ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ইসলাম

পতাকা সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক

মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
পতাকা সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায়, সর্বপ্রথম পতাকা ব্যবহার করেছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম

একটি পতাকা নিছক একখণ্ড কাপড় নয়। বরং একটি পতাকা মনে একটি জনগোষ্ঠী। একটি পতাকা মানে একটি আলাদা স্বাধীন ভূখণ্ড। একটি পতাকা মানে একটি শক্তি।

একটি পতাকা অনেক মানুষের সুখ, মর্যাদা, গৌরব ও স্বপ্ন। একটি পতাকা নিছক একখণ্ড কাপড় নয় বরং একটি আমানত, একটি গুরুদায়িত্বের নাম।

 

পতাকার ব্যবহার পৃথিবীতে নতুন নয়। ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায়, সর্বপ্রথম পতাকা ব্যবহার করেছিলেন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। হজরত লুত আলাইহিস সালামকে সহযোগিতা করার জন্য কওমে লুতের বিপক্ষে তিনি যে বাহিনী প্রেরণ করেন তাদের হাতে তিনি একটি পতাকা তুলে দিয়েছিলেন।  

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করে সব ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে নিয়ে ওহিভিত্তিক নতুন একটি স্বাধীন সার্বভৌম আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন।

তিনি ওই রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান ব্যক্তি ও সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি যে সব সামরিক অভিযান পরিচালনা করতেন অথবা প্রেরণ করতেন সেগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে তিনি পতাকা ব্যবহার করতেন।  

প্রতিটি সামরিক বাহিনী প্রেরণের সময় বাহিনী প্রধান কিংবা কমান্ডারের হাতে তিনি যুদ্ধের পতাকা তুলে দিতেন। অনেক সময় একই যুদ্ধে প্রধান পতাকার পাশাপাশি উপবাহিনীর হাতেও ভিন্ন ভিন্ন পতাকা দিতেন।

ইবনে হিশাম ও ওয়াকিদীর মতে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) হোদায়বিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরের পর থেকে মক্কা বিজয় (জানুয়ারি ৬৩০ খ্রি.) পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মোট ১৭টি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তিনি উত্তরদিকে যে তিনটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন- মুতার যুদ্ধ তন্মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।  

রোমীয় সামন্তরাজ মোরাহ বিল মুতা নামক স্থানে মুহাম্মদ (সা.) প্রেরিত মুসলিম রাজদূতকে হত্যা করেন। নবী করিম (সা.) তখন বাধ্য হয়ে অষ্টম হিজরিতে জায়েদ ইবনে হারেসার নেতৃত্বে একদল সৈন্য মুতাভিমুখে পাঠিয়ে দিলেন। সিরিয়া সীমান্তে মুতা প্রান্তরে দুই দলে তুমুল যুদ্ধ হয়। মুসলিম দলে সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার এবং অন্যদিকে রোমানরা ছিল লক্ষাধিক। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেনাপতি জায়েদ এবং পরে জাফর ও আবদুল্লাহ শহীদ হন।  
মুসলমানদের এ বিপর্যয়ের মুখে মহাবীর খালিদ সেনাপতিত্ব গ্রহণ করে প্রচণ্ড বিক্রমে শত্রুদের ওপর আঘাত হানে এবং মুসলমানরা বিজয় লাভ করে।

ঐতিহাসিক সেই মুতার যুদ্ধে মহানবী হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় ৩ সাহাবী জীবন দিয়ে বিশ্ববাসীকে শিখিয়ে গেছেন কিভাবে নিজেদের পতাকাকে ভুলুণ্ঠিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হয়। পতাকার মর্যাদা রক্ষা করতে হয়।  

যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে
মুতার উদ্দেশ্যে বাহিনী গঠন করার পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত জায়েদ ইবনে হারেসাকে বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করে পতাকা অর্পণ করেন। এর পর ঘোষণা করেন, জায়েদের পর যুদ্ধ পরিচালনা করবে জাফর ইবনে আবু তালেব। তারপর যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা।  

মুসলিম বাহিনী মুতা প্রান্তরে পৌঁছার পর হজরত জায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) পতাকা হাতে যুদ্ধ শুরু করেন। শত্রুর আঘাতে তিনি শহিদ হলে পতাকা গ্রহণ করেন হজরত জাফর ইবনে আবু তালেব (রা.)। যুদ্ধের তীব্রতায় শত্রুর আক্রমণে তিনি এক হাত হারিয়ে ফেললে অপর হাতে পতাকা ধরে রাখেন। পরে যখন তার দ্বিতীয় হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তিনি দু’পা দিয়ে পতাকা উঁচু করে রাখেন। শত্রুরা তার পা কেটে ফেললে তিনি মুখ দিয়ে কামড় দিয়ে পতাকার খুঁটি সমুন্নত করে রাখেন। তার চার হাত পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তিনি নিজে মাটিতে পড়ে গেছেন কিন্তু পতাকা মাটিতে পড়তে দেননি।

শত্রুর সর্বশেষ আঘাত যখন তার দেহকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে তখন পরবর্তী কমান্ডার আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে তৃতীয় কমান্ডার আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাও শহিদ হয়ে যান। তখন আরেক সাহাবী হজরত সাবেত ইবনে আরকাম নিজে উদ্যোগী হয়ে পতাকা রক্ষায় এগিয়ে আসেন এবং রাসূলের পতাকা উঁচু করে রাখেন। তিনি মুসলিম বাহিনীর উদ্দেশ্য বলতে থাকেন, তোমরা তাড়াতাড়ি চতুর্থ কমান্ডার মনোনীত করো। উপস্থিত সাহাবাদের পরামর্শে হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) মুতার যুদ্ধের চতুর্থ সেনাধ্যক্ষের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করে পঞ্চম পতাকাবাহীর হওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেন।  

আল্লাহতায়ালার রহমতে সাহাবি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)-এর হাতে মুতা প্রান্তরে মুসলমানদের অবিষ্মরণীয় বিজয় অর্জিত হয়।  

এভাবে রাসূলের সাহাবারা ছিলেন পতাকা সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর। পতাকার সম্মানকে তারা নিজের জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করতেন।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।