কাশ্মীরে আল্লাহর সৃষ্টি-সৌন্দর্য ও শ্যামলি নিসর্গের রূপ-আবহ দেখে ভাবনায় আকুল হতে হয়। মনোরম, নয়নাভিরাম, হৃদয়লোভন ও ভুবন-ভোলানো—আরও কতো বিশেষণে ব্যক্ত করা যায়।
কাশ্মীরের মনোলোভা প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের দাস্তান নিয়ে কবিতা লিখেছেন বহু নামজাদা কবি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা রচনা তৈরি করেছেন কত বিদগ্ধ লেখক। ভ্রমণকাহিনি নির্মাতারা সাজিয়েছেন বয়ন-সৌকর্যের মুক্তোগাথা।
যে কেউ ‘হিমালয় কন্যা’ কাশ্মীর নিয়ে কলম ধরেছেন, তিনি এ ‘ফিরদাউস’র রূপব্যঞ্জনা মনের রং-মাধুরী মিশিয়ে চিত্রায়ণ করেছেন। বলাবাহূল্য, সুন্দরের কারণেই কাশ্মীর মানুষের হৃদমিনারে আলাদা স্থান করে আছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় কাশ্মীরে মসজিদের উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। মূলত ইতিহাস পরম্পরায় মুঘলরা পরিকল্পনা মাফিক বেশ কিছু মসজিদ নির্মাণ করে কাশ্মীর অঞ্চলে। সেগুলো বর্তমানে অন্যতম স্থাপত্য-বিস্ময়ের স্বীকৃতি পেয়েছে। কাশ্মীরের মসজিদগুলো সেই প্রাচীনকালের ‘কাশ্মীর-ঐতিহ্য’ বহন করে।
কাশ্মীরের অনিন্দ্য সুন্দর ও প্রকৃতির কোলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি মসজিদ নিয়ে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য আমাদের বিশেষ পরিবেশনা—
হজরতবাল মসজিদ
দাল হ্রদের স্বচ্ছ জলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হজরতবাল মসজিদ। এটি কাশ্মীরি মুসলিমদের আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ভারতের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের শ্রীনগরে এটির অবস্থান। কাশ্মীরিদের ধারণা ও দাবী মতে, এখানে প্রিয়নবী (সা.) এর চুল মোবারক সংরক্ষিত রয়েছে।
হজরতবাল মসজিদের নান্দনিক দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
মসজিদটি সাদা মার্বেল দিয়ে খোদাইকৃত। ‘একপাশে বয়ে গেছে কলকল সুরের হ্রদ; অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেত-শুভ্র আরকের হজরতবাল মসজিদ’—দৃশ্যটি ভীষণ মনোমুগ্ধকর ও সুখানন্দের।হজরতবাল মসজিদের নান্দনিক দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
এটি আসার-ই-শরিফ, দরগাহ শরিফ ও মদীনাতুস-সানি নামেও পরিচিত। এই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে উর্দু শব্দ ‘হজরত’ (অর্থ শ্রদ্ধেয়) ও ‘বাল’ (অর্থ চুল) এর যৌগিক সম্মিলনে।১৯৯৩ সালে হজরতবাল মসজিদে কিছু জঙ্গি আশ্রয় নেয়। তখন ভারতের নিরাপত্তারক্ষা বাহিনী তাদের পাকড়াও করতে মসজিদে হামলা চালায়। কিন্তু এতে মসজিদ বেশ ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়।
হজরতবাল মসজিদের নান্দনিক দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
জামে মসজিদশ্রীনগরের নওহট্টায় এটি অবস্থিত। জামে মসজিদ কাশ্মীর উপত্যকার বৃহত্তম মসজিদ। ১৪০২ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। জামে মসজিদটি ইন্দো-সারেসনিক স্থাপত্যশৈলীর প্রতিচ্ছবি হিসেবে পরিচিত। মসজিদটিতে ৩৭০টি কাঠের স্তম্ভ রয়েছে। এছাড়াও সম্মুখে একটি চমৎকার ও পরিচ্ছন্ন উঠান রয়েছে। স্থাপত্যশৈলী ‘জামে মসজিদ’কে অনন্য ও মনোরম কীর্তিতে পরিণত করেছে। এছাড়াও এটি শ্রীনগরের অন্যতম প্রধান পর্যটন স্থান। জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটনশিল্পের মুকুটে সমুজ্জ্বল পালক এটি।
