্চিমে হাসিলবাগ গ্রামে আরও একটি এক গম্বুজ মসজিদ আছে। ‘হাসিলবাগ মসজিদ’ নামে পরিচিত এ মসজিদের মূল নাম ‘শুকুর মল্লিক মসজিদ’। পোড়া মাটির তৈরি মসজিদটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ।

এসব স্থাপনাগুলো ছাড়াও বারোবাজারে আছে আরও কিছু প্রসিদ্ধ স্থান। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ঘোপের ঢিবি কবরস্থান, নামাজগাহ কবরস্থান, জাহাজঘাটা, মনোহর মসজিদ, দমদম প্রত্নস্থান, বাদেডিহি কবরস্থান, খড়ের দিঘি কবরস্থান।

ঐতিহাসিক এসব মসজিদের কারণে এ এলাকাকে বলা হয়, মসজিদের পল্লী। আর ঝিনাইদহকে ‘মসজিদে ঘেরা শহর’। বারবাজারের ঐতিহ্যবাহী এসব মসজিদ মাটি সরিয়ে আবিষ্কার করা হলেও তার ইতিহাস কিন্তু ‘মাটিচাপা’ পড়েই থাকছে। ঝিনাইদহবাসী মনে করে বারোবাজারসহ আরো অনেক নির্দেশনা রয়েছে যেগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। তাদের প্রত্যাশা যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাববে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩১ ঘন্টা, মে ০৬, ২০১৫
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।