১৯৩টি দেশের সরকার প্রধানরা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস (এসডিজি) অনুমোদন করেন। একদল বিশেষজ্ঞ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) প্রণয়ন করলেও এসডিজি ব্যাপক আলোচনার ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে।
এটি জাতিসংঘের ইতিহাসের সর্বাধিক অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগ, যাতে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য নাগরিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং সদস্য রাষ্ট্রসমূহ অংশ নিয়েছেন। এসডিজি তাই জনগণের মালিকানায় প্রণীত এজেন্ডা। বস্তুত এটিকে বলা হয় ‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য ও জনগণের এজেন্ডা’ এবং এর বাস্তবায়নও নির্ভর করবে মূলত জনগণের উদ্যোগের ওপর।
এসডিজি, এমডিজির অভিজ্ঞতার আলোকে প্রণীত হলেও এটির পরিধি এমডিজি থেকে অনেক বিস্তৃত। এমডিজির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা এর লক্ষ্য। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টিসহ উন্নয়নের গতানুগতিক কর্মসূচির বাইরে এতে আরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন লক্ষ্য। এসডিজির লক্ষ্য ও টার্গেটগুলোর গভীর আন্তঃসংযোগ ও পারস্পরিক যোগসূত্র নতুন এজেন্ডায় সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত।
এসডিজির সাথে এমডিজির পার্থক্য
এমডিজিতে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ক্ষুধা-দারিদ্র্য অর্ধেক দূর করার প্রতিশ্রতি ছিল কিন্তু এসডিজির লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসইভাবে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা-দারিদ্য্যের অবসান। এসডিজি হলো সর্বজনীন, উন্নত-অনুন্নত সব দেশে, সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সমাজের পিছিয়ে পড়াদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এমডিজিতে সংখ্যার ওপর, যেমন শিক্ষাক্ষেত্রে ভর্তির হারের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, যার ফলে অনেক দেশে শিক্ষার মানে চরম অবনতি ঘটেছে। পক্ষান্তরে, এসডিজিতে প্রথমবারের মতো শিক্ষার মান, তথা জ্ঞানার্জন ও শিক্ষার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ ও মানবিক বিশ্ব তৈরির কথা বলা হয়েছে।
এসডিজির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হলো, এতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ গড়ার ওপর। এখানে মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংরক্ষণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কথা বলা হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কার্যকর আইনের শাসন ও সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং স্বচ্ছ, কার্যকর ও দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান গড়ার ওপর।
এসডিজিতে উন্নত মানের, সহজলভ্য, সময়োপযোগী, বিশ্বাসযোগ্য ও বিস্তারিত উপাত্ত ব্যবহার করা হবে। এসব পর্যালোচনার লক্ষ্য হবে নাগরিকদের প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।
এমডিজি বাস্তবায়ন বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল বৈদেশিক সাহায্যের ওপর, যা বাস্তবে ঘটেনি। কিন্তু এসডিজি বাস্তবায়ন মূলত নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্তিকরণ ও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহকরণের ওপর। যেহেতু এসডিজি একটি আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার এবং সম্মিলিত উদ্যোগ তাই এর বাস্তবায়নের জন্য সম্পদ সংগ্রহ, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সম্পদ সংগ্রহের কাজ সরকার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, জাতিসংঘের সংস্থাসমূহ ও অন্যান্য পক্ষ মিলে করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এসডিজিতে।
এমডিজির মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের প্রাথমিক ধাপ অর্জিত হয়েছে
২০১৫ সালে শেষ হওয়া জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে (২০১৫) বলা হয়েছে যে, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। নির্ধারিত সময়ের তিন বছর আগেই এ লক্ষ্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
২৯ শতাংশের বিপরীতে এমডিজির মেয়াদের শেষ বছর ২০১৫ সালে এসে দেশের দারিদ্র্য হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৮ শতাংশে। তবে বাস্তবতা হলো যে, এখনো ৩ কোটি ৯২ লাখ মানুষ উচ্চ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। আর এদের মধ্যে নিম্ন দারিদ্র্যরেখার নীচে বসবাস করে ২ কোটি ৪ লাখ মানুষ।
দারিদ্র্য বিমোচনে এখনো বাংলাদেশের সামনে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো হলো প্রত্যন্ত ও চরাঞ্চলে বিদ্যমান দারিদ্র্যের পকেট; আয় বৈষম্য এবং নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তুলনামূলক কম অংশগ্রহণ।
পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কর্মসংস্থান, পুষ্টি এবং পরিবেশ এর উন্নতিতেও আমাদের উদ্যোগী হতে হবে।
জেন্ডার সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে এমডিজিতে প্রধান বিষয় হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিল। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য দূর করতে সক্ষম হয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রী ভর্তি হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশ যতটা এগিয়েছে, সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ততটা অগ্রসর হতে পারেনি। