ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

রস চোর | বিএম বরকতউল্লাহ্

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২১
রস চোর | বিএম বরকতউল্লাহ্

‘এই, যাবি?’
‘কই?’
‘কংকরিদের বাড়ি। ’
‘এত রাতে, এই কনকনে শীতে?’
‘রস খাবো।

কংকরিদের ঘরের কোণে খেজুরগাছে ঘটি বাঁধা! এতক্ষণে ভরে গেছে। ঘটিসহ সাবাড় করে দেবো, চল্। ’
‘কংকরিটা যা ত্যান্দোড়রে বাবা! এই ডাকাত মেয়ে যদি টের পায়, তখন?
‘তখন? এই যে কালো চাদরটা দেখছিস, এটা গায়ে প্যাঁচিয়ে ভয়ংকর ভূত হবো। তারপর এমন ভয় দেখাবো না, কংকরি আর দিশা-মিশা পাবে না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধুপ করে পড়ে যাবে মাটিতে। তখন তার মুখে চিল্লাচিল্লি করার জোর থাকবে না, মুখ দিয়ে খালি লাল-নীল ফেনা বেরোবে; আর এই ফাঁকে তুই ঘটি নিয়ে সোজা চলে আসবি বাংলা ঘরে। চল্। ’

চলে গেলাম গাছতলায়। রন্টি তার গায়ের চাদর, মাফলার, স্যুয়েটার খুলে আমার হাতে দিলো। গায়ে তার স্যান্ডো গেঞ্জিটা শুধু। আমি তার কাপড়গুলো গলায় প্যাঁচিয়ে দাঁড়ালাম। সে কাঁপাস্বরে বলল, ‘খোকা, বুকটা কেমন ডিবডিব করছে, দেখ। ’
‘ধ্যুৎ। ভীরুদের মতো কথা বলিস না তো! আমি আছি না, ভয় কীসের?’ তাকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, যা ওঠ্।

রন্টি কষে নেংটি দিলো। সে হাতের তালুতে থুতু ঘষে গাছে উঠছে। আমি কালো চাদর আর মাফলার পেঁচিয়ে ভয়ংকর ভূত হয়ে খেজুরগাছের আড়ালে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রন্টি রশি খুলে ঘটিটা হাতে নিয়েছে মাত্র। এখন নেমে আসবে।
এই মুহূর্তে ঘটাংঘট শব্দে দরজা খুলে গেলো। প্রচণ্ড গতিতে আমার বুক ধড়ফড় করছে। আর কানে করছে শোঁ শোঁ শব্দ। কংকরি বিড়ালের মতো হেঁটে গাছতলায় এসে ইতিউতি করছে।

আমি একটা লাফে ধুপ করে তার সামনে গিয়ে পড়লাম; সে খপ করে ধরে ফেললো আমাকে। বাঘের হাতে হরিণ পড়ার দশা। হাত ছোটাই তো কান প্যাঁচিয়ে ধরে, কান ছোটাই তো চাদর টেনে ধরে। সাংঘাতিক বিপদ! শেষে বাইন মাছের মতো মোচড়াতে মোচড়াতে দিলাম ভোঁ দৌড়। কিন্তু চাদরখানা রয়ে গেলো তার হাতে।

দুঃসাহসিনী কংকরি গাছের দিকে তাকিয়ে ‘রসচোর’ ‘রসচোর’ করে চিৎকার করতে লাগলো। মানুষজন এসে পড়লো বলে। রন্টি কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে অর্ধেক গাছ নেমে ঘটিসহ লাফিয়ে পড়লো নিচে। ডাকাত মেয়ে কংকরি ধরে ফেললো তাকে। গাছের তলে চোরে-ঘটিতে আর কংকরিতে বিরাট ধস্তাধস্তি। রন্টি গোঁ-গ্যাঁ করতে লাগলো। কংকরি ছাড়ে না রস চোরকে।

রন্টি কিছুতেই ছুটতে পারছে না। এখন পাড়ার লোকের কিল খাবে নাকি! সে টাকি মাছের মতো কংকরির হাত ফসকে বেরিয়ে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে পালালো। ধুপ করে বাংলা ঘরে ঢুকে হাঁটু ধরে সমানে হাঁপাতে লাগলো সে। তার গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জিটা ঝুলছে, নেংটি অর্ধেক খোলা, গায়ে রস-কাদা আর খামচির দাগ। কাঁপছে। আমি তার নেংটি খুলে দিতে গিয়ে বললাম, ‘চিনতে পারেনি তো আবার?’

