ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

সাক্ষীর নিরাপত্তায় আইন

মানবাধিকার ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৪
সাক্ষীর নিরাপত্তায় আইন ছবি: প্রতীকী

আদালতে বিচার চাইতে গেলে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে হয়। আধুনিক বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই মামলা নিষ্পত্তি করা হয়।

মামলায় দু’পক্ষই নিজেদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে ও আদালত তার ভিত্তিতেই মামলার রায় প্রদান করেন।    

কাজেই, সাক্ষ্য-প্রমাণই ন্যায়বিচারের ভিত্তি রচনা করে। যেকোনো মামলার রায় কারো পক্ষে যায় আবার কারো বিপক্ষে যায়। কিন্তু আদালতের কাছে মূল বিষয় হলো বিষয়বস্তু বিবেচনা করে মামলার রায় দেয়া।

আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হলে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র নাগরিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।

সাক্ষীরা যদি নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে না পারে অথবা সাক্ষী দেওয়ার পরে যদি তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন সেটি বিচারের জন্য হুমকিস্বরুপ। রাষ্ট্রকে তাই সাক্ষী ও তদন্তকারীদের নিরাপত্তা দিতে হয়। এটি না হলে তা জননিরাপত্তা ও বিচারের জন্য নেতিবাচক। সাক্ষীরা নিরাপদ বোধ না করলে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। আর অংশ নিলেও তারা নিরপেক্ষতার সাথে তার দায়িত্ব পালন ব্যর্থ হবে। তদন্তকারীও তদন্ত বা অনুসন্ধান করতে আগ্রহ প্রকাশ করবে না না। তাই রাষ্ট্রকে সাক্ষী, তদন্তকারী বা বিচারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়। আর স্বাভাবিকভাবেও সব নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রেরই দায়্ত্বি।   

ফৌজদারী ও দেওয়ানি- দুধরনের বিচার ব্যবস্থাই সাক্ষী নির্ভর। যদি সাক্ষীরা সে কাজটি সঠিকভাবে করতে না পারে তবে বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপও হতে পারে। সাক্ষীরা ন্যায়বিচারের জন্য নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে (hostile witness)। ফলে পুরো বিচার প্রক্রিয়াই বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

বিশেষ করে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় সাক্ষীদের সহায়তা ও নিরাপত্তা প্রদান অত্যন্ত জরুরি । একই কথা সংক্ষুব্ধ ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

সাক্ষীদের নিরাপত্তা বা সহায়তা প্রদানের জন্য তেমন কোনো আইন নেই। কেবল সাক্ষ্য আইনের ১৫১ ও ১৫২ ধারায় কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যা সাক্ষীদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দিতে সক্ষম না। এছাড়া সংক্ষুব্ধ ও সাক্ষীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তেমন কোনো কথা বলা নেই। যদিও অনেক দেশের আইনেই নিরাপত্তার বিষয়টি রয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সাক্ষী দিতে এসে বিরোধী পক্ষের চক্ষুশুল হয় অনেকে। আরা নানা রকম নির্যাতন ও ভয়ভীতিতো আছেই। সাক্ষী গুম হয়ে যাওয়ার নজিরও কম নয়।
 
সংবিধানেও এ বিষয়ে কোনো বিধান নই। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে দোষী ব্যক্তিদের বিচারকালীন নিরাপত্তা বা রক্ষাকবচের কথা বলা আছে। এখানেও সংকুব্ধ বা সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে, সাধারণভাবে সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেটি ভিন্ন আলোচনা। সংবিধানে সে নিশ্চয়তা দেয়া আছে। কিন্তু সাক্ষীদের বিষয়টি নেই। সংবিধানে থাকা জরুরিও নয়। সবকিছু সংবিধানে থাকবে এমন নয়। কিন্তু বিশেষ আইনে এ বিষয়টি থাকা বাঞ্ছনীয়।   

২০১১ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রস্তাব আনা হয়েছিল। আইন কমিশন এ প্রস্তাব এনেছে। প্রস্তাবটি বিভিন্ন দেশের ও আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে তৈরি করা হয়। জাতিসংঘের ১৯৮৫ সালের সনদটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন UN declaration of basic principles of justice for victims of crime and abuse of power)

২০০৬ সালেও এরকম একটি প্রতিবেদন বা প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে কমিশন থেকে। ২০১১ সালের বিধানটি ২০০৬ সালের বিধানেরই অধিকতর সংশোধনী।

যদিও এ প্রস্তাবেরও কয়েকটি সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন, ‘সংক্ষুব্ধ’ বা ‘সাক্ষী’ বলতে অনেককেই বাদ দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবটিতে বিশেষজ্ঞ, বিচারক, প্রসিকিউটর, পুলিশ, সাংবাদিক ও আরো কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ পেশাজীবীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এদেরকে অর্ন্তভূক্ত করা প্রয়োজন। কারণ, কোনো কোনো বিচারের ক্ষেত্রে এদের বিশেষ ভূমিকা থাকে। যেমন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর, সাক্ষী গবেষক, ইতিহাসবিদ-এসব দায়িত্ব যারা পালন করেছেন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টির রকমফের আছে। তাদের জন্য স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এর জন্য জাতীয় ও জেলাভিত্তিক কমিটি বা অন্যান্য আঞ্চলিক কমিটি গঠনেরও ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সাক্ষীদের অবস্থানকে নিরাপদ করতে হবে।   

এছাড়া নিরাপত্তা গ্রহণকারীদের আবেদন করারও ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাচাই-বাছাই করেই সবাইকে নিরাপত্তা দিতে হবে। কারণ, একেকটি ঘটনার প্রেক্ষাপট একেক রকম। প্রয়োজন অনুযায়ীই সবাইকে নিরাপত্তা দিতে হবে।   সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা অপরাধের ক্ষেত্রেই সুবিধা প্রদান করতে হবে। তা না হলে, আইনের অপপ্রয়োগ হবে। যার প্রয়োজন নেই, তিনিও যাতে এ সুবিধার আওতায় না আসতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।  

ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, পরিচয়ের নিরাপত্তা, আর্থিক, চিকিৎসা, সামাজিক, মনোস্তাত্ত্বিক, যোগাযোগ, জনসম্মুখে না যাওয়ার, ও সাধারণ ও আইনগত অন্যান্য সুবিধা বা নিরাপত্তা এ আইনের আওতায় আসতে হবে।

গত বছরের জুলাই মাসে ভারত কিরপালসিং জঙ্গবাহাদুরসিংস বনাম গুজরাট রাজ্য মামলার রায়ে আদালত স্বপ্রনোদিত হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সাক্ষীদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে আদেশ দেয়। ন্যায়বিচারের স্বার্থেই সাক্ষী ও মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিতে আইন প্রণয়ন ও আইনের প্রয়োগ জরুরি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।