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এবং সামাজিক সচেতনতার অভাবে নারীরা নানাভাবে বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ইউনিসেফ-এর (২০১৪) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিবাহ ও কিশোরী নির্যাতনের দিক থেকে শীর্ষে বাংলাদেশ। দেশে এখনও ৬৬ শতাংশ বিয়েতেই কনের বয়স থাকে ১৮ বছরের নিচে। এছাড়াও বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নারী ও কন্যাশিশু ক্ষুধা, অপুষ্টি ও পাচারের শিকার। তারা মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত, নিজ ঘরের বাইরে যেয়ে কাজ করার স্বাধীনতা কম থাকায় অর্জিত হয়নি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। সমাজের বিভিন্ন স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং মৌলিক সেবা গ্রহণে নারীদের অভিগম্যতা ও সম-অংশগ্রহণের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম-এর (ডব্লিউইএফ) এর তথ্যমতে, ২০১৪ সালে ডব্লিউইএফর লিঙ্গ বৈষম্য সূচকের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৮তম। নারীর ‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে’ বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭তম। তাই উপরোক্ত সবগুলো ক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা জাতি হিসেবে আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার।
এসডিজি অর্জন: প্রয়োজন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন
এসডিজির লক্ষ্য ৫ এ নারীদের সম-অধিকার এবং তাদের ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারীদের জন্য যে নতুন উন্নয়নের মডেলের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে, সেখানে মূলত মোটা দাগে চারটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।
প্রথমত: ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নারীর মালিকানা স্থাপন। ভূমির ওপর নারীদের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে পরিবার ও জনগোষ্ঠীর খাদ্য সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থার নিশ্চয়তা তৈরি হয়। ভূমি কেবল আয়ের উৎস নয়, এটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারের সাথেও সম্পৃক্ত।
দ্বিতীয়ত: মানসম্মত কাজের পরিবেশ এবং মজুরি। গার্মেন্টস, কৃষি, ঘর-গৃহস্থালিসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্মরত নারী শ্রমিকদের উপযুক্ত কাজের পরিবেশ এবং ন্যায্য মজুরির ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এমন একটি উন্নয়ন কৌশল দরকার যেখানে শ্রমিক, তার পরিবার ও ওই জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি মানসম্মত মজুরি নির্ধারনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে একজন শ্রমিক সম্মানের সাথে তার জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।
তৃতীয়ত: শান্তি ও ন্যায় বিচার বা ন্যায্যতা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া, সুশাসনের শূণ্যতা নারী অধিকার নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারীর প্রতি সহিংসতাকে সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লংঘন যা অন্যান্য উন্নয়ন অধিকারের অন্তরায় হিসেবে মনে করা হয়। সহিংসতার ফলে নারী এবং শিশু গৃহহীন, স্বাস্থ্যগত সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতাসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
চতুর্থত: সকল স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এটা শুরু করতে হবে ঘর থেকে এবং সরকারি উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। তৃণমূল পর্যায় এবং জাতীয় পর্যায়ে নারীদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ হলো নারী অধিকার, জেন্ডার সমতা, টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত।
এসডিজির লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব প্রয়োজন। পদ্ধতিগতভাবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ এসডিজি অর্জনেও সফল হবে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই আমাদের জাতীয় সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব অপ্রতুল ও অনেকটা গুরুত্বহীন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১০ বছরের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষণের বিধান করা হয়। ১৯৭৮ সালে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৩০ এ উন্নীত এবং এর মেয়াদ ১৫ বছর করা হয়। ২০০৪ সালে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ এবং এর সময়সীমা ১০ বছর নির্ধারণ করা হয়। পরে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা উন্নীত করা হয় ৫০ এ। আমাদের জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির এ প্রক্রিয়াকে ‘কোটা পদ্ধতি বলে।
কোটা তিন ধরনের হতে পারে: নির্বাচনবিহীন কোটা, নির্বাচনভিত্তিক কোটা ও ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি।
তবে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিও একটি নির্বাচনভিত্তিক পদ্ধতি। এসব পদ্ধতির সংমিশ্রনেও কোটা প্রথা প্রচলন করা যেতে পারে। আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচনবিহীন কোটা পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনগুলো পূরণ হয় দলীয় ‘মনোনয়ন’ এর মাধ্যমে। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনগুলো পূরণ করা হয় সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় তিনটি সাধারণ আসন নিয়ে একটি সংরক্ষিত নারী আসন গঠন করা হয়।
আমাদের দেশে নির্বাচনবিহীন কোটা পদ্ধতির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
প্রথমত, এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় না, সংরক্ষিত নারী আসনগুলো পূরণ করা হয় মনোনয়নের মাধ্যমে।
দ্বিতীয়ত: নির্বাচন হয় না বলে এ ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কোনো নির্বাচনী এলাকা নির্ধারিত থাকে না। ফলে যোগ্য নারীদের জন্য তাদের যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে সরাসরি নির্বাচনে, মূলত পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয় না।