‘সর, কোনো কথা বলবি না তুই, একদম চুপ। আমাকে বিপদের মুখে ফেলে দৌড়ে চলে এলি। জীবন নিয়ে টানাটানি। পায়ের জোরে বেঁচে এলাম। পানি দে, পানি খাবো। মুখে খালি ফটর ফটর। ’ শুকনো মুখে বারকয়েক ঢোক গিলে কথাগুলো বললো রন্টি।
আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলাম না।

দুই.
সকালে আমাদের ডাক পড়লো কংকরিদের বাড়ি। গেলাম। উঠোন ভর্তি মানুষ। রসচুরির নালিশ বসেছে। আমাদের দেখে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো। আমি আর রন্টি মাতবরের সামনে গিয়ে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ালাম। লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে গেলো।

ঘর থেকে বিছার মতো লাফিয়ে এলো কংকরি। সে চাদর আর গেঞ্জির টুকরো দেখিয়ে বললো, ‘দেখেন আপনারা, দেখেন, রস চুরির প্রমাণ দেখেন। এরা আজ করেছে রস চুরি কাল করবে ডাকাতি। ’
মাতবর আমাদের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘বাবারা, রস চুরি করতে গেলি কোন দুঃখে, চাইলে কি দিতো না?’

‘চাইলেও দেয় না, না চাইলেও দেয় না। এদের মতো কিপটা মানুষ এই পাড়ায় নেই। চুরি করবো না তো কি,’ তেজ দেখিয়ে বললো রন্টি।
তার কথা শুনে সবাই হোঃ হোঃ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো।
কংকরি রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। মাতবর বলল, ‘মা কংকরি তুই থাম। একটা কাজ কর। ঘর থেকে দুই গ্লাস খেজুরের রস নিয়ে আয় তো দেখি। ’

কংকরি রাগের চোটে থপ থপ পা ফেলে ঘরে গেলো এবং রস ভর্তি গ্লাস এনে মাতবরের হাতে দিলো। মাতবর দুই হাতে দু’টি গ্লাস নিয়ে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘নে, খা। ’

আমি মনে করেছি এটা বোধ হয় চুরির কোনো শাস্তি। ইতস্তত করে রসের গ্লাস হাতে নিলাম। রন্টির দিকে তাকাতেই সে আমাকে ধমক দিয়ে বললো, কী দেখস আবার তুই? এখন সমাদরের রস খা। এক টানে খেয়ে ফেল। আর না খেতে পারলে আমাকে দে। দেখ কেমনে খাই।
মাতবর বলল, না, না, যারটা সে খাবে। খাও।

রন্টি একটানে রসটুকু খেয়ে বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে আমার দিকে তাকালো। আমি তার দিকে একবার তাকিয়ে মুখটা তিতা খাওয়ার মতো করে রসটুকু খেয়ে ফেললাম।

মাতবর মাথা ঝাকিয়ে আফসোস করে বললেন, ‘আহারে আমরা এ বয়সে কত কি করেছি। কখনো নালিশ বসে নাই। পোলাপান মানুষ এরা, এই সামান্য রস খেতে গিয়ে মেলা নাজেহাল হয়েছে। মাফ করে দে মা কংকরি। এই তোরা আর চুরিমুরি করিস না বাপ, যাহ্। ’
হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

চলে আসার সময় কংকরি রাগের চোটে ‘রসচোর’ বলে গ্লাসের অবশিষ্ট রস ছুঁড়ে মারলো আমাদের গায়ে।
আমরা কখনো আর এই কাজ করিনি। কিন্তু কংকরির দেওয়া সেই ‘রসচোর’ নামটি আজও আঠার মতো লেগে আছে আমাদের গায়ে!

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০২১
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।