আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধ দমনে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার প্রয়োগ হয়ে থাকে। তবে, সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে এর প্রয়োজনীয়তা থাকলেও অনেক সময় এর অপপ্রয়োগও হয়ে থাকে।
পুলিশের সন্দেহজক গ্রেফতারের ব্যাপারে আমদের দেশে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পুলিশ অফিসার ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা ওয়ারেন্ট ছাড়াই কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। অর্থাৎ পুলিশ কিংবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহ হলেই যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখতে পারে। যার ফলে এই ধারার অপপ্রয়োগও আমরা দেখতে পাই।
সাধারণ নাগরিক এই ক্ষেত্রে পুলিশের সন্দেহের কাছে অসহায়। এই ধারার অপব্যবহারের ফলে অনেক সময় পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যেরও কথা শোনা যায়।
উল্লেখ্য বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেটের ওয়ারেন্ট ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার কোনো বিধান নেই। তাছাড়া ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার ক্রিমিনাল জুরিস্প্রুড্যান্সও সমর্থন করে না। ৫৪ ধারায় আটক ব্যক্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে।
এই ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার হলে অনেক ক্ষেত্রেই জনগনের জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে যা আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। আর ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ ছাড়াই প্রায় সময় চালান করে দেওয়া যা মানবাধিকার পরিপন্থী।
এই ধারা বাতিলের দাবিতে অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, আইনজীবী সমাজ, সামাজিক সংগঠন, গণমাধ্যম, শিক্ষক ও সচেতন নাগরিকরা জোর দাবী জানিয়ে আসলেও এই ধারা বাতিল কিংবা সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারার অধীনে পুলিশের আটক সংক্রান্ত ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ BALST Vs. BANGLADESH (55 DLR 363) মামলায় সরকারকে ৮ টি নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সুপারিশ করে। এই সুপারিশগুলো হলঃ
কোনো ব্যক্তিকে আটক করার জন্য পুলিশ অফিসার ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে তবে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ৩ ধারা অনুযায়ী গ্রেফতার করতে পারবে না।
গ্রেফতারের সময় পুলিশ অফিসার পরিচয় প্রদান করবে এবং যদি প্রয়োজন হয় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি ও সেখানে উপস্থিত সবাইকে তার পরিচয়পত্র (ID Card) প্রদর্শন করবে।
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানায় আনার সাথে সাথে পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেফতার করার কারণ নথিভুক্ত করবে এবং আনুষঙ্গিক তথ্য যেমনঃ আমলযোগ্য অপরাধে ঐ ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে তার নিজের জ্ঞান, অপরাধের প্রকৃতি, যে পরিস্থিতিতে তাকে গ্রেফতার করা হলো, তথ্যের উৎস, ঐ তথ্য বিশ্বাস করার কারণ, গ্রেফতারের জায়গার বর্ণনা, গ্রেফতারের তারিখ ও সময় সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ, উক্ত ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা এবং এই উদ্দেশ্যের জন্য থানায় রক্ষিত সাধারণ ডায়েরীতে তা উপস্থাপন করতে হবে।
গ্রেফতারের সময় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নিকট কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলে পুলিশ অফিসার তা রেকর্ড করে রাখবেন এবং ঐ ব্যক্তিকে নিকটস্থ হাসপাতালে বা সরকারি ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবেন এবং ঐ আঘাতের জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করবেন।
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে থানায় চালানের তিন ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে গ্রফতারের কারণ জানাতে হবে।
যদি কোনো ব্যক্তিকে তার বাড়ি বা অফিস থেকে গ্রেফতার করা না হয়, তবে তাকে গ্রেফতারের ১ ঘণ্টার মধ্যে তার নিকট কোনো আত্মীয়কে টেলিফোন বা বার্তাবাহকের মাধ্যমে জানাতে হবে।
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে তার পছন্দের আইনজীবী বা তার ইচ্ছানুযায়ী কোনো আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে দিতে হবে এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করাতে হবে এবং তখন পুলিশ অফিসারকে নির্দিষ্ট আবেদন পত্রে উল্লেখ করতে হবে যে, কেন তদন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়নি, কেন তিনি মনে করেন যে তার অভিযোগের বা তথ্যের সুস্পষ্ট ভিত্তিমূল রয়েছে।
এই মামলার প্রাসঙ্গিক তথ্যের অন্তর্ভুক্তির কপি মামালার ডায়েরীর BP from No. 38 একই ম্যাজিস্ট্রেটকে কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
কিন্তু হাইকোর্টের দেওয়া এইসকল নির্দেশনা যদি পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঠিকভাবে মেনে চলত তাহলে সাধারণ নাগরিকদেরকে এতো দুর্ভোগ পোহাতে হত না। মানুষেরও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর অনেক বেড়ে যেতো।
পুলিশ জনগণের বন্ধু। এব্যাপারে পুলিশের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সচেতনতাও জরুরি। আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে সচেতন পুলিশ বাহিনী জনগণের সেবায় নিয়োজিত হতে পারে। আর এ ব্যাপারে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, রোলা বাংলাদেশ (রিসার্চ অর্গানাইজেশন ফর লিগ্যাল অ্যাওয়ারনেস অব বাংলাদেশ); এলএলএম (অধ্যয়নরত) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৬ ঘন্টা, নভেম্বর ০৬, ২০১৪