আইনের ভাষায় তালাক হচ্ছে ‘বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা` অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষেই বা যে কোনো এক পক্ষের সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে।
আইন অনুযায়ী স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ একে অপরকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্রই সম্ভব স্থানীয় ইউপি/পৌর/সিটি মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং তালাক গ্রহীতাকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে।
চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক বলবৎ হবে না।
কারণ নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার (পুনর্মিলনের) জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে।
পাঠক! এবার আসা যাক দাম্পত্য পূনরুদ্ধার মামলায় আইন কি বলে। কারও স্ত্রী যদি আইনগত কোন কারণ ছাড়াই তার স্বামীর সাথে একত্রে বসবাস না করে, সে ক্ষেত্রে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে।
কিন্তু এর দু’টি ব্যতিক্রম রয়েছে-
ক. বিবাহটি স্ত্রীর ইদ্দতকালে অনুষ্ঠিত হলে, দাম্পত্য মিলন ঘটে থাকলেও ¯¦ামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য কোন আদেশ বা ডিক্রি পাবে না ।
খ. স্ত্রীর নাবালকত্বকালে বিবাহটি সম্পন্ন হওয়ার পর যদি বৈধভাবে তার বিচ্ছেদ ঘটে থাকে তাহলে স্বামী তার বিরুদ্ধে কোন ডিক্রি পাবে না ।
দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলায় বাদীকে অবশ্যই প্রমান করতে হবে যে, সে নির্দোষ ও নিরীহ মনোভাব নিয়েই আদালতের কাছে বিচার প্রার্থী হয়েছে। স্ত্রী যদি প্রমাণ করতে পারে যে, স্বামী তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, তবে স্বামী ডিক্রি পাবে না। নিষ্ঠুরতার আকার প্রকৃতি এমন হতে হবে যে, ওই অবস্থায় স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর ঘরে যাওয়া নিরাপদ নয় , তখন সেটা হবে একটি উত্তম বৈধ প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি ।
আশু দেনমোহর যতক্ষণ পর্যন্ত পরিশোধ করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করতে ও তাকে দাম্পত্য মিলনের সুযোগ দিতে অস্বীকার করতে পারে।
দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে স্বামী তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে সেই ক্ষেত্রে দেনমোহর অপরিশোধিত রয়েছে বললে আনীত মামলায় এটি একটি উত্তম প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি হবে এবং আনীত মামলাটি নাকচ করা হবে।
কিন্তুু স্ত্রীর অবাধ সম্মতিক্রমে দাম্পত্য মিলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর মামলাটি দায়ের করা হলে ‘আশু দেনমোহর’ প্রদানমূলক শর্তমূলক দাম্পত্য অধিকারের পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত ডিক্রি দেওয়া যাবে। তবে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বৈধ বিবাহের অস্বিত্ব থাকতে হবে।
বিবাহের পূর্বে সম্পাদিত কোন চুক্তিতে যদি বলা হয় যে, বিবাহের পর স্ত্রী তার পিতা-মাতার সাথে বসবাস করতে পারবে, তাহলে এটি অবৈধ হবে এবং এই জাতীয় কোন চুক্তি দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য আনীত মামলায় কোন জবাব হিসেবে গ্রহনযোগ্য হবে না। অনুরূপভাবে যেখানে বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে যদি উল্লেখ করা হয় যে, এখন তারা একত্রে বসবাস করবে এবং যদি স্বামীর প্রস্তাবে একমত হতে না পারে তাহলে সেখানে চুক্তিটি স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করতে পারবে, সেখানে চুক্তিটি অবৈধ হবে এবং স্বামী কর্তৃক আনীত দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলায় এটা উত্তম যুক্তি বলে গন্য হবে না। তবে দ্বিতীয় স্ত্রীকে বাড়িতে বসবাস করার অনুমতি দান করে তাকে ভরণপোষণ প্রদানে সম্মত হয়ে তার সাথে সম্পাদিত চুক্তি আইন দ্বারা কার্যকর হবে।
১৯৩৯ সালের মুুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে অত্যন্ত— সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কি কি কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে।
কারণগুলো হলো
১. চার বৎসর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
২. দুই বৎসর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে।
৩. স্বামীর সাত বৎসর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারাদন্ড হলে।
৪. স্বামী কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিত তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
৫. বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে।
৬. স্বামী দুই বৎসর ধরে পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে।
৭. বিবাহ অস্বীকার করলে। কোন মেয়ের বাবা বা অভিভাবক যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তাহলে মেয়েটি ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে, তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সর্ম্পক (সহবাস) স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনি কোন বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে।
৮. স্বামী ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লংঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
৯. স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে।
উপরে যে কোন এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে। অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর।
প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারে, আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রি দেবার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবে।
১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশকে তালাক সংক্রান্ত নোটিশ হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নিবে এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবে সে দিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, এম.ফিল গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৪