ঢাকা, সোমবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৭

আইন ও আদালত

ছাত্র-জনতার ওপর ৩ লাখ গুলি ছোড়ে পুলিশ, ঢাকায় ৯৫৩১৩ রাউন্ড

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৪৫, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
ছাত্র-জনতার ওপর ৩ লাখ গুলি ছোড়ে পুলিশ, ঢাকায় ৯৫৩১৩ রাউন্ড জুলাই আন্দোলনের ছবি

জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমনে সারা দেশে ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ মোট তিন লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল। এর মধ্যে ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ডই ছোড়া হয় ঢাকা মহানগরে।


 
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) জুলাই অভ্যুত্থানকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৫৪তম সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ তথ্যটি উপস্থাপন করেন।  

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের দেওয়া ২১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য তুলে ধরেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এ সময় আদালতে উপস্থিতি ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম, তানভীর হাসান জোহা ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান। আসামিপক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।

প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম জানান, আন্দোলন দমনের জন্য সারাদেশে ওই সরকার যে হিসাব করেছিল, তিন লাখ ৫ হাজারের বেশি রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল। তার মধ্যে ৯৫ হাজারের বেশি রাউন্ড গুলি হয় ঢাকা মহানগরে।  

জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর বলেন, ‘তদন্ত চলাকালে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি এক স্মারকের মাধ্যমে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জুলাই আন্দোলন দমনে ছাত্র-জনতার ওপর ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলি সংক্রান্ত ২১৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রাপ্ত হই। এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলবার ও পিস্তলসহ বিভিন্ন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে শুধু ঢাকায় ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে ব্যবহার করা হয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি। ’ 

র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টার ব্যবহার সংক্রান্ত প্রতিবেদনও সংগ্রহ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, জুলাই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হত্যা, জখম, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সংগ্রহ করে জব্দ করা হয়েছে।  

তিনি বলেন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে জখমী সাক্ষীদের চিকিৎসা সনদ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম থেকে ৮১ জন অজ্ঞাতনামা লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনও সংগ্রহ করা হয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তা জবানন্দিতে আরও বলেন, তদন্তকালে সংগৃহীত, জব্দকৃত আলামত পত্রপত্রিকায় ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিক, বই পুস্তক, বিশেষজ্ঞ রিপোর্ট, বিভিন্ন প্রতিবেদন, শহীদ পরিবারের সদস্য, জখমী, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানবন্দি, তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত পর্যালোচনা করি। পলাতক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইজি মামুন গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে ব্যাপক মাত্রায় আন্দোলন দমনে শান্তিপূর্ণ ছাত্রজনতার ওপরে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। প্ররোচনা, সম্পৃক্ততা, উসকানি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেড় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে জখম, অঙ্গহানি, বেআইনি আটক, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, অপহরণ, জীবিত ও মৃতকে একত্র করে পুড়িয়ে দেওয়া, চিকিৎসা, জানাজা, দাফন ও শেষকৃত্যে বাধা, মৃত্যুর কারণ পরিবর্তনে সংশ্লিষ্টদের বাধ্য করা হয়েছে।  

মো. আলমগীর বলেন, আসামিরা নিহতদের মৃতদেহ পরিবার কর্তৃক শনাক্তের সুযোগ না দিয়ে বেওয়ারিশ আখ্যা দিয়ে তড়িঘড়ি করে লাশ দাফনে বাধ্য করা, আন্দোলনকারী ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘঠন করেছেন।

এর আগে শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম জানান, শেখ হাসিনার মামলার সর্বশেষ ও ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে তদন্তকারী কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেবেন। তার জবানবন্দির অংশবিশেষ ও জব্দকৃত ভিডিও প্রদর্শনী সরাসরি সম্পচার করা হবে।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর ৫৩তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন এ মামলার বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা।

তিনি জানান, শেখ হাসিনার ফোনালাপের ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং ৩টি মোবাইল নম্বরের সিডিআর জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ফোনালাপ সেদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ৫৩তম সাক্ষী উপস্থাপনের সময় বাজিয়ে শোনানো হয়েছে। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার এই চারটির ফোনালাপের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও তার আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে একটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে দুটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এএসএম মাকসুদ কামালের সঙ্গে একটি ফোনালাপ রয়েছে।

এ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপ-পরিচালক মো. আলমগীর। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।

গত ১০ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসেবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।

ইএস/এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।