তৃতীয়ত: নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে না বলে, এসব আসন পূরণে প্রার্থীদের যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং এ ক্ষেত্রে দলীয় উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিগণ সংরক্ষিত নারী আসনগুলোকে ফায়দা প্রদানের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেন। যোগ্যতার পরিবর্তে কানেকশনই এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব আসন হয়ে পড়ে অলঙ্কারিক।
চতুর্থত: নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থাকে না বলে সংরক্ষিত আসন অলঙ্কৃত করা প্রতিনিধিদের জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। বস্তুত, এসব নারী মূলত ‘দায়বদ্ধ’ থাকেন দলীয় কর্তাব্যক্তিদের কাছে।
পঞ্চমত: সাধারণ আসনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তুলনায় সংরক্ষিত আসনে মনোনীত নারীদের ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব বহুলাংশে ভিন্ন। তাই এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি নয়। সংরক্ষিত আসনে মনোনীত নারীরা ক্ষমতা কাঠামোর বাইরেই থেকে যান।
ষষ্ঠত: এটি নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য স্বয়ংক্রিয় ও কার্যকর পদ্ধতি নয়। কারণ, সংরক্ষণ পদ্ধতি বিলুপ্ত হলে সংরক্ষিত আসনে মনোনীত প্রতিনিধিদের সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
এ অবস্থায় বাংলাদেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোটা ব্যবস্থার মধ্যে উৎকৃষ্টতম পদ্ধতি হতে পারে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব আসন থেকে পর্যায়ক্রমে একজন নারী সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ পান।
যদি আমাদের জাতীয় সংসদের এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে এবং এগুলো ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে পূরণের সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে প্রথম টার্মে লটারি কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ১০০ আসন চিহ্নিত করে এগুলো নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। এভাবে নির্ধারিত ১০০টি আসনে শুধু নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অন্য ২০০ আসন নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যই উন্মুক্ত থাকবে।
পরবর্তী নির্বাচনে আগেরবারের ২০০টি উন্মুক্ত আসনের মধ্য থেকে লটারি কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হবে। অন্য ২০০ আসন, যার মধ্যে প্রথমবারের ১০০ সংরক্ষিত আসন অন্তর্ভুক্ত, নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
তৃতীয় টার্মে অবশিষ্ট এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত হবে এবং অন্য ২০০ আসন উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
আশার দিক হলো, ২০০৭-এ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গঠিত সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি কিছু সুপারিশ করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সদস্যদের মধ্যে ৪০ শতাংশ আসন নারীদের জন্য তিন টার্মে ঘূর্ণায়মান ভিত্তিতে নির্বাচনের আয়োজন করা। আগামী তিনটি নির্বাচনের পর নির্ধারিত আসন প্রথা বিলুপ্ত করার সুপারিশও করে ওই কমিটি।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য এটি একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতিতে এ পদ্ধতিতে যোগ্য ও কর্মদক্ষ নারীরা তাদের নির্বাচনী এলাকাকে গড়ে তোলার সুযোগ পান, যা পরবর্তী নির্বাচনে পুরুষদের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়ে আসার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
ফলে এ পদ্ধতিতে সংরক্ষিত আসনের বাইরে থেকেও অর্থাৎ উন্মুক্ত আসন থেকেও নারীদের নির্বাচিত হয়ে আসার সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়। তাই কোটার মাধ্যমে নির্ধারিত আসনের থেকে বেশি আসনে নারীরা নির্বাচিত হয়ে আসেন। সুতরাং, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে একসময় নারীর সমপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য কোটার প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যায়।
ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি যে নির্বাচনভিত্তিক পদ্ধতি থেকে উৎকৃষ্টতর, তা বাংলাদেশ ও ভারতের অভিজ্ঞতা থেকেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় ২০০৩ সালের নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৯৬৯ জন থেকে কমে ৪৩ হাজার ৭৬৪ তে এসে দাঁড়িয়েছিল, যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল।
পক্ষান্তরে, ভারতের পঞ্চায়েতে নির্বাচিত নারী সদস্যদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেমন, ভারতীয় পঞ্চায়েতের তিন স্তরে গ্রাম, মধ্য (পঞ্চায়েত সমিতি) এবং জেলা মোট নারী সদস্যের সংখ্যা ২০০২ সালে প্রায় ৫ লাখ ৮৬ হাজার থেকে ২০০৮ সালে প্রায় ১০ লাখ ৪০ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়েছে ১৩ হাজার ৩০০ থেকে ২১ হাজার ৩৫১ এ।
উপসংহার:
নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য নারীরা যাতে সরাসরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে সেজন্য উদ্যোগী হতে হবে। ‘নীতি-নির্ধারণীতে নারীর অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’ এটা এখন শুধু কথার কথা নয়; মানুষের বিশ্বাসে প্রোথিত হয়েছে।
এসডিজি অর্জন করতে প্রয়োজন একধরনের হলিস্টিক, উর্ধ্বমুখী ও সুসংহত ‘কমিউনিটি-লেড ডেভেলপমেন্ট এপ্রোচ, যার উদ্দেশ্য হবে পুরো সমাজের পরিবর্তন।
এর জন্য প্রয়োজন হবে সমাজে নারী, পুরুষ ও তরুণদের তাদের জীবনের হাল ধরার সুযোগ সৃষ্টি করা। বিশেষত নারীরা উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত, সংগঠিত এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হলে পুরো সমাজের পরিবর্তন ঘটবে তথা এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের জন্য ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে।
লেখক: সিনিয়র প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর (গভর্ন্যান্স), দি হাঙ্গার প্রজেক্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৬