জামে মসজিদ, শ্রীনগর, কাশ্মীর। ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরি ও পর্যটকদের কাছে জামে মসজিদ প্রতিটি ক্ষেত্রেই অতুলনীয় ও অনন্য। প্রতি শুক্রবার মসজিদ ছাপিয়ে আশপাশের প্রাঙ্গন ও রাস্তাঘাট মুসল্লিতে ভরে যায়।জামে মসজিদ
হামদান মসজিদমসজিদটি আমির-ই-কবির নামেও বিখ্যাত। এটি কাশ্মীরের অন্যতম আকর্ষণীয় মসজিদ। ভারতের রাজকীয় সুলতান কুতুব উদ্দিন ১৮৩৫ সালে এই মসজিদের সংস্কারকাজ পরিচালনা করেন। এর আগে ১৭৩১ ও ১৭৭৫ সালে দুইবার আগুন লেগে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭৩১ সালে আগুনে পুরোপুরি পুড়ে যাওয়ার পর আবদুল ভারত খান কাঠ দিয়ে মসজিদটি সম্পূর্ণরূপে সংস্কার ও কারুকাজ করেন।
নান্দনিক স্থাপত্যের হামদান মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত
হামাদানি মসজিদটির নাম একজন পুণ্যাত্মা ধর্মীয় নেতার নামে নামকরণ করা হয়েছে, তার দাওয়াতে এতদাঞ্চলের অনেক লোক দলে দলে শান্তির ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হন।আলী মসজিদ
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের রাজধানী শ্রীনগরে আলী মসজিদ অবস্থিত। শ্রীনগরের দ্বিতীয় বৃহৎ মসজিদও এটি। সুলতান হাসান শাহের আমলে ১৪৭১ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। কাশ্মীরে কাঠের তৈরি অন্যতম সুন্দর ও নজরকাড়া নকশাঙ্কৃত মসজিদ এটি।
আলী মসজিদের দৃশ্য।
আখুন্দ মোল্লা বা আখুন মোল্লা মসজিদমুঘল রাজপুত্র দারা শিকোহ ছোট এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। দারা শিকোহ তার গৃহশিক্ষক আখুন মোল্লা শাহকে সম্মান জানাতে এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। চকচকে ধূসর চুনাপাথরের মসজিদটিতে একটি পাথরের পদ্ম রয়েছে, তাতে খোদাই করে লেখা রয়েছে ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দ।
আখন্দ মোল্লা বা আখুন মোল্লা মসজিদ
মসজিদের অভ্যন্তরের দহলিজে মসজিদের মতো করে আলাদা একটি বিশেষ নামাজঘর রয়েছে। মূল ভবন থেকে একটি উঠোনের মাধ্যমে এটির বিভক্তকরণ করা হয়েছে।আখন্দ মোল্লা বা আখুন মোল্লা মসজিদ
পাথর মসজিদমুঘল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ১৬২৩ সালে পাথর মসজিদ নির্মাণ করেন। ঝিলাম নদীর ওপারে অবস্থিত এটি কাশ্মীরের বৃহত্তম বেঁচে থাকা মুঘল কাঠামো। মসজিদটির মাঝখানে দীর্ঘাকায় খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বারে অনুভূমিকভাবে নয়টি খিলান-গম্বুজ নির্মিত রয়েছে। ইতিহাসবিদ ও অসুসন্ধিৎসুরা এখনও স্মৃতিসৌধরূপী মসজিদটি দেখতে যান।
পাথর মসজিদ।
নকশাবন্দ মসজিদএ মসজিদ খাজা মইনুদ্দিন নকশবন্দির খানকাহ। এটিও শ্রীনগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সার্বিক নির্দেশনায় এটি নির্মাণ করা হয়। এ মসজিদের ছাদে সূক্ষ্ম-জটিলভাবে ‘খতমবন্দ’ খোদাই করা হয়েছে। উপরন্তু এটি এমন এক শিল্প, যেখানে জ্যামিতিক নকশাগুলো তৈরিতে পেরেকের ব্যবহার ছাড়াই কাঠের ছোট ছোট টুকরা হাতের সাহায্যে একসঙ্গে লাগানো হয়েছে।
নকশবন্দ মসজিদ।
ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.comবাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৯
এমএমইউ